সাদিয়া নাসরিন

লেখক ও এক্টিভিস্ট

মাতৃত্বেই নারীর স্বার্থকতা : আরও একটি পুরুষতান্ত্রিক চাল

মাতৃত্বেই নারীর স্বার্থকতা! নারী প্রধানমন্ত্রী হোক, স্পিকার হোক, বৈমানিক, স্থপতি, ডাক্তার, সুইপার, সেনাপ্রধান হোক, রাজনীতিবিদ হোক, কুটনৈতিক হোক, কোনো কিছুতেই তার পুর্ণতা নেই! কেবল সন্তান জন্ম দিলেই, মা হলেই নারী পূর্ণ হয়!

হা! পুরুষতান্ত্রিক প্রতারনার সবচেয়ে মধুর দিক হলো পুর্ণতা আর মহত্বের এই মিথ (মধু হই হই বিষ খাওয়াই দেওয়া আর কি)। একবার ভাবুনতো, মাতৃত্বেই যদি নারী স্বার্থক হয়, পূর্ণতা পায়, মহিমান্বিত হয়, তবে মা তার নয় মাস গর্ভে ধারন করা সন্তানের অভিবাবকত্বের অধিকার পায় না কেনো? যে মাতৃত্ব এতো মহান, সে মহত্ব তো মায়ের একার পরিচয়ে তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে, ঔরসদাতার পরিচয় না মিললেই মাতৃত্বের মহত্ব ঘৃণায় রুপ নেয় কেনো?

কারণ, মূল রাজনীতিটা এখানেই। যেদিন থেকে গর্ভধারন ও স্তন্যদানের সাথে নারীর কাঁধে তুলে দেয়া হয়েছে সন্তান পালনের একচ্ছত্র দায়, সেই দিন থেকে স্বাধীন উৎপাদনশীলতা থেকে পিছিয়ে গিয়ে নারী বন্দী হয়েছে হেরেম বা অন্তঃপুর নামক প্রাইভেট ডোমেইন এ। তার নাম পরিবার, যার চালক পুরুষ।

পুরুষ সেই সুযোগে ‘নারীরা মায়ের জাত’ ‘মাতৃত্বেই নারীর স্বার্থকতা', 'মাতৃত্বেই পূর্ণতা' এসব মিথ তৈরি করে তাতে মহিমার লেভেল লাগিয়ে নারীকে প্রসব ও সন্তান পালনে ব্যস্ত রেখে উৎপাদন ও অর্থনীতির চাবি করায়ত্ত করে নিলো। আর নারী যৌনতা-মাতৃত্ব- গৃহকর্মে জড়িয়ে পড়ে ক্রমশ ভাত কাপড়ের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়লো পুরুষের উপর।

এখানে সন্তান জন্মদান এর সাথে সামাজিক ভাবে নির্মিত মাতৃত্বের ভুমিকাকে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। সন্তান ধারন ও জন্মদানের জন্য নারীর জরায়ু আছে, কেবল এটুকুই ‘মা’ হওয়ার জন্য নারীর জৈবিক যোগ্যতা, যা পুরুষের নেই। এর বাইরে আর যে সব দায়িত্ব পালনের জন্য মাতৃত্বকে মহান করা হয়েছে তার সবটুকুই পুরুষতন্ত্রের চাল।

যদি একজন নারী সন্তান লালন পালন করে মা হয়ে উঠতে পারে, তবে একজন পুরুষ ও নিশ্চয় পারে। কারণ সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য বা পালন করার জন্য তো আর জরায়ুর প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে প্রচুর সিংগল ফাদার আছেন, যারা পূর্ণ মমতা আর যত্নেই সন্তান প্রতিপালন করছেন।

এই পৃথীবির যা কিছু মহান, গর্বের, বীরত্বের, শৌর্যের তার সব কিছুই পুরুষ নিজের কব্জায় নিয়েছে। কিন্তু মাতৃত্বের মতো এতো সুবাসিত, মহিমান্বিত, প্রশংশিত একটা কাজে কেনো একা নারীকে কর্তৃত্ব করতে দিলো?

চলুন তবে, আমরাও পুরুষের মতো উদার হই। সন্তান পালনে এতো যে মহত্ব, সর্বংসহা হওয়াতে, নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াতে এতো যে গৌরব, নিঃস্বার্থভাবে আমরা পুরুষকে এই মহিমা আর গৌরবের ভাগ দিতে চাই। পুরুষও মাতৃত্বের গুন অর্জন করে মহান হোক।

পিতৃত্বেই পুরুষ স্বার্থক হোক তবে। 

3076 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।