ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

প্রিজনার অব তেহরানঃ মারিনা নিমাতের নির্মম উপাখ্যান-পর্ব ৩

১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে গ্রেফতার করা হয় মারিনাকে। মাত্র ষোলো বছর বয়স তখন তার।

মারিনার এই গ্রেফতার কোনো আকস্মিক কিংবা অপ্রত্যাশিত ছিলো না। তার স্কুল বন্ধু সারাহ, গীতা এবং সারাহ-র ভাই সাইরাসকে এর মধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করে তাদেরকে কুখ্যাত এভিন জেলে ভরে দেওয়া হয়েছে। এভিন জেলখানা শাহের আমল থেকে রাজনৈতিক জেলখানা হিসাবে বিবেচিত ছিলো। রাজনীতির বিরুদ্ধ পক্ষের লোকদের ধরে  এনে এখানে পুরে দেওয়া হতো। শাহ বিতাড়িত হবার পরে, নতুন ক্ষমতাশালীরা শাহের এই উত্তরাধিকারকে নিজেদের বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলো। সারাহ সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো না। তবে, সাইরাস মুজাহেদিন এ খালগ পার্টির সদস্য ছিলো। মুজাহেদিন পার্টিটা বামপন্থীদের সংগঠন ছিলো। আর গীতা ছিলো আরেক  বামপন্থী দল ফাদায়িয়ান এ খালগ  এর সদস্য। সারাহ রাজনীতি না করলেও বামপন্থার সমর্থক ছিলো। বামপন্থীরা আয়াতুল্লাহ খোমেনী দৃশ্যপটে আসার আগে, সেই ষাটের দশক থেকে শাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিলো। এভিনের কারাগার এদের কর্মীদের দিয়েই বোঝাই ছিলো। শাহের পতনের পর ইসলামি বিপ্লব ঘটে যায়। শাহের পতন ঘটে, কিন্তু ক্ষমতায় এসে যায় আয়াতুল্লাহ খোমেনী। ক্ষমতায় এসে খোমেনী তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে থাকে। বামপন্থীরা আয়াতুল্লাহ খোমেনীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধাচরণ করে এবং তাকে স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।    

বিপ্লবের পরে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত কিছুটা হলেও বাক-স্বাধীনতা ছিলো। বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পত্র-পত্রিকা বিনা বাধাতেই স্কুলে বিক্রি করতে পারতো। বিরতির সময় মাঠে জড়ো হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনৈতিক আলোচনা করতো। শাহের সময়ে বামপন্থীরা নিষিদ্ধ ছিলো। এই বিপ্লবের অংশীদার হবার সুযোগে প্রকাশ্যে আসার সুযোগ হয়ে যায় তাদের।  তবে, কারো কারো ধারণা হচ্ছে, এই সুযোগটা খোমেনীর লোকেরা ইচ্ছা করেই দিয়েছিলো। কার কী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা চিহ্নিত করার জন্য এই কাজটা করা হয়েছিলো। ইসলামি গার্ডের সদস্যরা প্রত্যেকের তালিকা তৈরি করেছে তখন সংগোপনে।

ইরানের পরিবর্তন শুরু হলো ধীরে ধীরে। নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হলো। বোরকা কিংবা চাদর ছাড়া মেয়েদের বাইরে যাওয়া  বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইসলামিক সরকারের যারা বিরোধিতা কিংবা সমালোচনা করছিলো, সবাইকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। টাই পরা, কোলন, পারফিউম, মেক আপ কিংবা নেইল পালিশ ব্যবহার করাকে শয়তানি কাজকর্ম বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। এর জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো।

মারিনাদের স্কুলেও এই পরিবর্তনের ছাপ এসে পড়লো। শুধু প্রিন্সিপ্যাল না, একের পর এক শিক্ষকের পরিবর্তন হতে লাগলো। স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সরিয়ে দিয়ে অনভিজ্ঞ তরুণীরা সে জায়গাগুলো দখল করে নিতে শুরু করলো। এরা ছিলো ফ্যানাটিক, ইসলামিক রিভোলুশনারি গার্ডের সদস্য। কারোরই শিক্ষকতার কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না, ছিলো না কোনো যোগ্যতাও। প্রতিদিন ক্লাসের আগে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত করা হতো এবং সেখানে আমেরিকা নিপাত যাক, ইজরায়েল নিপাত যাক, এই শ্লোগান দেওয়ানো হতো।

ইসলামিক রিভোলুশনারি গার্ডের এইসব সদস্যদের যেহেতু কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিলো না এবং শিক্ষা প্রদানের কোনো অভিজ্ঞতাও ছিলো না, ফলে ক্লাসরুমে এরা শিক্ষার বাইরে অন্য বিষয় নিয়েই বেশি আলোচনা করতে আগ্রহী ছিলো। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলতে এরা খুবই পছন্দ করতো। একদিন ক্যালকুলাস ক্লাসে এমনই ঘটনা ঘটছিলো। ক্যালকুলাস পড়ানোর বদলে অযোগ্য এই শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এর প্রতিবাদে হাত তুলে বসে মারিনা।

বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ শিক্ষক জিজ্ঞেস করেন মারিনা কী বলতে চায়?

“আমি রুঢ় আচরণ করতে চাই না মিস। আপনি কি আমাদের মূল বিষয়ে পড়াবেন দয়া করে?”

মারিনার এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিলেন তার শিক্ষক। ভ্রু কুঁচকে তিনি বললেন, “আমি যা পড়াচ্ছি, তা যদি তোমার পছন্দ না হয় তবে তুমি ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে পারো।”

মারিনা তার বই খাতা জড়ো করে সত্যি সত্যিই ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে বের হতেই সে টের পায় ক্লাসের প্রায় সব ছাত্র-ছাত্রীই ক্যালকুলাস ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে আসছে।

লাঞ্চ  পিরিয়ড আসতে আসতে পুরো স্কুলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেলো। মারিনা ধর্মঘট শুরু করেছে, সারা স্কুলে এই কথা ছড়িয়ে গেলো। লাঞ্চের পরের প্রায় সব ক্লাসই বন্ধ হয়ে গেলো ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে। এদের সবাই এসে জড়ো হয়েছে স্কুলের মাঠে। প্রিন্সিপ্যাল খানম মাহমুদী লাউড স্পিকার নিয়ে এসে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে যাবার জন্য নির্দেশ দিলেন। তাদের বাবা-মাকে ডেকে আনবেন, এই ভয়ও দেখালেন। কিন্তু, কোনো কিছুতেই কাজ হলো না। ছাত্র-ছাত্রীদের বহিষ্কার করার হুমকি দিলেন তিনি। এর উত্তরে তারা বললো, করেন বহিষ্কার, কোনো সমস্যা নেই। মারিনা এবং আরো দুজন স্টুডেন্টকে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ দিলো প্রিন্সিপ্যালের সাথে কথা বলার জন্য। এরা প্রিন্সিপ্যালকে জানিয়ে দিলো, তারা ক্লাসে ফিরবে শুধুমাত্র এই শর্তে যে শিক্ষকরা ক্লাসে বিষয়ের বাইরে অন্য কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করবেন না।

দুই দিন ধরে ধর্মঘট চলতে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে আসে, মাঠে জমা হয়, কিন্তু ক্লাসে যায় না। তৃতীয় দিনে খানম মাহমুদী ছাত্র প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠালেন তাঁর রুমে। আলোচনার জন্য নয়, রাগে লাল হওয়া চেহারা নিয়ে তিনি শেষ হুমকিটা দিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের। তারা যদি ক্লাসে না ফেরে তবে রিভোলুশনারি গার্ডকে স্কুলে আনা ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় থাকবে না বলে তিনি জানিয়ে দেন। তারা আসার পরে বাকিটা তারাই বুঝবে, এটাও জানাতে ভোলেন না তিনি। তিনি আরো বলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। ক্লাসে ফেরার জন্য এক ঘণ্টা সময় দেন তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের।

মারিনার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা স্কুল ধর্মঘটের অবসান ঘটে এক ঘণ্টার মধ্যেই। না ভেঙে উপায়ও ছিলো না। বিপদ শুধু রিভোলুশনারি গার্ডের দিক থেকেই যে ছিলো, তা নয়। এর বাইরে ছিলো হেজবুল্লাহ, ফ্যানাটিক লোকজনের দল এটা। এরা ছুরি-টুরি নিয়ে দলবেঁধে ঘোরাফেরা করতো। সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের প্রতিবাদ সম্মেলন হলেই হেজবুল্লাহ-র সদস্যরা একত্রিত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালাতো। মেয়েদের ক্ষেত্রে এদের সহিংসতা বেশি ছিলো। যে সব মেয়েরা ঠিকমতো হিজাব পরতো না, তাদেরকে এরা হামলা করতো। ঠোঁটে লিপস্টিক দেবার কারণে কিংবা স্কার্ফের ভিতর দিয়ে সামান্য ক’গোছা চুল বের হয়ে আছে, এইসব তুচ্ছ ঘটনাতেও এরা অনেক নারীকে আক্রমণ করেছে এবং অমানুষিকভাবে পিটিয়েছে।

ধর্মঘটের এই ঘটনার মাস দুয়েক পরে, মারিনার রসায়ন শিক্ষক খানম বাহমান ক্লাস শেষে মারিনাকে অপেক্ষা করতে বলেন। খানম বাহমান ছিলেন একমাত্র শিক্ষক, যিনি ইসলামি বিপ্লবের আগে থেকেই মারিনাদের স্কুলে পড়াতেন। সবাই চলে যাবার পরে তিনি মারিনাকে জানান, প্রিন্সিপ্যাল খানম মাহমুদীর টেবিলের  উপর তিনি একটা তালিকা দেখতে পেয়েছেন। সেই তালিকায় মারিনার নাম রয়েছে। মারিনাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দেন তিনি। জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন এটা।

ইরাকের সাথে ইরানের যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৮০ সালে। ইরানের সমস্ত সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশ ছেড়ে বাইরে যাবার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। একই সাথে সক্ষম সব পুরুষদের বাধ্যতামূলকভাবে সামরিকবাহিনীতে কাজ করার নির্দেশ জারি করা হয়। সামরিকবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে সেবা দেওয়া এড়ানোর জন্য বহু লোক, প্রচুর টাকা খরচ করে পালিয়ে যেতে থাকে ইরান থেকে। এদের বেশিরভাগই সীমান্ত পাড়ি দেয় তুরস্ক এবং পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে।

ইসলামি বিপ্লব এবং ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে ইরানের লোকজনের যে দুরবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটার প্রতিবাদে ফেরদৌসি স্কোয়ারে এক প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করা  হয়। মারিনা সেখানে অংশ নেয়। শুধু মারিনা নয়, তার স্কুলের গীতা, সারাহসহ আরো অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী প্রতিবাদ জানাতে চলে আসে ফেরদৌসি স্কোয়ারে। লাউড স্পিকারে এক তরুণী বক্তৃতা করতে থাকে নারীদের বিরুদ্ধে হেজবুল্লাহ-র আক্রমণ নিয়ে। “আমরা কতদিন এই সব অপরাধী এবং খুনিদের আল্লাহ-র নামের আড়ালে লুকিয়ে থেকে আমাদের মা, বোন এবং বন্ধুদের উপর আক্রমণ ঘটতে দেবো? সে জিজ্ঞেস করে জনতাকে।

এক বৃদ্ধা নারী বৃস্টলবোর্ড ঝুলিয়েছে তার বুকের উপরে। সেখানে স্বল্পবয়েসী এক তরুণীর ছবি। তার নিচে লেখা, এভিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে একে।

জনতার এই বিক্ষুব্ধ সমাবেশকে গুলি করে নির্দয়ভাবে ছত্রভঙ্গ করে দেয় রিভোলুশনারি গার্ডের সৈনিকেরা।

পরের দিন স্কুল শুরুর আগে স্কুল করিডোরে একটা বৃস্টল বোর্ড টানিয়ে দেয় মারিনা। সেখানে আগের দিনের প্রতিবাদ সমাবেশ এবং সেটাকে কীভাবে রিভোলুশনারি গার্ড ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, সেটা লিখে রাখে সে।

প্রিন্সিপ্যাল খানম মাহমুদী দ্রুতগতিতে চলে আসেন দৃশ্যপটে। দুই লাইন পড়েই তিনি রাগে চিৎকার করতে থাকেন যে এগুলো সব মিথ্যে কথা।

“না, এগুলো মিথ্যে নয়। আমি ছিলাম সেখানে।’ প্রতিবাদ করে মারিনা।

“ও, তুমি ছিলে তাহলে সেখানে!” হিমশীতল শোনায় খানম মাহমুদীর কণ্ঠ।

এর মধ্যে সময় চলে গেছে আরো। সারাহ, সাইরাস, গীতা, এরা সবাই একে একে বন্দি হয়েছে। নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের  কুখ্যাত এভিন জেলে। মারিনার গ্রেফতার হওয়াটা শুধু সময়ের দাবি তখন।

১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে, রাত ঠিক নয়টার সময় মারিনাদের বাড়িতে এসে হাজির হয় রিভোলুশনারি গার্ডের সদস্যরা। দুজন আসে, দুজনেরই গালে দাঁড়ি, হাতে অস্ত্র। পরনে গাঢ় সবুজ রঙের সামরিক পোশাক। এদের একজন অস্ত্র তুলে ধরে মারিনার দিকে। তার রুম কোনটা, সেটা দেখিয়ে দিতে বলা হয়। তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হয় তার রুম। তার রুমে কিছু পাশ্চাত্যের উপন্যাস পায়। সেগুলোকেই তারা  ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধাচরণের আলামত হিসাবে জব্দ করে নেয়।

মারিনার হতভম্ব, ক্রন্দনরত এবং ভয়ে আতংকিত বাবা-মায়ের সামনে দিয়ে কিশোরী মারিনাকে তারা নিয়ে যায় এভিন জেলে।

3046 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।