চৈতী আহমেদ

প্রধান সম্পাদক, নারী

মেয়ে তুমি বাঁচো আর খুব হাসো কাঁচ ভাঙা হাসি……

দাঁডি টুপি ওয়ালা এক হুজুরের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ায় নীল অপরাজিতা (১৮) নামের একটি মেয়ে শুনলাম আত্মহত্যা করেছে। তাকে তার পরিবার ঘরে আটকে রেখেছিলো। 

নীল অপরাজিতার ফেসবুক ছিলো। সে আমার বন্ধু ছিলো না ফেসবুকে। মিউচুয়াল আছে কয়েকজনই। নীল অপরাজিতা সময়ের সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলো। ওর বয়সে আমি ফেসবুক পাইনি। ও পেয়েছিলো। কিন্তু নীল তার সময়টাকে কাজে লাগাতে পারে নি। ফেসবুকে থেকেও ও যুদ্ধটাকে শেখে নি। তাই ওকে হেরে যেতে হলো! কিন্তু নীল অপরাজিতা যার নাম সে কেনো আত্মহত্যা করবে!

ওর বয়সে আমার জীবনটা এর চেয়েও দুর্বিপাকে কেটেছে। আমার কয়েকবারই দাড়ি টুপির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। আমাকেও অজপাড়াগায়ে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রেখেছিলো আমার স্বজনেরা। আমি লড়াই করেছি। শিকল ছিড়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছি। কারণ আমি জেনে গিয়েছিলাম আমার জীবনটা আমারই!

খুব রাগ হচ্ছে নীল অপরাজিতা উপর! নিজের নামটার প্রতিও সে সুবিচার করতে পারলো না। পরিবার সমাজ সবকিছুকে লাথিতো সে মারলো কিন্তু দেখতে তো পেলো না সেই লাথিতে এই সমাজের মুখ কেমন ভোতা হলো। আদৌ হলো কিনা!

মরে গেলে আসলে কিছুই অর্জন করা যায় না। একটা নারী রাগ করে মরে গেলে এই সব পরিবারের, সমাজের কিছুই আসে যায় না। বরং তারা হাফ ছেড়ে বাঁচে। এই রকম মৃত্যুকে মহিয়ান করার কিছু নেই। সব মেয়েরা ঐপথে মুক্তি খুঁজে নিলে মুশকিল! আমাদের লড়াইটা থেমে যায়। আত্মহত্যায় মৃত্যু পরাজয়েরই নামান্তর। নীল অপরাজিতা আমাদের মতো নারীদের লড়াইটাকে একটু হলেও পিছিয়ে দিয়ে গেছে।

মৃত্যু নয়। জীবনই শুধু মুক্তির পথ দেখাতে পারে। সেই জন্য আমি বলি, মেয়েরা, ছলে, বলে, কৌশলে যেভাবে পারো বাঁচো! আত্মহত্যা হলো জীবন যুদ্ধের মাঠ থেকে পালিয়ে যাওয়া। পরিবার, সমাজ তোমাকে বড় জোর খানকি বেশ্যা বলে গালি দেবে। আমাকেও দিয়েছে। এখনো দেয়। গতকালও দিয়েছে, আজও হয়তো কিছু গালি জমা হবে আমার ফেসবুক একাউন্টে। কি আসে যায়। খানকি, বেশ্যা কিন্তু খুব বড় কোনো গালি নয়। ওগুলো আসলে কোনো গালিই নয়। ঐগুলো একেকটা পেশাজীবীর নাম। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কামার, মুচি, শিক্ষক যেমন। সো সেটা গালি হয় কি করে? বড় গালি হলো চোর, দূর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, বেশ্যার দালাল, এইসব হলো পাওয়ারফুল গালি!

আমার কথা হলো -যে মেয়ে ফেসবুক ব্যবহার করতে জানে সেই মেয়ে কেনো আত্মহত্যা করবে! কেনো সে জীবন থেকে পালিয়ে যাবে? দাঁড়ি, টুপি, আতর বিয়ে না করতে চাও, তোমার অপছন্দের কাউকে বিয়ে না করতে চাও, বেরিয়ে যাও ঐ পরিবার নামের নরকাশ্রম থেকে! কই, যে মেয়েটি লোকের বাড়ি বাড়ি ছুটা কাজ করে খায় সেতো আত্মহত্যার কথা ভাবে না! কারণ সে জীবনের লড়াইটা জানে। সেও জানে জীবনে তার অধিকার আছে। 

ঐ সমাজটাকে আসলে বদলানো দরকার। ঐ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গুমরে গুমরে মরছে নারী, ফালতু সব অহমিকা, মিথ্যে মান অপমানের চোরাপ্যাঁকে পড়ে। বিশেষ করে নারীর জন্য এইগুলো পুরুষতন্ত্রের পরিকল্পিত, শুরু থেকেই চাপিয়ে দেয়া কূটকৌশল। সংসারে অশান্তি, কাউকে জানতে দেয়া যাবে না। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হয়তো কবেই মরে পঁচে গলে গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে তবু একসাথে থাকতে হবে। কারণ মানুষ জানলে কি বলবে? মরা সম্পর্কের গন্ধে দম আটকে মারা যাচ্ছে তার পরও মানুষকে জানতে দেয়া যাবে না! ঐ সমাজের ঘরে ঘরে চলে তাই নিরন্তর সুখের অভিনয়।

যে সমাজে সুখে থাকাটাই বাধ্যবাধকতা। যে সমাজ সুখে না থাকলে বাঁচার অধিকার কেড়ে নেয়। যে সমাজ অপছন্দের পাত্রের গলায় মেয়েকে জোর করে ঝুলিয়ে দেয়। সেই পরিবার, সমাজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রয়োজনে ছুটা বুয়ার কাজ খুঁজে নাও নারী! তবু আত্মহত্যা করো না!

সেদিন, সেদিন যদি আত্মহত্যা করতাম আজ কি এইভাবে জীবন দেখতে পেতাম? দেখতে কি পেতাম -যে নারী আজ দামী গাড়িতে চড়ছে, প্রেমিক স্বামীটি যাকে আজ ঠোটে চুমু খেয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিচ্ছে। বনাবনি না হওয়ায় সেই নারীকেই কাল দেখছি চোখের পানি মুছে ফেলে রাস্তায় ঝাড়ু হাতে অথবা কোনো রেষ্টুরেন্টে পিজার ডো মাখতে মাখতে বাঁচার লড়াইয়ে নেমে যাচ্ছে। জীবন এদের কাছে এতোটাই সহজ! আমার দেশের মেয়েদেরও আমি জীবনের লড়াই লড়ছে দেখতে চাই!

লাশকাটা ঘরে দেখতে চাই না!

কোনো আত্মহত্যা করবে?

একটাই জীবন!

আর সেই জীবনের লড়াইটাই সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য, লড়াই হীন জীবনটাতো পানসে! জীবনের লড়াইটাই লড়তে লড়তে বাঁচো মেয়ে, তুমুল বাঁচো, তুমুল হাসো, হাসো কাঁচ ভাঙা হাসি! তোমার হাসিতেই পিলে চমকে যাক ঘুণে ধরা সমাজ রাষ্ট্রের!

3036 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।