বীথি সপ্তর্ষি

সাংবাদিক।

মেয়ে হওয়াটাই একমাত্র যোগ্যতা

বাইরে বাইরে সর্বংসহা একটা ভাব থাকলেও আমি মূলত প্রচণ্ড রকমের সেনসিটিভ মানুষ। রাগ-দু:খ, অভিমান, যন্ত্রণা আমারো হয়। কিন্তু এসব লুকিয়ে, প্রচণ্ড গা ব্যথা, শরীর খারাপ, বিপর্যস্ত মন নিয়ে হাসি হাসি মুখ করে থাকাটাই আমার কর্ম। এখানে একবিন্দু ছাড় নেই কোনো  পক্ষ থেকে। ‘না পারলে চলে যাও, এটা কারো সুবিধা-অসুবিধা দেখার জায়গা নয়’টাই আমার জায়গা।

কাক ডাকা ভোর থেকে ঝিঁঝিঁ ডাকা নিশুতি রাত পর্যন্ত এখানে কেবলই সংগ্রাম। এমনকি একটু ফাঁক বের করে সদ্য প্রেমিকের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চা খেয়ে ফেরার সময় দু’জনের মনেই যখন মাতাল করা সুরের মূর্ছনা বইছে তখনও হঠাৎ করে অনাকাঙ্খিত একটা হাত শরীরে এসে পড়ে। মুহূর্ত ঝড়ে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি বাঁচিয়ে এক টুকরো সুখের অনুভূতিকে ঘিরে ফেলে ছাইরঙা মেঘ। অথচ পাশেই থাকা সঙ্গীটা টেরও পাচ্ছে না হয়তো। টেরই পাচ্ছে না তালটা কেটে গেছে। টেরই পাচ্ছে না একটা অস্বস্তিকর শরীরকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চোখে চোখে কায়দা করে করে নিয়ে হাঁটতে কেমন লাগছে।

ধানমণ্ডি ল্যাব-এইডের সামনে প্রেমিকের হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় খুব বাজেভাবে শরীর ছুঁয়ে দিয়েছিলো উঠতি বয়সের এক ছেলে। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে ছেলেটিকে ধরে ফেলার পর প্রেমিক বললো ‘রাস্তায় ঝামেলা বাড়ানোর দরকার কি? ছেড়ে দাও, এরা অসুস্থ!’ আমি চিৎকার করে বলেছি ‘ছেড়ে দেবো? এরকম একটা ঘটনা ঘটানোর পর ছেড়ে দিয়ে বাকিটা সময় মগজে করে নোংরা-গন্ধ বয়ে বেড়াবো কিন্তু তবুও ছেড়ে দিতে হবে!’ এই যে ছোট ছোট ঘটনাগুলো, হয়তো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। মহাজগতের সাপেক্ষে, পৃথিবীর সাপেক্ষে, দেশ-কালের হিসেবে কোনো ইস্যুই নয়। কিন্তু আমার ভেতরে যা হচ্ছে, তা আমি ছাড়া আর কেউ কি বইবে? জানবে এসব বয়ে বেড়ানোর জন্য কতখানি মানসিক শক্তি লাগে? জানবে কোনদিন কোন হেমলকের পেয়ালা মুখগহ্বরে রেখে ঝলমল করে হেসেছি, ভালোবেসেছি, চুমু খেয়েছি!

অথচ এই মানুষটাই বাবার সাথে রাগ করে ১০ মাস কথা বলি না, ৪ বছর বাড়িতে যাই না। কি ঈদ, কি পুজো, কি বড়দিন, কি পহেলা বৈশাখ সারাবছর একলা একটা বাইরে থেকে তালা বন্ধ ফ্ল্যাটে থাকি। বাইরের এতকিছু সয়ে নিয়ে, ঈদের আগেরদিন একটা সুতি শাড়ি বা একটা ফতুয়া কিনে পুরোটা পথ সেমাই-ফিরনি, পিঠার গন্ধ নিয়ে বাইরে থেকে তালা খুলে জমাট অন্ধকার ভর করে থাকা একটা বাড়িতে ঢুকি। ভেতর থেকে আর সেমাই-ফিরনি, পিঠা-পাপড়ের গন্ধ ভেসে আসে না। কেউ জানে না একটা মানুষ সারাদিন বন্ধ থাকা একটা ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ নিয়ে বাস করে, পরেরদিন আবার অফিস।

মানুষটার ফোনে কোনো ফোন আসে না। একা কেমন আছে? একটার পর একটা উৎসব বছরের পর বছর মানুষটা একলা কাটিয়ে দিচ্ছে, চেহারায় সে ছাপ পড়ে কখনো? এসব ছাপ কখনো পড়তে দিতে হয় না বলে পড়তে দেয় না কখনো। এই যে বাইরে থাকা তালা বন্ধ একটা ঘর, এটাও তার উড়ে আসে নি একদিনে। বাসস্ট্যান্ডে একটা লাল রঙের লাগেজ নিয়ে অনেকগুলো ঘণ্টা মিনিট মানুষটা ভেবেছে, পকেটে থাকা ৩৮০ টাকা নিয়ে কোথায় যাবে সে। চারপাশে অনেক আত্মীয়-স্বজন, কেউ একটা রাত থাকতে দেয় নি। কি ভয়াবহ রাত! চারপাশের সব মানুষ ঘরে যায়, রাস্তায় লোকেদের সংখ্যা কমে। মানুষ হা করে তাকায়, কেনো এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে একটা মেয়ে! হাহ্, নির্জলা কয়েক ঘণ্টা তাই তো? গন্তব্য যখন থাকে না, তখন কয়েক ঘণ্টার হিসেব কিভাবে কষতে হয় কোনো ধারণা আছে আপনাদের!

সেই মেয়েটাই যখন পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সকলের সাথে সম্পর্কের সুতো কেটে একলা হাইওয়েতে এসে দাঁড়ায়, একা বলে হাজার হাজার কামাসিক্ত লোক পোকার মতো শরীরে এসে পড়ে, সেইসব পোকা-মাকড় ঝেড়ে ফেলে একদিন ঠিক ঠিক উঠে দাঁড়ায়, উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটে, হেঁটে হেঁটে একটা পথ খুঁজে নেয়, সে পথে একটা ঘর বানায় তারপর কেউ যখন বলে ‘তুমি মেয়ে এটাই তোমার একমাত্র যোগ্যতা, যা আমি ছেলে বলে আমার নাই’ তখন প্রচণ্ড ঘেন্না হয় চারপাশের পৃথিবীটার ওপর। কেউ যখন বলে ‘তুমি ভাগ্য ভালো না হলে যতটুকু যা অর্জন করেছো, এত কম বয়সে এতখানি কেউ করতে পারে না’ তখন নিজেকে আয়নায় ভেঙ্গে যাওয়া টুকরো টুকরো কাঁচের মতো লাগে। আমরা এই সমাজটা থেকেই উঠে আসি। এই যে আমার একলার একটা পথ, একদম একলার। এই পথে আমার পাশে হাত ধরে কেউ দু’পা হাঁটে নি, এমনকি হাত না ধরেও কেউ হাঁটে নি।

না খেয়ে থেকেও বাবার কাছে ফোন করে বলি নি, আমার কাছে খাওয়ার পয়সা নেই। অথচ লোকে বলে, আরেহ্ মেয়ে বলে পেরেছে। ছেলে হলে কি এত সুযোগ-সুবিধা পেতো নাকি! হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, মেয়ে বলেই আধাঘণ্টা অফিস থেকে আগে বের হতে চাই। এবং সেই আধাঘণ্টা আগে বের হতে চাইলেই জীবনের সকল অর্জন, সংগ্রাম মিথ্যে হয়ে যায়। কারণ যারা সমতার কথা বলে তাদের আধাঘণ্টা কম পড়লে পৃথিবীতে ভয়াবহ অসাম্যের রাজত্ব তৈরি হবে! আধাঘণ্টা দেরিতে বের হলে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়, ভয় লাগে। এই ভয় তো আপনাদের লাগে না, এই ভয় লাগার সুবিধাই তো আমি ভোগ করি তাই না?

আমি যখন খুব পড়াশোনা করে একটা ভাল রেজাল্ট করে একটা মাত্র সাবজেক্টের জন্য একাডেমিক এওয়ার্ড মিস করি, সেটা তো মেয়ে বলেই তাই না? কারণ স্যাররা চান, তাদের রুমে গিয়ে দু’ঘণ্টা অন্তরঙ্গ আলাপ করি। সেই সম্ভাবনার মুখে লাথি মেরে বের হয়ে এসে নিজের কাছে প্রচণ্ড অপরাধী লাগে, শুধু মেয়ে বলে তাই না? প্রতিদিন নতুন নতুন বিয়ের সম্বন্ধ, আমেরিকা-ইউরোপ ফেরত ছেলেদের কথা না শুনে কানে আঙ্গুল দিয়ে বই নিয়ে বসি শুধু তো মেয়ে বলেই তাই না? একবেলা খেতে বসেও বিয়ের চাপে খাবারের টেবিল থেকে উঠে কয়টা টাকা বেশি টাকা স্যালারির চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাই, শুধু তো মেয়ে বলেই তাই না? ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে গায়ের ওড়না ঠিকঠাক করে তটস্থ বসে থেকে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বের হয়ে হতাশ হেঁটে যেতে হয় শুধু মেয়ে বলেই তো না?

আপনারা ঠিকই বলেন। এই দেশে, এই সমাজে মেয়েদের অনেক সুবিধা। ব্যংকে, পাসপোর্ট অফিসে, ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের লাইনে দাঁড়ালে সহজেই সার্ভিস পাওয়া যায়। আপনাদের ঘরের মেয়েরা সেই লাইনে কোনোদিন দাঁড়ান না, তাদের অনেক মান-ইজ্জত। বেহায়া মেয়েরা, যারা একলা বাঁচে, একলা ওড়ে, একলা নিজেকে হাত ধরে এসব বাসে-ব্যংকে এনে লাইনে দাঁড় করায় তাদের কোনো যোগ্যতা নেই বলেই এসব লাইন টিকে থাকে। তাদের একমাত্র যোগ্যতা, তারা মেয়ে। এই মেয়ে হবার একমাত্র যোগ্যতা নিয়ে তারা প্রেগন্যান্সির সময়ও নাইট শিফট অফিস করে, হাঁসফাঁস করতে করতে অফিস দৌড়ায়। এসব আপনাদের করতে হয় না, আপনারা হতভাগা। আপনারা হতভাগ্য যে এই সত্যটা প্রচণ্ড অবসাদ নিয়ে বসে বসে লিখে আপনাদের জানাতে হলো। এরপর থেকে চোখ বন্ধ করে যে কোনো ভাল পজিশনে কোনো মেয়েকে দেখলেই বুঝে নিয়েন, তার একমাত্র যোগ্যতা সে মেয়ে। আপনাদের মতো পুরুষরা লুঙ্গির গিঁট খুলে যখন মাস্টারবেট করেন, মেয়েটা তখন পিরিয়ডের ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে বাসের রড ধরে ঝুলে ঝুলে রাত করে বাসায় ফেরে।

ব্যস, এটুকুই। এরচেয়ে বেশি যোগ্যতা পৃথিবীর কোনো মেয়ের নাই। সেই মেয়েগুলোর একজন আমিও। ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরে ছাই হয়ে ফিনিক্স পাখির মতো আবার উড়ছি। সব ভুলে যাচ্ছি তা কিন্তু নয়। আমরা সর্বংসহা। প্রচণ্ড সর্বংসহা একটা ভাব ধরে প্রচণ্ড রকমের সেনসিটিভ মন নিয়ে আমরা আপনাদের সকল আক্রমণ সয়ে নিতে জানি। আসেন।

1763 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।