আফরোজ ন্যান্সি

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মীরা’রা ভালো থাকুক

ওর নাম মীরা (ছদ্মনাম)। ক্লাশের প্রথমদিন থেকেই মেয়েটিকে আমরা সহজভাবে গ্রহন করতে পারি নি কেননা ও আমাদের রেগুলার ব্যাচের স্টুডেন্ট ছিলো না। সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতেই ওর বিয়ে হয়ে যায় দ্বিগুনেরও বেশী বয়সী এক লোকের সাথে। আমাদের সিনিয়ররা সবাই যখন ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছিলো ও তখন বিয়ের পিড়িতে। পরের সেশনে ও এসে আবার আমাদের ব্যাচে এডমিশন নিলো। 

ওর বর মধ্যপ্রাচ্যে থাকতো। কিছুদিন পর পর দেশে আসতো। একদিন কলেজের গেটে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। লোকটা যেমন কালো, তেমন মোটা আর দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো বয়স হবে চল্লিশের ওপরে। এইরকম একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ের এমন লোকের সঙ্গে বিয়ে হলো কি করে এটা হয়ে গেলো আমাদের আলোচনার নতুন বিষয়! আমাদের এক ছেলে বন্ধু বললো, আরে লোভ ... লোভ ! বুঝিস না! লোকটার অনেক টাকা সেই লোভেই বাপ মা মেয়েকে এর ঘাড়ে ঝুলাইছে।

এরপর থেকে আমরা আড়েঠারে ওর সাথে মজা নেওয়া শুরু করলাম যেন টাকার লোভে বাবা মা যে ওরকম এক লোকের সাথে ওর বিয়ে দিয়েছেন সেই দায় সমস্তটা ওরই।

মীরা পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো। এর কিছুদিন পরেই শুনলাম ওর মেয়ে হয়েছে। বিশ/পচিশ দিন পর ও আবার ক্লাশে আসতে শুরু করলো। যেহেতু ছোট বাচ্চা রেখে সকাল থেকে দুপুর অব্দি প্রায় ৬ ঘন্টা কলেজে থাকতে হতো খুব স্বাভাবিক ভাবেই ব্রেস্টমিল্ক এসে ওর বুকের কাছটায় জামা ভিজে যেতো। আমাদের ক্যান্ট পাবলিকে ড্রেস কোড খুব স্ট্রিকলি মেইন্টেইন করা হতো। প্রথমদিন ও কলেজ ড্রেসের ওপর একটা সাদা স্কার্ফ পরে এসেছিলো কিন্তু সেটা এলাউড হয় নি। তাই চাইলেও ও কলেজ ড্রেসের ওপর বাড়তি কোনো স্কার্ফ ব্যবহার করতে পারে নি যেটা ওর বুকের কাছের ভেজা অংশ আড়াল করতে সাহায্য করতে পারে। কোনো স্কার্ফ না থাকায় ব্যাপারটা সবারই চোখে পরতো। আমরা মেয়েরা ওর পাশে কেউ বসতে চাইতাম না ঘেন্নায়। বুকের কাছে জামা এমনভাবে ভিজে থাকতো আর বুকের দুধের একটা ভ্যাপসা গন্ধ পাওয়া যেতো ওর শরীর থেকে। আমাদের এই বিরক্তি, ঘেন্না আমরা লুকিয়ে রাখারও চেষ্টা করতাম না বরং ওকে বুঝানোর জন্য যতটা বিরক্ত হতাম তার থেকে দেখাতাম বেশি। ও অবশ্য কখনো আমাদের কিছুই বলে নি । কলেজে আসতো, একা একা ক্লাশ করে বাসায় ফিরে যেতো।

সেদিন ক্লাশে আমি মীরার পিছনের ডেস্কে বসেছিলাম। ক্লাশের ফাঁকে খেয়াল করলাম বিপরীত পাশের ডেস্কে বসে আমাদের দুইটা ছেলে বন্ধু ওদের হাতে থাকা এক টুকরো গোল কাঁচ ব্যবহার করে রোদের প্রতিফলন ফেলছে ওর বুকের ভেজা জায়গাটাতে আর দাঁত বের করে হাসছে। ঘটনাটা চোখের সামনে দেখে এতদিন যে ভুল ব্যবহার অন্য সবার মতোন আমিও ওর সাথে করেছি আর আমাদের এমন ব্যাবহারে ওর মনের অবস্থা কি হতে পারে সেটা এক মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারলাম। ভয়ানক রাগে চিৎকার করতে ইচ্ছে করলো কিন্তু তার আগেই দেখলাম মেয়েটা স্যার কে বলে ক্লাশ থেকে বেরিয়ে গেলো। ক্লাশের পরে ওই দুই বন্ধুকে বলার চেষ্টা করলাম যে কাজটা তারা একদমই ঠিক করে নি কিন্তু ওরা হেসেই উড়িয়ে দিলো। এরপর অনেকদিন মীরা আর ক্লাশে আসে নি।

মাতৃত্ব যে কি তখন সেটা না বুঝলেও এত বছর পরে এসে বুঝতে পারি আমরা পুরো এক ক্লাশ ছেলেমেয়ে মিলে দিনের পর দিন কি ভয়ানক মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছি ওকে। মীরার সাথে কলেজের পর আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারি নি। পারলে অন্তত আমার জায়গা থেকে নিশ্চয়ই সরি বলতাম ওকে। 

4134 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।