যখন ঢাকা শহরে আসি তখন থাকবার জায়গা ছিলো না আমার। সেই একেবারে পাটগ্রাম উপজেলা থেকে সোজা ঢাকা। আমার বাবা বর্গা চাষী। বাবা যার জমি চাষ করতেন তার ছোট ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন।
ঠিকানা নিয়ে সোজা তার হলে। আমার জায়গা হলো সূর্যসেন হলের চারতলায় ভাইজানের রুমে। আমি ওনাকে ভাইজান ডাকি। আমাকে দয়া করে ফ্লোরিং করার সুযোগ দেয়া হলো। সারাক্ষণ ভাইজানের ফুট ফরমাশ খাটি। চা নাস্তা এনে দেই।
চা নাস্তা রুমে এনে দেয়া বা রুমে হিটার জ্বালিয়ে খিচুড়ি রান্না করতে আমার বেশ লাগতো। তবে খুব খারাপ লাগতো যখন ভাইজান বলতেন নীলক্ষেত ফার্মেসি থেকে কনডম কিনে আনতে। প্যাকেটটা নিয়ে মাথা নিচু করে ওনার হাতে দিতাম, উনি খ্যাক খ্যাক করে হাসতেন।
: কিরে সফদার নিবি নাকি?
আরো লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতাম।
আমার দিনগুলো ছিলো থমকে থাকা, রাতগুলো ক্লান্তিহীন। ঢাকার সূর্য আমার সাথে পিচঢালা পথে হাঁটতো। কতোদিন ফিরে যাবার চিন্তা করছিলাম আমাদের বাঁধানো গ্রামে, স্মৃতির চোখের ভেসে থাকা অমলিন দিন।
এই ঢাকায় কি কি আছে?
আমার কাছে সবখানে ফাঁকি লাগে। ভাইজানের কাছে কতো ছেলেরা আসতো। বুঝতে পেরেছি উনি বড়মাপের নেতা। ওনার সাথে বেশ ক’জনের কাছে অস্ত্র দেখেছি। বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছে;
: সফদারের বাচ্চা মালটা রাখত বিছানার নিচে।
ক্যাম্পাসে গোলাগুলি হতো, বোমা ফাটতো। ভাইজানের ছোটাছুটি বেড়ে যেতো। একদিন কিছু ছেলে আর্মস নিয়ে রুমে ঢুকে ভাইজানকে খুঁজতে আসে। না পেয়ে আমাকে নর্থ বেঙ্গল মফিজ বলে আচ্ছা মতো পেটালো।
ভেবেছিলাম জানে মেরে ফেলবে। মারলো না। হকি স্টিক আর চ্যালা কাঠ দিয়ে মনের সুখে আমাকে পিটিয়েছে। পরে পুলিশ এসে বহিরাগত বলে চালান করে দিলো।
অনেক খড় কাঠ তুষ পুড়িয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলাম। ভাইজান অনেক টাকা পয়সা খরচ করলো থানা পুলিশ নিয়ে।
ছাড়া পাবার পরদিনই ভাইজান আমাকে খুব সুন্দর দেখতে একটা পিস্তল দিলেন। সূর্যসেন হলের বারান্দায় ভাইজানের এক শিষ্য আমাকে পিস্তল চালানো শেখালেন যত্ন করে। আমার ভালো লাগছে বেশ।
বারান্দা থেকে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে সবাইকে চমকে দিলাম। ওরা সবাই আমার পিঠ চাপড়ে দিলো।
ফ্লোরিং থেকে বিছানায় ট্রান্সফার হলাম। ভাইজান ঢাকা কলেজের আশে পাশের দোকানের বখরা আমাকে ছেড়ে দিলেন। মরণচাঁদের দাদুর দোকানের মিষ্টি আমার জন্য ফ্রি।
ডাসের জসীম ভাই আগে আমাকে নর্থ বেঙ্গলের মফিজ ডাকত, এখন ডাকে সফট। সফদার থেকে সফট। সবাই চেনে আমাকে ভাইজানের ডান হাত, ক্যাম্পাসের সফট।
সেদিন ভাইজান রুমে নেই। মধুর কেন্টিনে মিটিং আছে। হলের দারোয়ান এসে আমাকে চিরকূট দিলো। দেখলাম একটা মেয়ের নাম লেখা। দারোয়ান বললো গেস্ট রুমে অপেক্ষা করছে।
পিস্তলটা পকেটে গুঁজে নিচে গেস্ট রুমে যাই। বিষণ্ণ সুন্দর মতো একটা মেয়ে। চিনতে পারলাম না। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো।
খুব অসহায় আর ভীত লাগছে মেয়েটাকে। আমাকে দেখে হাউমাউ করে উঠলো। চমকে উঠলাম। যা বললো তা হলো;
মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। ভাইজান বলেছে অ্যাবরশান করতে। মেয়েটা মোটেও রাজী হচ্ছে না। মেয়েটা বলেছে ভাইজানকে বিয়ে করতে। ভাইজান বলেছে অ্যাবরশান না করলে মেরে ফেলবে তাকে।
মেয়েটা কাঁদছে, বলছে: সফট ভাই আমাকে বাঁচান।
সিদ্ধান্ত নিতে এক সেকেন্ড দেরি করলাম না। বললাম: চলো।
মেয়েটার হাত ধরেই দৌড় দিলাম। হল থেকে পালাচ্ছি। ঢাকা শহর থেকে পালাচ্ছি। কেউ না জানুক মনেরও তো কষ্ট আছে, সেই বেদনা লুকিয়ে রাখি হাজার ছলনায়। জীবন খাতায় ভুলের হিসাব পাতায় পাতায়...
ট্রেনটা ছুটছে। ছুটুক। মেয়েটা আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।
পকেটে পিস্তলটা ভীষণ ভারী লাগছে। অস্বস্তি লাগছে। আলগোছে পিস্তলটা পকেটে থেকে বের করে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেই।
ট্রেনের জানালা দিয়ে বাংলাদেশের সমস্ত লাবণ্য মেয়েটার মুখে এসে পড়ছে রোদ ছায়ায়।
কী সুন্দর এই মেয়েটা..