ক’দিন ধরেই অনেকের “মি টু” নিয়ে অনেক লেখা পড়ছি। কিছু কিছু ঘটনা খুব সাধারণ অভিজ্ঞতা হলেও অনেকগুলি ঘটনা খুবই কষ্টদায়ক। এত এত বাজে ঘটনা মেয়েদের সাথে প্রতিনিয়ত ঘটে যায় যা মাঝে মাঝেই আমার কাছে ব্যাখ্যাতীত বলেই মনে হয়। ব্যাখ্যাতীত মনে হবার কারণ হলো, পুরুষ হলেই কি নারীদের সাথে এইরকম অমানবিকতা আর নিষ্ঠুরতা করার অধিকার প্রকৃতি তাদের দিয়েছে? কিন্তু মনে হওয়া দিয়ে কিন্তু ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলি থেমে থাকে না। বরং নোংরামির দিক থেকে পুরুষেরা কতটা কদর্য তা নিত্য নতুনরুপে প্রকাশ পাচ্ছে। দুঃখিত নই আমি এভাবে বলার জন্য। প্রতিদিন যে পরিমাণ নোংরামির কাহিনী এক এক করে পড়ছি, আমি নিজেই শংকিত আমার বেড়ে উঠা ছেলে বাচ্চাটা নিয়ে। কাল যদি সে কোনো মেয়ের সাথে অসদাচরণ করে, সবার আগে তার শাস্তি নিশ্চিত করবো এই আমি। তবে কথা কিন্তু এটা না। কথা হচ্ছে আমি কিভাবে তাকে বড় করে তুলছি সেটা। এই একবিংশ শতাব্দীতে অনেক পরিবারে নিজের চোখে দেখেছি ছেলে আর মেয়ে বাচ্চার মাঝে স্পষ্ট বিভাজন করতে।
যে পরিবার বাচ্চাদের নিজেরাই শেখাচ্ছে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সম্মান কম, মেয়েরা সর্বদাই ছেলেদের অধিনস্ত; সেসব পরিবারের ছেলেগুলিই ঘরের বাইরে মেয়েদের সাবলীল চলাফেরা কিংবা পুরুষের সমকক্ষ হয়ে নারীর সাফল্য মেনে নিতে পারে না কিছুতেই। এটা সমাজের ধনী, মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। অবদমন করার মানসিক চাপ থেকেই নিপীড়ন করার মানসিকতা তৈরি হয়ে যায় তাদের মাঝে, তারা চায় কিংবা না চায়। তাইতো এখন সমাজের সর্বস্তরে আমরা এর প্রতিফলন দেখছি আর সেই সাথে দেখছি এর ভয়াবহ রুপ। মহিলাটি ইট ভাঙ্গুক কিংবা কর্পোরেট জব করুক, পুরুষের বিরুপ আচরণের শিকার তাকে হতে হয় প্রতিনিয়ত। এই পুরুষটি হয়তো তার স্বামী, ভাই, বাবা, বস, সহকর্মী অথবা তার আসা যাওয়ার পথের কেউ, নয়ত ওঁত পেতে থাকা তার কাছের সুযোগ সন্ধানী যে কেউ। আজ তো একথা বললে কেউ আঁতকে উঠবেন না যে, বাবাদের কাছেও কখন সখনো তার কন্যা শিশুটি নিরাপদ নয় (সব বাবার কথা বলছি না)। পৃথিবীতে যে বুকটি সবচেয়ে নির্ভরতার হবার কথা ছিলো মেয়েটার জন্য, সেটাও আজ একশ্রেণির পিশাচের জন্য কলঙ্কিত।
আমার যখন ছেলে হলো একটু মন খারাপ হয়েছিলো কেনো মেয়ে হলো না এই ভেবে। আমি এটা বলায় অনেকেই তখন বকত, আবার কেউ কেউ বলত ন্যাকামি করছি। কিন্তু আমার বাসার সবাই জানে আমার মেয়ে বাচ্চা প্রীতি। আমার ছেলেটাকে তার বছর দুই পর্যন্ত আমি মেয়ে বাচ্চাদের কাপড় পরাতাম প্রায়। এক পর্যায়ে আমার মা বিরক্ত হয়ে আমাকে অনেক বকা-ঝকা করার পর আমি মেয়েদের কাপড় পরানো ছাড়ি ওকে। মা আমাকে ভয় দেখাতো সে সময়, ওর স্বভাব মেয়েলি হয়ে যাবে তখন বুঝবি। আজো শপিং এ যাই যখন, মেয়েবাচ্চাদের কাপড় দেখলেই দাঁড়িয়ে যাই, নেড়েচেড়ে দেখি, মনটা উদাস হয় হালকা। এই কথাগুলি বলার কারণ হলো, আমাদের বাসায়, ছেলে বাচ্চা-মেয়ে বাচ্চা এইসব বিভাজন করতে কোনোদিন দেখিনি, তাই শিখিনিও। আমি চাই আমার বাচ্চাটা মানুষ হোক আগে, পরে সে পুরুষ হোক। আর গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি, মেয়ে হয়নি ভালোই হয়েছে। এই নারী লোভী সমাজে আমি কি ওকে রক্ষা করতে পারতাম!
যেই “মি টু” নিয়ে এত কথার ফুলঝুরি, সেই কথার সুত্র ধরে আমার ছেলেবেলায় যেতে চাই। শুরু করি স্কুল দিয়ে। ফাইভ পর্যন্ত ছেলেদের সাথে কম্বাইন্ড স্কুলে পড়ার পর, ক্লাস সিক্সে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম গার্লস স্কুলে। আগের পরিচিত অনেক বন্ধুদের সাথে নতুন অনেক বন্ধুও জুটে গেলো। আমাকে একটু পাত্তা দিলেই বন্ধু হতে সময় লাগতো না। দেখা গেলো বেশ ভালো একটা গ্রুপ হয়ে গেলো আমাদের। এই আমরা বলতে, সেই গ্রুপের সবাই ছিলাম টম বয় টাইপ। যাকে বলে মেয়েজনিত কোনো আচরণ আমাদের না ছিলো স্বভাবে, না ছিল চরিত্রে। শরীরেও আমরা তেমন বাড়ন্ত ছিলাম না, যদিও আমরা বেশ ক’জন লম্বা আর লিকলিকে হ্যাঙলা ছিলাম। স্কুলে হাইস্কুলে পায়জামা পড়া অনেকটা বাধ্যতামূলক ছিলো, কিন্তু আমরা বেশ কয়জন স্কুলের ব্যাগের মাঝে সেটা নিয়ে যেতাম আর ইসলামিয়াত ক্লাসের আগে পরে নিতাম, নইলে ইসলামিয়াত স্যারের বেতের বারি সব আমাদের পায়ের জন্য নির্ধারিত ছিলো। এভাবে সেভেন কিংবা এইট হবে তখন। সেসময় আমাদের সাথে বেশ কিছু বড় বড় মেয়ে পড়তো। এরা আকারে এবং বয়সে আমাদের অনেক বড় ছিলো। সবসময় পেছনের বেঞ্চে বসতো আর সারাক্ষণ কি কি বলে খুব হাসাহাসি করত। মাঝে মাঝে আমাদের ডেকে জিজ্ঞেস করতো আমাদের পিরিয়ড হয়েছে কিনা। না বললে বিচিত্রভাবে তাকাতো আর বলতো মিথ্যা বলছি। খুব রাগ লাগতো আমাদের, কারণ পিরিয়ড ব্যাপারটা নিয়ে তখন ভাসা ভাসা জানতাম আর আমাদের সাথের কারও হয়নি বলে আইডিয়াও ক্লিয়ার ছিলো না এই নিয়ে। যাই হোক, ঘটনা এই মেয়েদের আর ইসলামিয়াত স্যার কে নিয়ে। স্যারের ব্যাপক আগ্রহ ছিলো এই মেয়েদের নিয়েই। পড়া ধরলেই দাঁড়িয়ে থাকতো শেষের বেঞ্চে। স্যার এদের কখনও বেঞ্চের উপরেও দাঁড় করিয়ে রাখতো। আমরা সেসময় স্যারের হাতের লম্বা বেতটাকে খুব ভয় পেতাম। খুব দুষ্টু ছিলাম বলে পড়া পারলেও মাঝে মাঝে বারি খাওয়া লাগত। কিন্তু অবাক ব্যাপার ছিলো ওদের মারতো না স্যার। এক বিশেষ কায়দায় ওদের পিঠে বা কোমরে হাত বুলাত স্যার। মাঝে মাঝে ধপাস করে ওদের উরুতেও চাপড় দিতো। মেয়েগুলিকে দেখতাম ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকতে পুরা ক্লাস। আমাদের পড়া ধরার ফাঁকে ফাঁকেই পিছনে গিয়ে ওদের পিঠ ধরতো স্যার।
এই স্যারের কাছে আবার অনেকেই প্রাইভেট পড়তে যেত সেসময় স্কুল ছুটির পর। প্রায় মেয়েগুলি এসে বলতো স্যার নাকি গায়ে হাত দেয়। সেই বয়সে আসলেই বুঝতাম না গায়ে হাত দেয়া কি? কেনো দেয়? দিলে কি হয়? কিন্তু আজ যখন একের পর এক মেয়েদের অভিজ্ঞতা পড়ছি, নিজের অজান্তেই শিউরে উঠছি ভয়ে, কি ভয়ংকর অভিজ্ঞতার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম আমরা সেই ছেলেবেলাতে। এর কারণ ছিলো আমার কড়া স্বভাবের মা। কখনো কারো বাসায় একা যেতে দেয়নি। শুনতে অবাক শুনালেও সত্যি যে আমাদের দাদার কিংবা নানার বাড়িতেও একা যেতে কিংবা থাকতে দিত না। কখনও কোনো অনুষ্ঠানের দোহাই দিয়ে বাইরে রাত কাটাতে পারিনি। প্রাইভেট টিচার পড়াতে এলে দূরত্ব রেখে বসে থাকতেন। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু চলে গেলো চকরিয়া, তখন টেনে পড়ি। আমাদের বন্ধুত্ব ছিলো সেই মায়ের পেট থেকে পরার পর হতেই। তো সে কিন্তু বার কয়েক আমাদের বাসায় এসে বেড়িয়ে গেছেও চকরিয়া যাবার পর। কিন্তু একদিনের জন্যও আমার মা জননীকে রাজী করাতে পারেনি আমাকে নিয়ে যেতে ওদের বাড়ি। সেই আমি ওদের বাড়ি গিয়েছি নিজ উদ্যোগে দুই-বছর আগে। মাকে তখন মনে হদো পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর মহিলা। কত যে কাঁদতাম। অনেক সময় রাগে না খেয়েও থেকেছি। কিন্তু যেটা ‘না’ ছিলো, সেটা কিছুতেই ‘হ্যাঁ’ করাতে পারিনি। আজ এতদিন পর বুঝতে পারি, কতটা ভালো করেছিলেন আমাদের। আর সেজন্য অন্তর থেকেই কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি। এত কথা বলার মূল উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো মেয়ে বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তার বাবা-মা। আর সবচেয়ে জরুরী ভূমিকা নিতে পারে তার মা। একটু সতর্কতা অনেক অঘটন রোধ করতে পারে অনায়েসেই। বাচ্চার কথা মন দিয়ে শুনুন, তাকে বিশ্বাস করতে শিখুন। সে যদি কোনো ব্যাপারে নেগেটিভ মনোভাব পোষণ করে, কারণটা খুঁজে বের করুন। কারো ব্যাপারে অভিযোগ করলে ভরসা করুন বাচ্চার উপর আর সেটার সত্যিটা উদঘাটন করুন। সাহসী হোন প্রতিবাদে। বাচ্চার সাথে ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া বেশির ঘটনা ঘটায় কাছের মানুষেরা। সুতরাং সাবধান হোন এইসব সুযোগ সন্ধানীদের থেকে যাতে আমাদের রেখে যাওয়া প্রজন্মের আর কাউকে কখনওই হ্যাস ট্যাগ দিয়ে লিখতে না হয়, “মি টু”।