রাবির এক পুরুষ শিক্ষক এবং রামেকের এক নারী ইন্টার্ন চলার পথে ধাক্কা খেলো, ইন্টার্ন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় 'দেখে চলতে পারেন না?' বললেন, এর উত্তর এলো 'ইউ আর কিলিং মাই ফাকিং টাইম', ইন্টার্ন ডাক্তারটি সবিস্ময়ে এর প্রতিবাদ করলেন, উত্তর এলো-- 'ফাক ইউ ফাকিং গার্ল'...এরপর নানাবিধ ঘটনা, অন্য ইন্টার্নরা এসে উক্ত শিক্ষককে ইন্টার্ন ডাক্তারের কাছে সরি বলতে বলায় তিনি অই মেয়েকে 'খেয়ে দেয়ার' ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এরপর তাকে আটকে পিটুনি দেয়া হয়, পিটুনির বিরুদ্ধে তিনি এখনো মামলা করেন নি, কিন্তু রাবির ছাত্ররা গতকাল থেকে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন (প্রস্তুতি এখনো শেষ হয় নি)।
আসুন, পাশের পাড়ার অই মাস্তান ছেলেটার কথা বলি, যে প্রতিদিন আপনার বোন স্কুলে যাওয়ার সময় শিষ বাজায়। একদিন বোনের হাত ধরলো, বাসায় এসে বোনের কান্না, ভাই গিয়ে ব্যাপক উত্তমধ্যম দিয়ে এলো। ব্যাস সব ঠান্ডা।
কিংবা রঞ্জনার কথা মনে আছে? তার উঠতি বয়সের নাছোড়বান্দা প্রেমিকের পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোড়া করে দেয়ার কথা ছিলো দাদাদের। অই মাস্তান কিংবা রঞ্জনার প্রেমিক, বয়স হলো, ভার্সিটির টিচার হলেন, কিন্তু অভ্যাস বদলালো না। নিজের হাসপাতালে ভর্তি মেয়েকে দেখতে এসে বিশেষ পরিস্থিতিতে আরেকজন মেয়েকে 'ফাক করার' অভিপ্রায় প্রকাশ করে ফেললেন।
এরপর সেই মেয়ে ফেসবুকে যখন স্ট্যাটাস দিলো, ভার্সিটির স্টুডেন্টরা ইন্টার্ন মেয়েটির আইডিতে হামলে পড়লো। মেয়েটির ইনবক্স ভেসে গেলো হাজার গালির বন্যায়, প্রায় সবাই গালি শেষ করলো তাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শোয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে (যেমনটি করেছেন তাদের শিক্ষক)।
#মেডিকেলের_মেয়ে শব্দটা গালি হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়ে গেলো। তার দৈহিক সৌন্দর্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের শিক্ষক যদি মেয়েটিকে বিছানায় নিয়ে শোন তবে তা হবে মেয়েটির সৌভাগ্য, এমন মতবাদ এলো।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর যে তত্ত্বটি বেরিয়ে এলো, সেটি হলো অমুক স্যার খুবই অমায়িক, খুব ভালো, খুবই মহান, কিন্তু তিনি ক্লাসে প্রতিটা বাক্য 'ফাক ইউ' দিয়ে শুরু ও শেষ করেন, ক্লাসে মেয়েদের 'বেইবি' ও 'বিচ' বলেই সম্বোধন করেন। যেহেতু তার ছাত্র-ছাত্রীরা এতে অভ্যস্ত, তাই অই ইন্টার্ন ডাক্তারকে 'ফাক ইউ' বলা এমন কোনো বিরাট অপরাধ না!
সেদিন হাসপাতালে ভ্রমনের নিয়মকানুন শিরোনাম দিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, এখন মনে হচ্ছে তাতে এডিট করে 'সামাজিক ভাষা ব্যবহার' জাতীয় একটা প্যারা লেখা উচিৎ ছিলো। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যদি কোনো ব্যক্তির উপর তার-ই কর্মক্ষেত্রে অশালীন ভাষা ব্যবহার করেন এবং সেটিকে স্বাভাবিক মনে করেন, তবে জেনে রাখুন শিক্ষা আপনার জীবিকার উপকরণ হয়েছে শুধু, আদতে আপনি ভীষণভাবে অ-শিক্ষিত।
কর্মক্ষেত্রে নারীরা কতটা অনিরাপদ তা এই একটা ঘটনা দিয়ে বিচার করা যায়।
একজন বাসার বুয়া, একজন গার্মেন্টসকর্মী, একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিভিন্ন অধিদপ্তর-অফিস-আদালতে-কর্মরত নারী, ট্যালি করে দেখুন সবার কি বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে অফিস-হ্যারেশমেন্ট নিয়ে।
একজন কর্মজীবী মহিলা বাসে যাত্রী হিসেবে প্রতিদিন কিসের মধ্যে দিয়ে যান সে বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। মেন্টাল এসল্ট, ভার্বাল এসল্ট, ফিজিকাল এসল্ট--কতভাবেই না নিগৃহীত হতে হয় মেয়েদের।
এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু এসবের কোনো বিচার হয় না। যে ছাত্ররা আজ তাদের শিক্ষক ইভ টিজিং করার পরেও তার পক্ষে কথা বলেন, এরাই আবার ব্যক্তিজীবনে একেকজন রঞ্জনাদের দাদা, সন্দেহ নেই! অথচ ইন্টার্ন মেয়েটি ও তার সহপাঠীদের কাছে রঞ্জনার মতই, সেটা আবার তারা বেমালুম ভুলে গেছে!
মার খেতে খেতে, অসম্মানিত হতে হতে, কালো ব্যাজ-মানববন্ধন আর দুই মিনিটের নিরবতাকেন্দ্রিক এই মেরুদণ্ডহীন সমাজের সম্মান বলে যা কিছু আছে তার ইজারা দেয়া আছে অই ইন্টার্ন বাচ্চাগুলোরই। এরা একটা ইভটিজারের শিক্ষক পরিচয় জেনেও যে দমে যায় নি, দু’ঘা বসিয়ে তারপরে কথা বলেছে, এর জন্য আমি অন্তত তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
এই মারের ঘটনা আর দশটা ডাক্তারের বুকে সাহস আনুক, এর পরের বার হাসপাতালে এসে কোনো নারী ডাক্তারকে কেউ 'ফাক ইউ' বলে গালি দিলে তার জিহবা টেনে ছিড়ে ফেলার সম্ভাবণা তৈরি হয়ে থাক।
যারা আইনের কথা বলবেন, তারা কর্মক্ষেত্রে কেনো নারী ভার্বাল এসল্টের শিকার হবেন সেই হিসাবটুকু আগে বুঝিয়ে দিন আমাকে। রাস্তায় আমি যখন বের হই, আমার মানসিক প্রস্তুতি থাকে যে আমার গায়ে কেউ ইচ্ছাকৃত হাত দিলে আগে আমি সেই হাত ধরে মচকে দিয়ে তারপরে কথা বলবো।
আপনারা যারা 'আচ্ছা হোক হোক, যা হয়েছে হয়ে গেছে' বলে ব্যাপারটা ভুলে যেতে বলেন তারাই আদতে নারীদের কর্মক্ষেত্রে নিগৃহীত হওয়াকে প্রচ্ছন্ন মদদ দেন, সে আপনি স্বীকার করেন আর না-ই করেন।