লোহার দরজা খোলার কর্কশ শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো তাঁর। গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর জীবনের এটাই শেষ রাত, সেটা জেনেই ঘুমিয়েছিলেন তিনি। সকালবেলাতে ফাঁসি হয়ে যাবে, এরকমটা জানার পর কোনো মানুষের পক্ষেই ঘুমানো সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি ঘুমিয়েছেন। সাধারণ কোনো মানুষ তিনি নন।
সাধারণের চেয়েও সাধারণ দেখতে তিনি। গড়পড়তা বাঙালির চেয়েও ক্ষুদ্রকার, ক্ষীণদেহী একজন ব্যক্তি। মাথার চুল পাতলা হয়ে গিয়েছে সামনের দিকে। সেখানে বেশ খানিকটাই টাক। পোশাক আশাক অতি সাধারণ। শান্ত-সমাহিত মুখে মৃদু একটা হাসি লেগে থাকে সবসময়। চোখ দুটোই যা একটু ব্যতিক্রম। অত্যন্ত উজ্জ্বল দুটো চোখ। এই চোখ দুটোকে খেয়াল করলেই বোঝা যায়, অতি সাধারণ চেহারার এই মানুষটি সাধারণ কেউ নন। অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ, অসাধারণ একজন ব্যক্তিত্ব।
কারাকক্ষের দরজা খুলে কনডেম সেলে ঢুকে পড়েছে চার-পাঁচজন ইংরেজ। হিংস্র চেহারা সকলের। পাশের সেলেও শব্দ পেলেন তিনি। সহযোদ্ধার সেলেও তাঁর সেলের মতোই ঘটনা ঘটছে, তিনি বুঝতে পারলেন। সকালে ফাঁসি হবার কথা, এই মাঝ রাতে এরা কী করতে এসেছে, সেটা বুঝতে পারার আগেই আক্রান্ত হলেন তিনি। ফাঁসির সমস্ত বৈধ নিয়ম কানুনকে ভেঙে দিয়ে ইংরেজ অফিসাররা প্রবল হিংস্রতা নিয়ে তাঁকে পেটাতে শুরু করলো। কিল, চড়, লাথি, ঘুষি, একের পর এক পড়তে থাকলো তাঁর গায়ে। একজন লাঠি দিয়ে হাঁটুতে পেটাচ্ছে নির্দয়ভাবে। আরেকজন সাঁড়াশি দিয়ে তাঁর নখ উপড়ে নিচ্ছে। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে শেষ লড়াই করার চেষ্টা করছেন। সেটা করতে গিয়ে দলবদ্ধ শত্রুর হাতে আরো বেশি পিটুনি খাচ্ছেন। পাশের সেল থেকেও অমানুষিক চিৎকার ভেসে আসছে।
তাদের দুজনের আর্তনাদে জেগে উঠেছে পুরো জেলখানা। অপার্থিব শব্দে গর্জন করছে তাঁর সহযোদ্ধারা। প্রতিটা সেলের দরজায় ভাঙার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। না পেরে গগনবিদারী কণ্ঠে শ্লোগান দিচ্ছে তাঁরা বন্দে মাতরম বলে। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, মাস্টারদা জিন্দাবাদ, শ্লোগানে শ্লোগানে কাঁপিয়ে দিতে থাকলো তাঁরা রাতের আঁধার।
তাঁর গায়ে এর আগেও হাত তুলেছে ইংরেজরা। গৈরালা গ্রামে যেদিন তিনি বন্দি হলেন, তাঁকে পায়ে হাঁটিয়ে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দূরত্বের পটিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেই নেওয়াটা সুখকর কিছু ছিলো না। কর্ষিত জমি, ঢেলা ভরতি মাঠের উপর দিয়ে সেনাবাহিনী এবং পুলিশের লোকেরা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো উল্লাস করতে করতে। তাঁর সাথে ব্রজেন সেন, ক্ষীরোদপ্রভা ও মনোরঞ্জনও ছিলো। পটিয়া থেকে ট্রেনে করে চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় তাঁকে। সাথে ব্রজেনও ছিলো। তাঁদের দুজনকে একটা লোহার খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে তুলে দেওয়া হয় ট্রেনে।
ষোল শহর জংশনে ট্রেন থামতেই তাঁর কামরায় উঠে এসেছিলো কয়েকজন ইংরেজ এবং বাঙালি গোয়েন্দা। এক ইংরেজ সার্জেন্ট গর্জন করে জিজ্ঞেস করলো, “হু ইজ দ্যা গ্রেট সূর্যসেন?” কেউ একজন আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো, “ওই যে উনি।”
যেই না বলা, অমনি সেই ইংরেজ সার্জেন্ট ধাই করে ঘুষি বসিয়ে দিলো তাঁর নাকে। নাক ফেটে দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। ট্রেনের মেঝে লালে লাল হয়ে গেলো রক্ত মেখে। ঘুষির প্রচণ্ড তাণ্ডবে মাথা ঘুরে তিনি পড়ে গেলেন ব্রজেন সেনের বুকে। মাথায় জল ঢেলে খানিকটা সুস্থ করা হলো তাঁকে।
ষোল শহর থেকে গাড়িতে করে তাঁকে এবং ব্রজেন সেনকে আনা হলো জেলা গোয়েন্দা অফিসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হলো পুলিশ সুপার হিকস এবং সহকারী পুলিশ সুপার স্প্রিংফিল্ড। এসেই তাঁকে এবং ব্রজেনকে বেধড়ক পিটাতে শুরু করলো তাঁরা। বহুদিনের রাগ এবং আক্রোশ আজ মিটিয়ে নিচ্ছে তারা সুযোগ পেয়ে।
বন্দি হবার সময়ে এমন অত্যাচার হয়, সেটাতে তিনি বিস্মিত হন নি। কিন্তু, বিচার হয়ে যাবার পরে আজ যখন আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর ফাঁসি হতে চলেছে, সেই সময় সব নিয়ম ভেঙে ইংরেজরা তাঁকে পেটাবে, এরকমটা স্বপ্নেও ভাবেন নি তিনি।
কাল সকালেই তাঁর ফাঁসি হতে যাচ্ছে, এটা সকাল বেলাতেই জেনে গিয়েছিলেন তিনি। সিনিয়র ডেপুটি জেলার নীলমণি মুখার্জী কয়েদী পরিদর্শনে এসেছিলেন। ফেরার সময় একজন বিপ্লবীকে চুপিসারে তিনি বলে গেলেন, আজ রাতে মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর বাবুর ফাঁসি হবে।” তাদের ফাঁসির দিন যে ঘনিয়ে এসেছে, এটা অবশ্য এমনিতে সকলে বুঝতে পারছিলো। ফাঁসির তারিখটাকে গোপন রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো কারা কর্তৃপক্ষ। সেটা গোপন থাকলেও প্রস্তুতি দেখে অনুমান করে নিতে সময় লাগে নি যে সময় ঘনিয়ে এসেছে। জেলে যাদের ফাঁসি হয়, তাদের ওজনের নকল মানুষ বা ইট-পাথর ভর্তি বস্তা ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে বার বার পরীক্ষা করা হয়। ফাঁসির সাতদিন আগে থেকে এই সব প্রস্তুতি চলতে থাকে। আজ নীলমণি মুখার্জীর কাছ থেকে নিশ্চিত খবর পেয়ে বন্দিদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। বিষাদে ভরে গেছে সবার হৃদয়।
কনডেম সেলের পাশেই রাজনৈতিক বন্দি ওয়ার্ড। দুই ওয়ার্ডের মাঝখানে উঁচু একটা দেওয়াল। মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা অংশ। ওদিক দিয়ে দুই পাশের লোকজনের কথা আদান-প্রদান হয়। বিকাল সাড়ে চারটা রাজবন্দি ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে তারা সমস্বরে জয়ধ্বনি দিতে লাগলো। বন্দে মাতরম! সূর্য সেন কি জয়! তারকেশ্বর দস্তিদার কি জয়!” শতাধিক বন্দির জয়ধ্বনিতে কেঁপে উঠতে থাকলো জেলখানা। রাজবন্দিদের জয়ধ্বনির পাল্টা আওয়াজ শোনা গেলো অন্যপাশ থেকেও। ভেসে এলো সূর্যসেনের কণ্ঠ, “বন্দে মাতরম! সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।” তারকেশ্বর দস্তিদারও একই সুরে সুর মেলালেন।
সন্ধ্যার পরে কনডেমড সেল থেকে মেথরের মাধ্যমে বিপ্লবীদের জন্য শেষ বার্তা পাঠিয়ে ছিলেন তিনি। ইংরেজিতে লেখা সেই বার্তার বাংলাটা এমনঃ
“সুদৃঢ় ঐক্য ও সুমহান আদর্শ - আমার শেষ বাণী। আমার মাথার ওপর দুলছে মৃত্যুর ফাঁস। দুয়ারে ধ্বনিত হচ্ছে মৃত্যুর করাঘাত। মন আমার অনন্ত-অমৃত পথযাত্রী। এই তো ‘সাধনা’-র প্রকৃষ্ট সময়। মৃত্যুকে মিত্রের মতো আলিঙ্গনের এই তো সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করার এইতো সঠিক মুহূর্ত।
কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। প্রিয় ভাইবোনেরা আমার, তোমরা আমার জীবনের একঘেয়েমিকে ভেঙ্গে দাও। আমাকে উৎসাহ দাও। এই আনন্দঘন, পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কী রেখে গেলাম? মাত্র একটি জিনিস আমি রেখে যাচ্ছি, তা হলো আমার স্বপ্ন। একটি সোনালি স্বপ্ন - স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। কী শুভক্ষণে আমি এই স্বপ্ন দেখেছিলাম। জীবনভর পরম উৎসাহে ও অক্লান্তভাবে উন্মাদের মতো এই স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি আমি। জানি না, কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে যদি মৃত্যুর হিম-শীতল হাত তোমাদের স্পর্শ করে, তবে তোমরা তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই মহান কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব তুলে দিও, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। এগিয়ে চল, কমরেডস, এগিয়ে চল। কখনো পিছিয়ে পড়বে না। দাসত্বের দিন অবসান প্রায়। স্বাধীনতার ঊষালগ্ন আগত ঐ। ওঠো। কাজে লাগো। কখনো নিরাশ হয়ো না। সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে ইস্টার অভ্যুত্থানকে কখনো বিস্মৃত হয়ো না। জালালাবাদ, জুলদা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সর্বদা স্পষ্ট মনে রেখো। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদ দেশপ্রেমিকদের স্মৃতি অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে রক্তাক্ষরে লিখে রেখো।
তোমাদের কাছে আমার আন্তরিক আবেদন আমাদের সংগঠনে যেন বিভেদ না আসে। যারা কারান্তরালে ও বাইরে রয়েছো তাদের সকলের প্রতি রইলো আমার আশীর্বাদ। বিদায় বন্ধু, বিদায়।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, বন্দে মাতরম।”
ইংরেজরা পিটিয়ে আধমরা করে ফেললো দু’জনকেই। জ্ঞান হারালেন দু’জনেই। এই অবস্থাতেই তাঁদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো ফাঁসির মঞ্চে। ঝুলিয়ে দেওয়া হলো দু’জনকেই।
এই অমানবিক দৃশ্য দেখে লজ্জায় মুখ অধোবদন করলো জেলখানার কর্মীরা। অব্যক্ত এক বেদনায় গুমরে মরতে লাগলো তারা। আর রাজবন্দিরা অক্ষম আক্রোশে মাথা ঠুকতে লাগলো গরাদে। পাগলের মতো ছুটে বের হয়ে আসতে চাইছে সবাই। কণ্ঠ ছেড়ে শ্লোগান দিচ্ছে সবাই মাস্টারদা জিন্দাবাদ বলে।
রাজবন্দি ওয়ার্ডের এই অশান্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে গুর্খা সৈন্যরা ঢুকে পড়লো ওয়ার্ডের মাঝে। শুরু হলো বেধড়ক লাঠিচার্জ। তাদের এক কথা, জেলে কোনো শ্লোগান দেওয়া চলবে না। লাঠিচার্জ করে সৈন্যরা বের হয়ে যেতেই বিপ্লবীরা আবার গলা ছেড়ে শ্লোগান ধরে, জয়ধ্বনি দিতে থাকে। আবার ওয়ার্ডের মধ্যে ঢুকে পড়ে সৈন্যরা। আবারও চলে নিষ্ঠুর লাঠিপেটা। সারারাত ধরে চলতে থাকে এই নির্যাতন, বিপ্লবীদের কণ্ঠরোধ করার জন্য। নেতার জন্য শোক করার, তাঁর অনৈতিক মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাতেও তাদের দেওয়া হবে না। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত চলে অত্যাচার। বিপ্লবীদের শরীর তখন ক্ষত-বিক্ষত, রক্ত ঝরছে সবার গা বেয়ে।
চলমান...
***
সূর্যসেনকে নিয়ে লেখার তাগিদ আমি পাই মূলত জর্জদার (জর্জ রায়) কাছ থেকে। এই ভদ্রলোক আমার দেখা অন্যতম সেরা একজন ভালো এবং ভদ্র মানুষ। রুচিশীলতাতেও তিনি অনায়াসে অতিক্রম করে যাবেন বহু মানুষকে। অনেক বছর আগে থেকে সূর্যসেনকে নিয়ে যাতে আমি লিখি, সেই অনুরোধ উনি করে আসছিলেন। এই লেখাটা তাই তাঁকে উৎসর্গ করছি আমি। লেখাটা পড়ে পাঠক যদি আনন্দ পান, তবে তার কৃতিত্ব জর্জদার। পাঠক অখুশি হলে সে দায় আমার উপর।
লেখাটা তিন পর্বে লিখেছি আমি। এর প্রতিটা পর্বই স্বয়ংসম্পূর্ণ।
সূর্যসেনের প্রকৃত নাম সূর্য্যকুমার সেন। কুমার বাদ দিয়ে তাঁকে সূর্য্য সেন বলেই ডাকতো। বানান সংশোধনের কারণে সূর্য্য বানান এখন সূর্য লেখা হয়। আর বাংলাদেশে কীভাবে কীভাবে যেন সূর্য আর সেন এই দুটো আলাদা শব্দ একসাথে মিশে গিয়েছে। সূর্য তাঁর প্রথম নাম, সেন তাঁর পদবী, এটা অদৃশ্য হয়ে গিয়ে সূর্যসেন নামের একক এক নামে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন তিনি। সে কারণে, আমিও তাঁকে সূর্যসেন বলেই উল্লেখ করলাম।
আমার ছেলের নাম অর্ক। এর অর্থ সূর্য। ওর জন্ম প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবসে। সে কারণে সূর্যসেনের নামেই আমি নাম রেখেছি আমার একমাত্র সন্তানের।