গতবছরই তো! তারানা হালিম যখন ফেসবুক আবার চালু করলেন, মানে বন্ধ থেকে খুলে দিলেন! তখন একটা স্ট্যাটাস খুব বেশি ভাইরাল হয়ে গেলো, “তারানা হালিম খুলে দিলেন”। ভদ্র, শিক্ষিত, পরিপাটি, ভালো চাকরি করা মানুষগুলো কিছু না ভেবেই (কিংবা ভেবেই) এই স্ট্যাটাসটা দিচ্ছিলো। আমার এক কলিগ ভাইয়া তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, “ধরো! আজকে আসাদুজ্জামান নুর যদি তারানা হালিমের জায়গায় থাকতো তুমি কি এটা লিখে এতো মজা পেতে?”
অনেকদিন ধরে একটা joke চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে অনেকের কমেন্টে দেখতে পাই। “তুমিও এটা করছো, আর সানি লিয়নও ভার্জিন”। অর্থাৎ তুমি এটা করেছো এটা যেমন বিশ্বাসযোগ্য না! তেমনি সানি লিওনের ভার্জিন হওয়াটা বিশ্বাসযোগ্য না। সানি লিওনের জায়গায় বিশ্বের নামকরা ছেলে পর্ণস্টারের সংখ্যা কম না। আমাদের দেশে এরশাদ কাকুও আছেন যিনি এই জোকের পার্ট হতে পারেন। বনানীর সেই “পোলা তো নয় আগুনের গোলা” ধর্ষক নাইমও হতে পারেন পার্ট। কিন্তু তবুও হয় সানি লিওন নয় নাইলা নাইম আসবে এই জোকে। নাহলে কেউ মজা পাবে না।
মেয়ের ভার্জিনিটি (পড়ুন একগামি থাকা) সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাষ্ট্রের কাছে একটা বড় ফ্যাক্ট। পুরুষেরটা না সেটা। এবং এখনো! হ্যাঁ এখনো। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ে করাটা “কে দেখবে ওকে” বলা হলেও, স্বামীর মৃত্যুর পর নারীর দ্বিতীয় বিয়ে করাটা “এখনো এত লাগে” প্রসঙ্গ আসবেই। পরিশীলিতভাবে আসবে বা রাগের মাথায় আসবে। কিন্তু আসবে।
আমার মায়ের সাথে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। আমি মাকে মজা করেই বলি, “তুমি যদি মারা যাও, বাবাকে বিয়ে দেব একটা”। মা ও মজা করে বলে, “হ্যাঁ দিও! তোমার বাবার যত্ন আত্তি লাগবে”। আমি যখন বলি, “আর যদি বাবা আগে যায়, তবে তোমাকে দিব”। পুরোটাই মজার আবহ। কিন্তু মা সে মজার কনভার্সেশনের মধ্যেও বলতে পারে না, বলে “ছি! ছি! কি বল। কয় পুরুষের কাছে যাবো?” ।
এই মজার কথাবার্তাটা আমি করি মায়ের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টা বোঝার জন্য। আচ্ছা আমরাই বা ক’জন, আমাদের মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ দিতে পারার সাহস রাখি বাবার মৃত্যুর পর! ভাবনাটা এখানেও। কেনো এইগুলো এত গুরুত্ব বহন করে তা বলছি!
আমি রাত আটটায় একটু অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যাব বলে একদিন এক আন্টি তার ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেকে আমার সঙ্গে যেতে বললেন। “মা একা যাবে কি করে? বাপ্পি যাক তোমার সঙ্গে”। আমি হতবাক। অনার্স শেষ করে, জব করছি, ২৪ বছর বয়সী (এখন ২৫) এক মেয়ের পাঁচ মিনিটের রাস্তা চলার জন্য অভিভাবক হবে ১০ বছর বয়সী এক ছোট্ট বালক! এই চিন্তা কেনো তৈরি হয়েছে! আমরাই বা কেনো মেনে নিয়েছি এই সিস্টেম!
কারণ আমরা মনে মনে চিন্তা করে রেখেছি মেয়েদের শরীর মহার্ঘ্য জিনিস। এটা যেকোনো শর্তে পবিত্র রাখতেই হবে। আর এই মনস্তত্ত্ব থেকেই আসে, যদি কোনো মেয়েকে অপমান করা যায় তাহলে তার শরীর কে নিয়েই অপমান করা যাবে।
তাই তারানা হালিম কিংবা সানি লিওনকে নিয়ে করা ছোট্ট ঠাট্টা আসলে কেবলই এক ঝলক আনন্দের রসদ নয়। দীর্ঘদিন ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর শরীরকে এমন এক আসনে বসিয়ে রেখেছে, যে ভাবা হয় এই শরীর যেমন ঢেকে রাখলে নারী পবিত্র থাকে! এই শরীরকে নিয়ে নোংরা বক্তব্য করলে নারীকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়। তাই তারানা হালিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তার শরীরকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল সেদিন।
আচ্ছা সেক্সিস্ট জোক করলে সমস্যা কি! নারীর শরীর নিয়ে একটু ডাবল মিনিং করলে সমস্যা কি! কিছুই না আসলে। এই যেমন যারা রাস্তায় চলতে নারীর বুকে গুঁতা দেয় তাদের কাছে সেটা কিছুই না! আবার, শর্ট ড্রেস পড়া মেয়েকে দেখলে মাথা থেকে যত ধরণের অশ্লীল শব্দ বের হয় তা যখন তারা ছোড়ে সেটাও কিছু না! রুপা প্রারামাণিক ভোরে কর্মস্থল যাবার সময় বাস চালকেরা যখন ধর্ষণ করে সেটাও তো কিছু না। ধর্ষণে সমস্যা কি! তাই না?
আপনি হয়তো জানেনই না, যতবার আপনি “তারানা হালিম খুলে দিল” টাইপ সেক্সিস্ট জোক লিখছেন, হাসছেন, ততবারই আপনার ধর্ষকাম মানসিকতা দানা বাঁধছে আপনারই মস্তিষ্কে। ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন।