১. তখন সদয় বিয়ে হয়েছে আমার। চোখে মুখে কিশোরীর স্বপ্ন, কৌতুহল নিয়ে স্বামীর সংসারে এসেছি। আমার বয়স কম হলেও স্বামীর বাস্তবজ্ঞান প্রখর। বিয়ের পর সিদ্ধান্ত নিলেন ছোটো দু'কামরার বাসায় চলে যাবো আমরা, এতে আর্থিকভাবে কিছুটা সাশ্রয় হবে। বিয়ের তিন মাস বাদেই শ্বশুরবাড়ি থেকে সেই সেমিপাকা বাসায় এসে আমার নতুন সংসার সাজাতে শুরু করলাম। ঘরে টিনের চাল - তার নিচে মজবুত বেড়ার ছাদ দেওয়া - টিনের গরম কমানোর জন্য।
পাশাপাশি সারিবদ্ধ চারটি ফ্যামিলি, মানে আমরা ছাড়াও আরো তিনটে পরিবার এক সাথে থাকতাম। ঘরের দেয়ালগুলোর পুরুত্ব এতই কম ছিলো যে সুঁই পতনের শব্দ ও পাশের প্রতিবেশীর কান এড়াতো না বোধহয়। এমন সেমিপাকা ঘরগুলোতে প্রতিবেশীর সাথে নানা ছুঁতোয় ঝগড়া বেঁধে যাওয়া ছিলো নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আমি এমন পরিবেশে একেবারে নতুন একজন মানুষ। স্বামীর সাশ্রয় করতে হবে এটা যেমন সব সময় মাথায় রাখতে হোতো, তেমনি চার দেয়ালে ঘেরা ছোট্ট ঘরটি আমার আপন হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে। সাধ আর সাধ্যের সমতা রেখে ঘরটিকে বুকে আগলে শুরু হোলো আমার নতুন সংসার জীবন। ঘরটির প্রতিটি কোণায় কোনায় যেন মায়া ছড়ানো। আমার নিজের হাতে গোছানো, আমার একান্ত আপন গৃহকোণ।
মেলায় বিক্রি করা সস্তা দামী মাটির পুতুল, কাপড়ের ফুল, গণের মূর্তি কিনে এনে ঘর সাজাতাম। মনে আছে- এই ঘরে আসার পর থেকে কোথাও বেড়াতে গিয়ে একরাত বাইরে থাকি নি কখনো। সময় গড়াচ্ছিলো, সাথে অন্য সব সংসারের মতো আমাদের মধ্যেও দাম্পত্যের নানা খিটিমিটি শুরু হোলো। তবুও ভালোই ছিলাম আমরা।
ভালো ছিলাম আমি আমার নতুন সাজানো ঘর নিয়ে। একদিন হঠাৎই দাম্পত্য খিটমিট ঝগড়ায় রূপ নিয়ে নিলো একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। আমার স্বামী সেদিন ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমাকে ঘর থেকে বাইরে বের করে দিয়েছিলেন, সেদিনই প্রথম। লজ্জায়, অপমানে চোরের মতো সেদিন মাঝরাতে ঘরের দরজার বাইরে বসেছিলাম আমি। আমার বহু অনুনয়-বিনয়েও সেদিন দরজা খুলে দেন নি তিনি। এটা ছিলো আমার ঝগড়া করার শাস্তি।
পরে আরো বহুবার আমাদের ঝগড়া হয়েছে। পরের দিনগুলোতে কখনো মনের ক্ষত নিয়ে, কখনো শরীরের কালসিটে শাড়ির আঁচলে আড়াল করে ঘরের বাইরে দরজার সামনে রাত কাটিয়ে দিয়েছি। এতো স্বপ্ন, ভালোবাসা নিংড়ে দিয়েও যে ঘর আমার হয় না, যে ঘর থেকে বের করে দিতে কোনো বিবেকের দংশন হয় না, কোনো আইনের পরোয়া করতে হয় না, সে ঘর এতদিন আমি আপন ভেবে আগলে ছিলাম! অথচ এখানে আমার ঠাঁই নেই। তাহলে আমার ঘর কোথায়? কোথায় আমার বাড়ি?
২. তেরো বছর সংসার করার পর, মনে হোলো এতদিন যা কিছু বইয়ের পাতায় লিখে রাখতাম এবার তা মলাট বদ্ধ করি। এবারের বইমেলায় আমার একটি বইও বের হলো। স্বামী বললেন - প্রতিদিন বই মেলায় যাবার দরকার নেই। এটি ছিলো তাঁর চূড়ান্ত আদেশ- বুঝতে বাকি রইলো না আর। তবুও ফেসবুকে সামান্য কিছু পরিচিতর সূত্রে বন্ধুরা বইমেলায় এসে আমাকে খোঁজেন। যে প্রকাশনা সংস্থা থেকে বইটি বিনামূল্যে প্রকাশিত হলো- তাঁদের সকলের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে আমি সেদিন বইমেলায় না গিয়ে পারি নি।
বাসায় ফিরে দেখলাম, দোর আঁটা। তের বছরে আমার সাজানো ঘরে আরো দুটি প্রাণের জন্ম হয়েছে। আমাদের সন্তান। দরোজায় টোকা দিতেই আমার বারো বছর বয়সী কন্য বললো- "বাবা তোমাকে ঘরে ঢুকতে দিতে নিষেধ করেছে। "বুঝলাম, আমার স্বামী আমার মেলায় যাওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ। বাচ্চাদের তাই হয়তো আমাকে দরজা খুলে দিতে মানা করে দিয়ে গেছেন। সেদিনও আমার স্বামী অফিস থেকে না ফেরা পর্যন্ত আমি দরজার বাইরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলাম। জানালার গরাদের ওপারে আমার সুখের সংসার! আমার ঘর! আমার জীবনীশক্তির বিন্দু বিন্দু নিঃশেষ করে জন্ম দেওয়া প্রাণ। সন্তান তাদের পিতার। ঘরটি তাদের পিতার। আমার আপন কে? আমার ঘর কোথায়!?
৩. ভেবেছিলাম বাপের বাড়ি গিয়ে উঠবো। রইলাম মাস দুয়েক। তবে সেখানে গিয়ে যেনো মনে হলো আমার " মালিকানা " বদল হয়ে গেছে আগেই! আমি এখানে কেবল অতিথি মাত্র। বিয়ের পর স্বামীর ঘরই তো মেয়েদের একমাত্র আশ্রয়, সংসারে এসব মনোমালিন্য হয়েই থাকে। তাছাড়া, হিন্দু মেয়েদের তো বাবার সম্পত্তিতে কোনো অধিকারই নেই। বিয়ের পর সে দাবী করতে পারে না বাবার ঘরটি তার নিজের। পিতার একমাত্র উত্তরাধিকারী তাঁর পুত্র সন্তান। তাই পিতার ঘরটিও তারই জিম্মায়। আমার ঘর কোথায়?
৪. ঘর ছেড়ে চলে আসার পর মহিলা হোস্টেলে উঠবার কথা বহুবার ভেবেছিলাম। কিন্তু কোথাও যে ঘরের প্রতি টান- তা যেন মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি না। মহিলা হোস্টেলের ব্যাচেলর জীবন যেনো কেমন নেংটো নেংটো, উদোম উদোম লাগে। ডাইনিং এ বসে দুবেলা খেয়ে, মুখ আঁচিয়ে শুয়ে পড়া এমন জীবন তো চাই না আমার। দীর্ঘ জীবন যে মানুষ দু‘বেলা কুটনো কুটে, বাটনা বাটে, ঘর সাজায়, টেবিলের কোনায় ফুল তোলে, প্লাস্টিকের বোতল কেটে ফুলের গাছ লাগায় সে মানুষের কি আর অমন হোস্টেলের উদোম জীবন পোষায়! তার দরকার একটি চার দেয়ালের নিজের ঘর, হাঁড়ি পাতিল, মসলা কৌটো, শিল নোড়া, দা বটি। এসব ভেবে এক কামড়ার একটি সাবলেট বাসায় উঠে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম সেপারেশনের পর। বুঝতে পারি নি একা নারীর সমাজে কোনো আশ্রয় নেই। একটি ঘর- যার সমস্ত ব্যয় বহনের সক্ষমতা সেই নারীর আছে, তার জন্যও তাকে স্বামী কিংবা পিতা নয়তো ভাইয়ের মুখাপেক্ষী হতে হয়। একা নারীর কোনো ঠিকানা নেই। নারীর নিজের কোনো ঘর নেই।
লকডাউনে তো নতুন করে কেউ সাবলেট বাসায় থাকতে দেবে না। কয়েকজন বান্ধবীকে বলেছিলাম, তারাও অনুমতি পেলো না স্বামীর কাছে আমায় রাখতে। তাছাড়া একা নারীকে হয়তো সহজে বিশ্বাস করা যায় না। সারাদিনতো অফিসেই কাটিয়ে দিতে পারি, তারপর নিকষ কালো রাতটা আশ্রয়ের জন্য ঘুরে ফিরি- কখনো এর বাসায়, কখনো ওর বাসায়। তার চেয়ে বেশ হোতো আমি যদি আবার ফিরে যেতে পারতাম আমার মাতৃগর্ভের সবুজ আচ্ছাদনে। নিশ্চিন্তে রাতটা কাটিয়ে দিতাম অঘোর ঘুমে। মা, আমাকে ফিরিয়ে নাও তোমার গর্ভে। যে আশ্রয় পিতার নয়, স্বামীর নয়, পুত্রের নয়- আমার নিজের।