অঞ্জন রায়

সংবাদকর্মী

অঞ্জন রায় এর কবিতা-মানুষ সিরিজ

যারা ধর্মান্ধদের হাতে নিহত হয়েছেন- যারা হবেন বা হব। তাদের জন্য এই বাক্যগুলো। এগুলো কবিতা নয়-অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধের জারি লড়ায়ে কদম মেলানো মাত্র।

মানুষ- ১

ত্রিশূল আর চাপাতিতে কোনো ভেদ নাই
উন্মাদ সব অন্ধের হাতে থাকে যদি তারা
যেমন একই সাদা কালো বাদামী চামড়া,
তেমন ঘাতক এক শুধু পরিচয় আলাদা।
ভেদ ভুলেই যারা শান দেয় হত্যার অস্ত্রে
গ্রহজুড়ে বিভিন্ন শহরে- সে ঘাতক একই
একই তাদের মগজের মধ্যে থাকা বিষ।

একলা নেকড়েটা দলছুট- ছোটে রক্তনেশায়,
মানুষ ভয় পায় তারা- প্রাচীন অস্ত্রের খুনী।
বোকারা জানে না তথ্য মানুষ প্রকৃত রক্তবীজ
নিলয় আখলাক অভিজিৎ-রক্ত কিন্তু একই
প্রতি ফোঁটা রক্তে থেকে জন্মে হাজারে হাজার।

জন্মের সংখ্যা এতো বেশি- সব কামার মিলে
বছর জুড়ে রাতদিন চাপাতি ত্রিশূল গড়ে যাক
কখনোই সেই অস্ত্রে সকল মানুষ হবে না শেষ
এটাই বাল্যশিক্ষা- মানব সভ্যতার প্রথম পাঠ
লালন কবীর বলেছে, শুনেছে- নদী আর মাঠ।

#ঢাকা ২২ মার্চ।

মানুষ- ২

গর্ত থেকে আসা একলা নেকড়ে তুমি
মগজ ভর্তি বিষ- হাত রাখা খুনি বেল্টে,
তোমার কোনোই শক্তি নেই- কয়েকটা
বোমা বুলেট আর প্রাচীন চাপাতি ছাড়া।

একটা দুটো খুচরো বিষ্ফোরণ শুধু পারো
তোমার ভুল মগজে-ভুল নষ্ট এই জীবনে।

তুমিতো ভালোবাসা শেখো নাই-শিখেছো
চাপাতি বোমা বুলেটে মানুষ শিকার,
শিখেছো যাদের কাছে, তারা নষ্ট মানুষ-
দু’হাতে ক্ষমা চায়-ঘেয়ো চতুস্পদের মতোন।

তোমাকে মারতে বলে যে- অস্ত্র আর অর্থের
সম্ভার দিয়ে বানিয়েছে হিংস্র একলা নেকড়ে,
সে খুনী নিজেই জোড়হাত, লজ্জাহীন এখন।

ভাবো তুমি- লজ্জায় নিজেই নিজেকে দেখো
শিরোচ্ছেদ করো- মারার বদলে মরো তুমি।

এই মাটি তোমাকেও চায় না- যেমন চায় না
তোমাদের গড়ে তুলে-মগজে বিষ ঢেলে দিয়ে,
জেলে বসে হাতজোড় তিন নপুংসক ঘাতকের
ফুসফুসে হাওয়ার জোগান দিতে বাংলাদেশ।

#৩০ মার্চ, ঢাকা। 

মানুষ - ৩

চাপাতিতে খুন হওয়া চোখেও স্বপ্ন থাকে- হয় না খুন
মানুষ মারতেই পারো- পারো মারতে কলমের আগুন?
তুমিতো মানুষ নও- মগজহীন খুনের যন্ত্র মাত্র শুধু এক
তোমার হৃদয় নাই, নাই বোধ রুচি অথবা সামান্য বিবেক

সেই যে মেরেছিলে কবে- রক্ত কিন্তু এখনো অধিক উজ্জল
চাপাতিতে থামে নাই কখনো মানুষ, হারে না চিন্তার ফসল-
পারো নাই কিছু তুমি, শুধুই পারো হিংসার জ্বালাতে আগুন
জানো নাই তুমি- মৃত্যু করে দেয় আমাদের মুহূর্তে বহুগুন।

মানুষ-৪

রাষ্ট্রও আপোষ করে- করে নতজানু মাথা
সেখানেও ভোটের অংক- ক্ষমতার কথা
রাজনীতি ডানে ঘোরে-মগজও কি তাই?
অথচ নালন্দ ছিলো- এখানে মেধার ঠাঁই।

ক্রমশ পেছনে হাঁটা- ভুতের আপন সহোদর
অন্ধকারের উপহার- চাপাতি কোপানো ধর
এখানে লালনের ছিলো-ছিলো বৈরাগীর ঘর
এখন সেখানে শুধু- অস্ত্র হাতে চরম বর্বর।

মানুষ -৫

লাশ পড়ে থাকে শহরে বা গ্রামে-মানুষের।
ঘাতকের নাম নাই, আছে শুধু ভুল দর্শন,
বাউলের একতারা থেকে লেখক প্রকাশক
সবার মৃত্যুর পর তাদের তালিকা কি শেষ?

এরা সেই যন্ত্র যারা চিন্তার প্রধান প্রতিপক্ষ
ইতিহাস বলে তারাই মেরেছে ব্রুণো সক্রেটিস-
তারা বামারুনে ভাস্কর্য ভাঙে ঢাকায় বলাকা,
চিন্তার বিরুদ্ধ প্রেত সভ্যতার ভ্রুন খেয়ে বাঁচে।

মানুষের ধর্ম আলাদা, এক শুধু লাশের রক্ত-
অন্ধকারের নাম আলাদা তবে তাদের হত্যার
ভাবনায় আছে মিল। দেশে দেশে একই খেলা
সর্বদা গ্যালারিতে রাষ্ট্র থাকে শুধু নীরব দর্শক।

রাষ্ট্র আছে-আছে বইতে লেখা ভোটের নিয়ম
সেখানে অনেক অংক-লঘু গুরু হিসাব নিকাশ
সেই সুযোগেই অন্ধকার বেড়ে ওঠে মহা আনন্দে-
চাপাতি হবে কি আগামী ভোটের নতুন প্রতীক?

মানুষ- ৬

যখন নালন্দা ছিলো শিক্ষার বিশাল আশ্রম
তখনও ধর্ম ছিলো, ছিলোনা ধর্মের নামে খুন
তখন উৎসব ছিলো-ধর্মবোধ করে নি বিভেদ
মানুষ তখন ছিলো হলকর্ষ আমোদে বিভোর
জীবন তখন ছিলো জীবনেরই উজ্বল প্রকাশ

পিকাসো তখনো ঘৃনায় আঁকেনি গোয়ার্নিকা
ডিলানের হাতে তখনো ওঠেনি আগুন গিটার
তখনও রক্তপাত ছিলো-দাস ছিলো মানুষেরা
চাবুকের দাগ ছিলো পিঠে-করতলে রক্তক্ষরণ
নামে নয় নম্বর ছিলো তাদের নিজস্ব পরিচয়।

এখানে সময়ের সাথেই আসেন স্পাতাকার্স
গিলোটিনে মাথা রাখে- সাহেব বিবি গোলাম
দুনিয়া বদলে দেয় লাল নিশান, মানব বিপ্লব
তখনি হাঁপরে দেয়া নতুন কয়লা- বিভাজনের
কুমন্ত্রে অন্ধ ধর্মান্ধতার দানবেরা মাঠে নামে।

সেই শুরু- আলো আর অন্ধত্বের স্পষ্ট রেখা
সেখানে ধুসর বলে কিছু নাই- ধুষরই আপোষ
আপোষের পথে হাঁটে- মধ্যপন্থী প্রগতির  ষাড়
তাদের সুখের কাল-ডান বাম দোলেপেন্ডুলাম
হাওয়ায় বেশ পাল ভেসে চলে সদাগরী বহর।

তাঁরাই বিপদে যারা চিন্তা করতে জানে- জানে
বলেই বিপদেও তাঁরা হাসে, বলে মারবে-মারো
ভাবনার ব্যাটন হাত বদল হয় প্রতিটি মৃত্যুতে
এ মাটিতেও তাই হয়- হচ্ছেই এখনো নিরন্তণ
মৃত্যুহীন মুক্তচিন্তারা ইতিহাসের পথেই হাঁটে।

মানুষ- ৭

আবার পোড়াবে? সাথে এনেছো দাহ্য উপাদান,
পরোয়া করি না জেনো আমরা তো পুরাণের পাখি-
নিজেরা দগ্ধ হয়ে জন্ম দেই আরেক নতুন জীবন।

ভুলিনি দগ্ধ শিশু, ভুলিনি শীতের রাতে ভৈরব নদ
যেমন ভুলি নি যুদ্ধ-প্রতিরোধে দিতে অকাতরে প্রাণ।

কতোটা পোড়াবে তুমি, পারো কি পোড়াতে খুব বেশি?
পারে না সেই সত্যি-একাত্তরের পোড়ামাটি সাক্ষী তার।

মনে রেখ অন্ধকার-তুমি যত দাহ্য নিয়ে পথে নেমেছো-
তার চেয়ে অনেক বেশি আগুন আমাদেরও দেখা আছে
ইতিহাস সাক্ষী-অন্ধকার হারে মিলিত আলোর কাছে।

#৩১ জানুয়ারী, ঢাকা।

মানুষ- ৮

শেষ কার্ড হাতে নিয়ে মাঠে মাঠে পুরোনো ব্যবসায়ী
তাদের হাত থেকে ঝরে পড়ছে প্রাচীন রক্তের ধারা-
মুখহীন দানবের আছে বিশাল এক গহবর- সেখানে
হুটু তুতশী অথবা প্যালেস্টাইন গুজরাটে খুন করা শিশু,
যাজক, পাদ্রী, থেকে সীতা কানোয়ার সকলের অবয়ব
স্পষ্ট দেখা যায়- দেখা যায় র‌্যাডক্লিফের দাগ, নষ্ট বিভাজন।
সেখানে জ্বলছে মানুষ, ধর্ম আর ব্যবসার তাপে- মরে যাচ্ছে
নিয়ত সুন্দর আর সুকুমার গোলাপ অথবা উজ্বল আলোরা।

# ঢাকা ৩১ জানুয়ারি।

মানুষ- ৯

সেই সব লাশগুলোরতো বসন্তের উৎসব ছিলো
ছিলো দুই জোড়া ঠোঁট মিলে যাওয়ার অধিকার
সারাদিন প্রেম অথবা মিষ্টি ঝগড়া বা মিলনের
সবার মতোই সমান অধিকার-তাদেরও অন্তত
বেঁচে থাকার অধিকারটুকুতো দিয়েছিলো কালো
অক্ষরে লেখা সংবিধান নামের সেই বইখানায়।

আমি জুলহাস আর তন্ময়ের ভালোবাসার কথা
অভিজিৎ আর বন্যার প্রেমের কথা ভাববো আজ,
ভাববো নীলয় আর আশিকুর রহমান বাবুর প্রেম
কতটা শক্ত ছিলো- রাজীব বাসন্তীর যৌথ জীবন
অথবা সেই খুন হয়ে হওয়া যাজক পুরোহিত পীর
তাদের স্রষ্ঠায় অর্পত অন্তহীন ভালোবাসার কথা।

দীপনের জলি আর পান্ডুলিপি প্রেমের কথা ভাববো
শুধু ভাববো না- আমার জন্যেও আজ কোনোখানের
কামারবাড়ীতে যত্নে নতুন চাপাতি তৈরি হচ্ছে কি না?

#১৩ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা 

2265 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।