শারমিন শামস্

সমাজকর্মী শারমিন একজন ফিল্মমেকার ও সাংবাদিক।

মেয়ে, তুমি ঘুমাও ক্যানে?

স্কুলের ক্লাসরুমে শিক্ষিকা ঘুমিয়ে গেছেন। দুই হাত টেবিলে রাখা। ক্লান্ত মুখ। দেখেই বোঝা যায় ক্লান্তি আর অসুস্থতার ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাথা রেখেছেন দুদন্ড। বিষযটা এমনিতে গুরুতর। ক্লাসরুমে ঘুমিয়ে পড়া কোন শিক্ষকের কাজ হতে পারে না। আমার বাসায় সহকারী মেয়েটি, যার নাম সুমনা, তাকে পড়াতে বসিয়ে অবাক হই। গ্রামের স্কুলে সে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নাকি পড়েছে। অথচ পড়ালেখার হাল খুবই খারাপ। জিজ্ঞেস করি, হ্যারে, কিছুই তো পারিস না। সুমনা বলে, কীভাবে পারবো? ক্লাসে তো টিচাররা কিছু পড়ায় না ঠিকমত। এসে ঘুমায় নয়তো একটুক্ষণ ক্লাসে থেকেই চলে যায়।

বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি। গ্রামেই বাস করে বেশিরভাগ মানুষ। সেই গ্রামবাংলার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার মূল চিত্র তো এটাই। সেই অবস্থায়, শিক্ষিকার এই ঘুমিয়ে পড়া গুরুতর ব্যাপারই বটে। কিন্তু তার চেয়ে গুরুতর এদেশে শিক্ষকদের অবস্থা, তাদের অসম্মান, তাদের অমর্যাদা। এর আগে শিক্ষক শ্যামলকান্তির অমর্যাদা দেখেছি। নিতান্ত শক্ত নার্ভের মানুষ বলেই হয়তো তিনি আত্মহত্যার মত ঘটনা ঘটাননি। ঘটলেও অবাক হবার কিছু ছিল না। আজ এই শিক্ষিকার বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এদেশে শিক্ষকরা কতটা অমর্যাদা আর দুরবস্থার শিকার।

প্রথমত একজন জনপ্রতিনিধির কোন অধিকার নাই একজন শিক্ষকের ক্লাসে বিনা অনুমতিতে প্রবেশের। সেখানে লোকটি ক্লাসে ঢুকেছে, ঘুমন্ত একজন শিক্ষক ও নারীর কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, পুরো ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সামনে তাদের শিক্ষককে অসম্মান এবং অপমান করেছেন। তার চেয়ে বড় কথা, তিনি কোন রকম অনুমতি ছাড়া একজন ব্যাক্তির ছবি তুলেছেন, সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে ব্যাক্তির সম্মানহানি করেছেন। যা কিছু ঘটেছে, তা কেবল এই উপমহাদেশ তথা এই দেশেই ঘটা সম্ভব। কোন উন্নত সভ্য দেশ হলে একজন স্কুল শিক্ষিকা কেন শরীর খারাপ সত্ত্বেও ক্লাসে গিয়েছিলেন সেটা নিয়ে তদন্ত হতো, দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখতেন, ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়া ছবি তোলা ও ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে ক্ষতিপূরণ মামলা হতো। কিন্তু এই দেশে এইসবের কিছুই হয় না।

শিক্ষিকার ছবিটার দিকে তাকালাম। ক্লান্ত একজন মানুষ দু’হাতে মাথা রেখে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, কয়েকদিন ধরেই তিনি অসুস্থ এবং তাই নিয়েই স্কুলে আসছেন। ঘটনা সত্য হতেই পারে। একজন নারী এমনিতেই পরিশ্রম বেশি করেন। সংসার সামলান। শিশু সন্তানের মা হয়তো তিনি, রাত জাগতে হয় নিশ্চয়ই। স্কুলেও কাজ করেন। এতসব সত্ত্বেও স্কুলে ঘুমিয়ে পড়াটা অন্যায়। তার ঘুমিয়ে পড়ার ঘটনাটা জানার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারতেন, কোন পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষক ক্লাসভর্তি শিক্ষার্থীর সামনে ঘুমিয়ে পড়লেন, কতটা ক্লান্ত তিনি ছিলেন যে জনপ্রতিনিধির মত হোমড়াচোমড়ার আগমন, ছবি তোলাসহ এত কিছু ঘটার পরও তিনি টের পেলেন না, বিষয়টি সত্যিই ভাবনার। ঘুমিয়ে পড়ার বিষয়টি চেয়ারম্যান জানার পর যদি স্কুল কর্তৃপক্ষকে তা জানাতেন, তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই শিক্ষিকাকে যথাস্থানে তলব করে শো কজ করতে পারতেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া যেত। কিন্তু ছবি তুলে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া কখনোই কোন সভ্য রুচিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধির কাজ হতে পারে না। কেবলমাত্র বর্বর অসভ্য নোংরা সমাজেই এসব ঘটনা ঘটে থাকে।

আমাকে এলিট নারীবাদি বলে গালি পাড়ে লোকে। তাদের ধারনা আমি শহরে থাকি, পায়ের উপর পা তুলে জীবন কাটাই, বিলাসে ব্যসনে রূপচর্চায় আমার সময় কাটে আর অবসরে আমি ফেমিনিজম ফলাই। বিষয়টা হল, ফেমিনিজম ফলাই বা না ফলাই, একজন মধ্যবিত্ত নারী বিশেষ করে যিনি মা হয়েছেন, তার কখনো পায়ের ওপর পা তুলে বিলাসিতার সময় নাই। বরং প্রতিটি নারী এবং প্রতিটি মা'ই এদেশে অতিরিক্ত কাজের চাপে থাকেন। কারন এই দেশে পুরো পরিবার ঘরের যাবতীয় কাজ এবং সন্তান লালন পালনের সমস্ত কাজ নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। আর যে নারী ঘরে বাইরে দু’স্থানেই কাজ করেন, মাল্টিটাস্কিংয়ের চাপ মাথায় নিয়ে তার দিন শুরু এবং শেষ হয়। এদেশে নারীর শ্রমকে কেউ গুরত্ব দেয় না। ধরেই নেয়া হয়, নারী মানেই রান্না করবে, বাচ্চা খাওয়াবে, স্বামীর জন্য রানবে, বাড়বে, শ্বশুড়ের পা ধোবে এবং দিনশেষে বাচ্চারে বুকের দুধ দিতে দিতে শয্যায় স্থান নেবে। নারীর তো কোন অবসর নাই। আমার মাকে দেখি নাই কোনদিন ঘরের কাজ থেকে ছুটি পেতে। আমিও পাই না। অফিসে বসেও আমি ঘরের কাজ পরিচালনা করি, বাচ্চা দুপুরে কী খাবে সেই সমাধান করতে করতেই মিটিং সারি।

শিক্ষিকা দীপ্তি বিশ্বাসের চোখের নিচের ক্লান্তি তাই আমি পড়তে পারি। আবার একই সাথে তার অপমান আর হেনস্তাটাও একই আত্মা হয়ে অনুভব করতে পারি। প্রায় একইভাবে আমার ছবি ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে হেনস্তা করেছিল এক মহিলা এমপি। আমি বিচার পাইনি। প্রকাশ্য সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে সেই জনপ্রতিনিধির নোংরা তান্ডব সকলে প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু সে থেকে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই দেশে সব সম্ভব। সব।

আমি জানি, এই চেয়ারম্যানেরও কোন বিচার হবে না। দীপ্তি বিশ্বাস উল্টো বিপদে পড়বেন। নানা ধরণের হুমকি ধমকির মুখে পড়বেন। পুরো ক্লাসরুমের সামনে একজন শিক্ষকের হেনস্তা গোটা জাতি দেখবে আর মুখ ঘুরিয়ে যে যার কাজে চলে যাবে।

শিক্ষিক দীপ্তি বিশ্বাস, আমি বিশ্বাস করি, আপনার সীমাহীন ক্লান্তি আর অসুস্থতা আপনার এই হঠাৎ ঘুমের কারণ। কারন যাই হোক, আপনাকে এভাবে হেনস্তা ও অপমান করার কোন অধিকার এই দেশে কারো নেই। সে যত বড় ক্ষমতাবানই হোক। আপনি একজন শিক্ষক। আপনার মর্যাদা সকলের উপরে। আপনি এদেশের নাগরিক। সেই হিসেবে আপনার অধিকার আছে আপনার প্রতি আনা অভিযোগের উত্তর দেবার। কিন্তু কারো কোন অধিকার নাই আপনার ছবি তোলার, তা ছড়িয়ে দেবার। আপনি একজন নারী, কারো অধিকার নাই আপনাকে অপ্রস্তুত করার।

দীপ্তি বিশ্বাস, আপনি মনে রাখবেন, এই দেশে ওই চেয়ারম্যানের কোন বিচার হবে না। বরং আপনার চাকরিচ্যুতি হলেই সেটা স্বাভাবিক ঘটনা হবে। আপনাকে এলাকাও ছাড়তে হতে পারে। ঘটনা যাই হোক, আপনার প্রতি অনুরোধ, মাথা উঁচু রাখবেন। আপনার অধিকার আপনার আত্মসম্মানের প্রতি বিশ্বাস রাখবেন, অবিচল থাকবেন।

এছাড়া এ মুহূর্তে এই হতভাগ্য দেশ আর সমাজে আর কিছুই যে আমাদের করার নেই!  

5294 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।