আজ ১ লা'মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্প কারখানাই শ্রমঘন৷ শ্রমিকের ঘামেই সচল আছে দেশের অর্থনীতি৷ শ্রমঘন পোশাক শিল্প সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত৷ কিন্তু সেই শ্রমিক মুনাফার কতটুকু পায় তারা? তার জীবনের চাকা সচল রাখতে তার মজুরি কি যথেষ্ট?
রাজনৈতিক ভাবে এই দিনটির তাৎপর্য আর শ্রমিকদের কাছে আগের মতো আর সেই মূল্য বহন করে না। ট্রেডইউনিয়ন ভেঙে এখন হয়েছে শ্রমিক লীগ, শ্রমিকদল আর শ্রমিক পার্টি ইত্যাদি। আর সরকারী মন্ত্রীরা হয় শ্রমিক নেতা।
একসময়ের শ্রমিক আন্দোলনের কিংবদন্তী, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের লড়াকু বিপ্লবী, সাইফুদ্দিন মানিক আথবা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি, কমরেড ফরহাদ আর শহিদুল্লাহ চৌধুরী তারাই ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। ১৯৬২ এর উত্তাল শ্রমিক আন্দোলন আর ৬৮/৬৯ এর গণআন্দোলন আইয়ুব শাহীর পতন এর কাহিনী এখনো ইতিহাস হয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশে অর্ধশতাধিক ট্রেড ইউনিয়ন বা ফেডারেশন রয়েছে এমন তথ্য জানালেন এক সময়ের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এক শ্রমিক নেতা। এর প্রতিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং অন্য পদাধিকারী রয়েছেন। তারা কখনও একলা চলেন, কখনও-বা জোট বাঁধেন। তিনি কিছুটা মজা করেই বলেছেন "অর্ধকোটি শ্রমিক, অর্ধশত শ্রমিক ইউনিয়ন" যেসব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ইউনিয়ন রয়েছে, সেখানে অনেক শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশনের শাখা এবং প্রায় সবগুলোই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত।
বাংলাদেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ দিনমজুর। তারা প্রতিদিনের মজুরিতে কাজ করেন। বিশেষ করে কৃষি, নির্মাণ শিল্প এবং উন্নয়নমূলক কাজের শ্রমিকরা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। অনেকেরই প্রতিদিন কাজ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত নয়। তাই ঢাকাসহ এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শ্রমিকের হাঁট গড়ে উঠেছে৷ এসব হাঁটে শ্রমিকরা কাজের আশায় সকালে গিয়ে হাজির হন। আর যাদের শ্রমিক দরকার, তারা সেখান থেকে শ্রমিকদের নিয়ে যান৷
এসব হাঁটে কৃষি জমিতে, নির্মাণ এবং উন্নয়ন কাজের শ্রমিকদের পাওয়া যায়। তাদের দৈনিক মজুরি সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। তবে সমস্যা হলো প্রতিদিন তারা কাজ পান না। তাই তাদের গড় মজুরি অনেক কম। এই মজুরি দিয়ে তাদের সংসার চালানো কঠিন।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকের কাছে জেনেছি, একটি শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশনে অন্তত তিনটি কারখানার নির্বাচিত শ্রমিক ইউনিয়ন থাকলেই কেবল ফেডারেশন গঠন করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে যে অর্ধশতাধিক ফেডারেশন রয়েছে তার বেশিরভাগের সঙ্গে কোনো নির্বাচিত শ্রমিক ইউনিয়ন নেই। এমনকি আওয়ামী লীগের শ্রমিক লীগও এবং বিএনপির জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের মতো বড় সংগঠনও কারখানায় নির্বাচিত শ্রমিক নেতৃত্ব নিয়ে মাথা ঘামায় না। তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা উচিত কি অনুচিত, সেটা নিয়ে অনেকদিন ধরে বিতর্ক চলছে। মালিকপক্ষ শ্রমিক বা কর্মীদের সংগঠিত থাকা খুব একটা পছন্দ করে না। তারা স্বীকার করেন, ইউনিয়ন থাকলে ভালো, আরও ভালো যদি সে ইউনিয়নে থাকে নিজের লোক। বহু বছর মালিকদের অবশ্য ভয় ছিলো 'বিপ্লবের'। বিশেষ করে কমিউনিস্ট বিপ্লবের। কার্ল মার্কস একদা ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলসের সঙ্গে মিলে কমিউনিস্ট ইশতেহারে লিখেছিলেন, কিন্তু সেই ইউরোপিয়ান ট্রেডইউনিয়নের আদর্শিক আন্দোলনকে 'ইউরোপ ভূত দেখেছে কমিউনিজমের ভূত' বলে বিদ্রূপ করা হয়।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক, বস্ত্র, পাট, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পসহ বড় বড় শিল্পে অবশ্য শ্রমিকরা কাজ করেন মাসিক বেতনে। আর সেখানে তাদের নিয়োগপত্র প্রাপ্তিসহ আরো কিছু সুবিধা আছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মাসিক মজুরি দাবি করা হয় ৫,৩০০ টাকা। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পে এই মজুরি কিছুটা বেশি। তারপরও জীবন চলে না পোশাক শ্রমিকদের৷।বাংলাদেশের বৃহত্তর রফতানিকৃত শিল্প, গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাসিক বেতন গড়ে এখন ৪.৮০০ টাকা।
দক্ষিন এশিয়া বা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি গড় হিসেবে সবচেয়ে কম।বাংলাদেশে গড়ে একজন শ্রমিকের প্রতিদিনের মজুরি ১৭৬ টাকা ৬৭ পয়সা ( ২.১৯ ইউএস ডলার)৷ ভারতে ২.৪০ ডলার, পাকিস্তানে ৩.১৫ ডলার, মিয়ানমারে ২.১৬ ডলার৷ এটা গড় হিসাব। সাধারণভাবে বিভিন্ন শিল্পখাতে মজুরির পার্থক্য আছে।
বাংলাদেশে এখন কৃষিখাতে মজুরি সবচেয়ে কম। অন্যান্য খাতের মধ্যে বস্ত্রখাতে প্রতিদিনের মজুরি ২৪৮.১৭ টাকা, পাটশিল্পে ২৪৭.৫০ টাকা আর প্রকৌশল খাতে ৩৫০ টাকা৷ তবে এটা অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য। দক্ষ শ্রমিকদের বেতন আরেকটু বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, বাংলাদেশে শ্রমশক্তির পরিমাণ ৫ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৩ কোটি ৯৫ লাখ ও নারী ১ কোটি ৭২ লাখ। তবে মোট শ্রমশক্তির বেশিরভাগই গ্রামে বাস করে। শহরের শ্রমশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৩৩ লাখ আর গ্রামের ৪ কোটি ৩৪ লাখ।
এই শ্রমশক্তির মধ্যে ৮৭.৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে আর মাত্র ১২.৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। মোট কর্মজীবীর মধ্যে অবৈতনিক পারিবারিক সহযোগীর সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লাখ৷ কৃষি, বনজ ও মৎস খাতে যুক্ত মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৫৭ লাখ ও দিনমজুরের সংখ্যা ১ কোটি ৬ লাখ। সব মিলিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৩ লাখ আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ৬৮ লাখ। বিভিন্ন পেশার কর্মজীবীদের মধ্যে কৃষি খাতে ৪৭.৩ ও অকৃষি খাতে ৫২.৭ শতাংশ নিয়োজিত রয়েছে।
বাংলাদেশ ইন্সটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর সহকারী নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন বলেন, ‘‘বাংলাদেশের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি কোনোভাবেই তাদের জীবন ধারণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এর কারণ, এখানে মজুরি নির্ধারণ করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়।’’
তিনি বলেন, ‘‘মজুরি নির্ধারণের দু'টি স্তর আছে। প্রথম স্তরে একজন শ্রমিকের পরিবার নিয়ে জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম যা প্রয়োজন, আর দ্বিতীয় স্তর হলো, একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মুনাফা এবং সক্ষমতা কত তার উপর। তবে প্রথম স্তরের মজুরি নির্ধারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠান লাভ করছে, না মুনাফা করছে তা বিবেচ্য নয়৷’’
২০১৩ সালে বিলস এক গবেষণায় দেখিয়েছিলো যে, বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মাসিক মজুরি বা বেতন হওয়া উচিত ১৯ হাজার টাকা। তারা একটি পরিবারকে ৪ থেকে ৫ সদস্যের ধরে এই হিসাব করেছিলো তবে তারা তখন ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব করেছিলো ৮,৫০০ টাকা৷ সুলতান উদ্দিন জানান, ‘‘আমরা ৮৫০০ টাকা প্রস্তাব করেছিলাম একটি পরিবারে দু'জন উপর্জনক্ষম হবে সেই বিবেচনা করে। তা-ই মালিকরা মানেন নি। ১৯ হাজার টাকা প্রস্তাব করলে তো আমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতো।’’
বাংলাদেশে একটি মানসিকতা গড়ে উঠেছে যে, মজুরি বেশি দিলে মুনাফা কম হবে। বাংলাদেশে সস্তা শ্রমকেই তারা পুঁজি হিসেবে দেখছে। মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন করলে শ্রমিকদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। সম্প্রতি আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে শ্রমিকরা মামলা এবং গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন বলে জানান সুলতান উদ্দিন৷
তথ্যসূত্র : ডয়চে ভেলে