নারীবাদী আন্দোলনের সাথে যারা যুক্ত, তাদের মাথায় রাখা উচিৎ, পিতৃতন্ত্র এত সহজে জায়গা ছেড়ে দেবে না। হাজার হাজার বছর ধরে সে সাড়ম্বরে গেঁড়ে বসেছে, সাম্রাজ্য বাড়িয়েছে, শোষণ তোষন করেছে, সুবিধাভোগ এবং নবাবী করেছে। আজ তার কী এমন ঠ্যাকা পড়েছে যে সে আমাদের হুমকি ধমকিতে এত সহজে জায়গা ছেড়ে দিয়ে সুরসুর করে সিধা হয়ে যাবে?
যারা দুর্নীতিবাজ তারা আরাম আয়েশ, সুবিধা, আনন্দ, ভোগ, বিলাসিতা সব করে নেয় এবং সেসব অভ্যাসের ভিতরে ঢুকে যায়। তাই ধর্মের কথা বলেও তার মতি ফেরানো যায় না। এটা ঠিক তেমনি। পুরুষতন্ত্রের সুবিধাভোগী নারীপুরুষ কেউই সহজে পুরুষতন্ত্রের পতন হতে দেবে না। তারা যেকোনো প্রকারে তা ধরে রাখতে চাইবে আরো কয়েক হাজার বছর।
এই যে পিতৃতন্ত্রকে আঁকড়ে রাখার চেষ্টা, এর কারণ কি? কেনো কেউ পিতৃতন্ত্রের মতো একটি অসভ্য, অশ্লীল, জঘন্য সিস্টেমকে জিইয়ে রাখতে চায়? তারা কারা?
কারণটা হলো, পুরুষতন্ত্র একটি বড় অংশের পারপাজ সার্ভ করে। ঠিক যেরকম একটু আগে দুর্নীতিবাজদের কথা বলছিলাম। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক দুর্নীতিবাজেরা দুর্নীতিকে প্রতি পলে ও প্রতিটি স্তরে ধরে রাখতে চায়। কারণ দুর্নীতি প্রসার পেলে ও সব স্তরে অটুট থাকলে তাদের সুবিধা হয়।
পুরুষতন্ত্রের বিষয়টাও সেরকম। পুরুষতন্ত্র কিছু ব্যক্তিকে, তা পুরুষ ও নারী উভয়ই, অন্যায় করার ও তার মাধ্যমে সুবিধাভোগের সুযোগ করে দেয়। এটা জানা, বোঝা এবং মনে রাখা উচিৎ যে পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্রকে পুরুষই শুধু জিইয়ে রাখে না। বরং বহু নারী পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমকে ধরে রাখতে জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে কাজ করে। এর অনেক ধরনের কারণ আছে।
প্রথমত জন্মের পর থেকে সমাজ নারীকে শেখায় সে দ্বিতীয় লিঙ্গ এবং নারীরা পুরুষের সেবা করবে এটাই নিয়ম। এই শেখানোর প্রক্রিয়াটি এতই আদিম, গভীর ও প্রাচীন যে এর শেকড় উন্মোচন যথেষ্ট কঠিন কাজ। যেকোনো নারীর পক্ষে এই ধারণা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন।
দ্বিতীয়ত, পুরুষতন্ত্র ধর্মকে সাথে নিয়ে নারীর জন্য নিয়ম তৈরি করেছে। ফলে ধর্মীয় আচারগুলো পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষতন্ত্রের ধ্যানধারণা ও নিয়মকানুনের সাথে ধর্মের একটা মেলবন্ধন আছে। এদিকে ধর্মের আদেশ নিষেধ মানতে চায় নারী। ফলে ধর্ম যখন অত্যাবশ্যকীয় এবং সংস্কারের উর্ধ্বে, তখন পুরুষতন্ত্রকে এড়ানো নারীর জন্য প্রায় অসম্ভব।
পুরুষতন্ত্র নারীকে শেকলে আটকেছে এবং এটি করতে গিয়ে প্রথমেই নারীর উৎপাদনশীল ভূমিকাটা কেটে ছেটে দিতে চেয়েছে। কারণ উৎপাদন ও অর্থনীতি যার হাতে, সে সমাজে ও রাষ্ট্রে নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণে এবং তাতে প্রভাববিস্তার করবে বলাবাহুল্য। সেই ক্ষমতা নারীর হাত থেকে কেড়ে নেবার জন্য নারীকে উৎপাদন, আয় রোজগারের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে পুরুষতন্ত্র তাকে ঘরমুখী করেছে। নারীকে এভাবে ঘরমুখী করাতে পুরুষতন্ত্রের বাড়তি যে সুবিধাটা হয়েছে তা হলো, গৃহকর্মের যাবতীয় দায়িত্ব নারীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে পুরুষ নারীর কাছ থেকে অন্তহীন সেবা ভোগ করতে পেরেছে এবং পারছে। যখনই নারী একটু বেঁকে বসেছে, হৈচৈ কি প্রতিবাদ করেছে, পুরুষ তাকে গৃহের রানী, কর্ত্রী, হোমমিনিস্টার নাম দিয়ে ‘পুরো ঘরে নারীর কতৃত্ব আছে’ এবং সেই কর্তৃত্ব একটি বিরাট ব্যাপার এমন ধারণা দিয়ে নারীকে বুঝ দিয়েছে।
নারী যেহেতু পড়ালেখার যথেষ্ট সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যেহেতু বাইরের জগৎ সে কম দেখেছে, দুনিয়াদারির খবর কম রেখেছে, সচেতন হয় নি, তাই নারীকে এইসব বালখিল্য টাইপ বুঝ দেয়া পুরুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
প্রাকৃতিকভাবে নিজের প্রতি ভালোবাসাহেতু নারী যখন উন্মোচিত হতে চেয়েছে, নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে, কিন্তু যোগ্যতা, ক্ষমতার অভাবে এবং পুরুষতন্ত্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে তা পারে নাই, তখন সে সংসারকর্মে নিজেকে সম্রাজ্ঞী হিসেবে ভেবে নেবার পিতৃতন্ত্রের পেতে দেয়া ফাঁদে পা রেখেছে। এই পা রাখাটা চলে এসেছে হাজার বছর ধরে, ফলে তা নারীর অভ্যাসে এবং ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এই অভ্যাস ও ঐতিহ্য পুরুষতন্ত্রের নির্মিত এবং সুপরিকল্পিত এক ষড়যন্ত্রের সফল বাস্তবায়ন।
এই সবের ধারাবাহিকতাই পুরুষতন্ত্রের প্রতি বহু নারীর ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ। জীবনে আসলে কোনোকিছুই অর্জন ও কোথাও অংশগ্রহণ করতে না পেরে, নিজেকে বঞ্চিত করতে করতে নারী ধর্মে ঝুঁকেছে। পরকালে নিজেকে ফিরে পেতে চেয়েছে নানা অর্জনে আর সকল বঞ্চনার ক্ষতিপূরণ মৃত্যুর পর পরজগতে আদায় করে নিতে চেয়েছে।
পুরুষতন্ত্র নিজে টিকে থাকার জন্য পুরুষকে দিয়েও কিছু কষ্ট করিয়ে নিয়েছে। যেহেতু পুরুষতন্ত্র নির্ধারণ করে যে পুরুষই উৎপাদন করবে এবং অর্থনীতির দায় পুরুষের ওপরেই বর্তাবে, অর্থনীতিতে এই জবরদখল ধরে রাখতে পুরুষের ঘাড়েই পড়েছে পরিবারের ভরণপোষণের দায়।
এই দায় নিতে নিতে পুরুষও ক্লান্ত রক্তাক্ত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু দায় ছেড়ে দেয়া মানেই পুরুষতন্ত্রকে দুর্বল করে ফেলা, তাই বারবার ক্লান্ত হবার পরও পুরুষ নারীর সাথে দায় ভাগ করে নিতে সহজে রাজী হয় নি। আবার যুগ যুগ ধরে এই দায় নারীকে নিতে হয় নি বলে নারীও হয়ে উঠেছে আরামপ্রিয় আর পরনির্ভরশীল। এই পরনির্ভশীলতার আরাম আরাম ব্যামো কাটতে নারীর সময় লাগছে।
পুরুষতন্ত্র পুরুষকে তেজী, কঠিন, কঠোর, লৌহদীপ্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পুরুষ কাঁদে না, লজ্জা পায় না – এই জাতীয় বাজে, অবৈজ্ঞানিক মিথ্যা কথা প্রতিষ্ঠা করেছে। পুরুষতন্ত্র পুরুষের আবেগকে দাম দেয় নি। আবার নারীর আবেগ নিয়ে মিথ্যে, অতিরঞ্জিত ধ্যানধারণা প্রচার করেছে। নারীকে নরম কোমল হৃদয়ের অধিকারী বলে পিতৃতন্ত্রের যে প্রচারণা তাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তা পুরুষতন্ত্রকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যেই ঘটেছে।
পুরুষতন্ত্র এভাবে নারী পুরুষ দুইয়ের ভিতরেই নিজেকে কৌশলে সেধিয়ে দিয়েছে। নারী ও পুরুষের মগজে ঢুকে পড়ে পুরুষতন্ত্র তাদের মগজ চিবিয়ে খেয়েছে। পুরুষতন্ত্রকে তাই শুধু পুরুষের মগজের ক্লেদ ভেবে কাজ করলে হবে না। পুরুষতন্ত্র নারীর ভেতরেও ঘাপটি মেরে কিংবা সাড়ম্বরে গেঁড়ে বসে আছে।
আমাদের সিস্টেমে পিতৃতন্ত্র শেকড় বিস্তার করেছে। পুরুষতন্ত্র আমাদের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, আমাদের পরিবারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পুরুষতন্ত্র আমাদের মগজ ধোলাই করছে। এই নিয়ন্ত্রণ, এই শোষণ, এই মগজ ধোলাইয়ের ধারা থামিয়ে দেয়াই নারীবাদের উদ্দেশ্য। সার্বিক অর্থে নারী পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠাই নারীবাদের মূল লক্ষ্য। একদিন পুরুষতন্ত্র ধ্বংস হবে। সেই পুরুষতন্ত্র- যা মনে করে পুরুষ মহান, পুরুষ অধিক শক্তিমান, পুরুষ অধিক যোগ্য, পুরুষ কর্তা। অপরপক্ষে নারী নিচু, কম শক্তিমান, কম যোগ্য এবং পুরুষের দাসী।
পুরুষতন্ত্রের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। কিন্তু লড়াইয়ের পথটা দীর্ঘ। এই দীর্ঘ কণ্টক পথ চলতে হবে, কিন্তু চলার আগে চিনে নিতে হবে পুরুষতন্ত্রের কৌশল আর ষড়যন্ত্রের প্রাচীন আদিম নোংরা রূপটাকে। তা না হলে আরো কঠিন হয়ে উঠবে রণাঙ্গণ।