শারমিন শামস্

সমাজকর্মী শারমিন একজন ফিল্মমেকার ও সাংবাদিক।

কবে পাব এমন সব ‘মানুষ মেয়ে’

রাস্তায় নামলে মেয়েদের হাঁটতে চলতে দেখি। একটা বড় অংশরে দেখি সারা শরীরে জড়তা, লজ্জা, নিরাপত্তাহীনতা, সংশয় আর সপ্রতিভতাহীনতা নিয়া চলতে। কেনো? জড়তা কোথায় থাকে মেয়েদের? বুকে? নিতম্বে? পথ চলতে কী মনে হয় তাদের? কেউ তাদের গায়ে হাত দেবে? কেউ বাজে কথা বলবে? প্রতিবাদ করলে আরো খারাপ হবে পরিস্থিতি? তাই তারা এরকম মুখ গুজে মেরুদন্ড বাঁকা করে মাটির সাথে ঝুঁকেমুকে হাঁটে, চলে, বাসে ওঠে?

রাস্তায় নামলে মেয়েদের দেখি। দেড় হাত উঁচা হিজাব দেখি। বড় ওড়নায় মোড়ানো শরীর দেখি। বাচ্চার হাত ধরে হেঁটে যাওয়া, গাড়িতে বা রিকশায় ওঠা ভারি শরীর দেখি। শরীরের গাঁটে গাঁটে ব্যথা দেখি। ক্লান্তি দেখি। কোথায় জন্ম এই ক্লান্তির? সংসারে? একান্ত নিজেকে নিয়ে স্বপ্নের পরিসমাপ্তিতে, আত্মবিশ্বাসহীনতায়? 
রাস্তায় নামলে নারীদের দেখি। চোখে মুখে মেকাপ দেখি। দামী পাকিস্তানী ভারতীয় সালোয়ার কামিজ দেখি। ওড়না সামলাতে হিমশিম দেখি। দোকানপাটের সামনে বিচ্ছিরি করে গাড়ি পার্ক করিয়ে পনেরো মিনিট ধরে আয়েশ করে নামতে দেখি। ভারি শরীর টেনে নিয়ে শপিং করতে দেখি। 

স্কুলের সামনে মায়েদের দেখি। নিজের জীবনে নিজেদের না থাকাকে দেখি। শুধু স্বামী, সন্তান আর সংসারে ছড়িয়ে যেতে দেখি। বিএ এমএ পাশ করে বসে থাকতে দেখি। একটা বাচ্চা সামলাতে না পেরেও আরেকটা বাচ্চা গর্ভে নিতে দেখি। অতঃপর সন্তান পালন করে জীবন কাটিয়ে দিতে দেখি। স্কুলের সামনে শাড়ির গল্প করতে দেখি। স্বামীর প্রমোশনের গল্প করতে দেখি। এর মাঝে কর্মজীবী মা দেখলে ঈর্ষা আর সমালোচনার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠতে দেখি। ভিতরে বেদনাও দেখি।

বাসের ভিতরে মেয়েদের দেখি। পুরুষ গায়ে হাত দিলে গুটায়ে যেতে দেখি। জড়োসড়ো বসতে দেখি। বাসায় ফিরে কাঁদতে দেখি। রিকশায় হুডের নিচে বসতে দেখি। গাড়িতে ঝকমকে ফিটফাট পটের বিবি দেখি।দেখতেই থাকি। চোখ জুড়ে তৃষ্ণা আমার- ইচ্ছে হয় রাস্তা জুড়ে সংগ্রামী মেয়ে দেখি শুধু। সহজ সরল সুবিধাজনক গ্রীষ্মউপযোগী পোশাক পরা মেয়ে। গটগটিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়ে। কাউকে ভ্রুক্ষেপ না করা মেয়ে। মাথা উচু করে মেরুদন্ড সোজা রেখে চলা মেয়ে। রূপচর্চা শুধু নয়, নিয়মিত শরীরচর্চা করা মেয়ে। মেদহীন মেয়ে। ঝরঝরে চটপটে স্মার্ট মেয়ে।

পুরুষ একটা খারাপ কথা বললে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করা মেয়ে। একবার গায়ে হাত দিলে রুখে দাঁড়িয়ে লোকটাকে পিটিয়ে তক্তা বানানো মেয়ে। নিজেকে মূল্যবান ভাবা মেয়ে। নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মেয়ে। রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে সব স্থানে নিজের নিজের যোগ্যতা নিয়ে কাজ করা মেয়ে। অনেক অনেক দূর যাওয়া মেয়ে। ট্রাফিক পুলিশ মেয়ে, সচিব মেয়ে, শিক্ষক মেয়ে, ডাক্তার মেয়ে, রাস্তায় কাজ করা কন্ট্রাকটর মেয়ে, সুইপার মেয়ে, দোকানী মেয়ে, শ্রমিক মেয়ে, পুলিশ মেয়ে, গোয়েন্দা মেয়ে, র‍্যাব মেয়ে, মালি মেয়ে, ড্রাইভার মেয়ে, দারোয়ান মেয়ে, ব্যবসায়ী মেয়ে, সাংবাদিক মেয়ে, শিল্পপতি মেয়ে। সব সব কাজে শুধু মেয়ে। আরো মেয়ে। সংসারের বাইরে নিজের উপযোগীতা আর উৎপাদন প্রমাণ করা মেয়ে। শাড়িতে, খোপায়, ফুলে, আলতায় উৎসবে যাওয়া মেয়ে। রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসা মেয়ে। বই পড়া মেয়ে। কবিতা পড়া মেয়ে। বইয়ের দোকানে ঘুরে বেড়ানো মেয়ে। সন্তান কোলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো মেয়ে। সুস্থ মেয়ে। শক্তিশালী মেয়ে!

মানুষ মেয়ে। কবে পাব লাখে লাখে কোটি কোটি এমন সমস্ত মেয়ে?

 

 

4323 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।