মামুনূর রশীদ

মানবাধিকার কর্মী

ধর্মের দোকানদারদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে

এক.

আমাদের অঞ্চলের ধর্মচর্চার ব্যাপারটা কেমন যেনো উলট পালট ধরনের। উলট পালট বলার কারণ হচ্ছে এই অঞ্চলে ধর্মকর্মের বিস্তার, প্রসার ও চর্চার সাথে শুধু স্রষ্টাকে আর তার সৃষ্টিকে ভালোবেসে নিজে বিলীন হয়ে যাওয়ার চেয়ে জীবিকা নির্বাহ আর অশিক্ষিত মানুষদের উপর নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাপারটা খুব নিবিড়ভাবে জড়িত।

আর এই নিবিড়তা এতটাই বেশি যে, সম্পূর্ণ ধর্ম ব্যাপারটাকেই এর সুবিধাভোগীরা এক ধরনের পার্থিব ক্রয় - বিক্রয় যোগ্য পণ্য বানিয়ে ফেলতে দ্বিধা করে না!

এই ব্যাপারটা খুব সহজভাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তার "লালসালু"তে তুলে ধরেছিলেন - সেই কত আগে! অথচ আজো আমরা সেইসব সুবিধাভোগী আর তাদের পদলেহী অধস্তনদেরও আমাদের সমাজে তোষামোদ করে চলি!

দুই.

আমাদের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের স্ত্রী কে নিয়ে বারবার কটাক্ষ এবং নোংরা মন্তব্য করা তথাকথিত মুমিনের সংখ্যা জানলে আঁতকে উঠবেন! কি বিশ্বাস হচ্ছে না?

আমার ও হয় নি প্রথমে, তারপরে গিয়েছিলাম এক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে "সাকিব - শিশির" এর হজ্ব পালনের পরে সুন্দর একটি পারিবারিক একটি ছবি দেখতে। কিন্তু তার নীচের প্রায় ১০ হাজারের বেশী তথাকথিত "মুমিন বান্দা"দের কমেন্টের কিছু দেখে রীতিমতো গা গুলানো শুরু হয়ে গিয়েছিলো!

কি নেই তাতে, সাকিবের দাঁড়ি থেকে তার স্ত্রীর চরিত্র, এমনকি বাদ যায় নি তার নিষ্পাপ বাচ্চাটির জন্মকথাও! এরা এর সবই করছে - বলছে "ধর্মের" অজুহাতে!

অথচ যদি স্বাভাবিক মানবিকতার কথা বাদও দেই পৃথিবীর সকল ধর্মেই অন্যের মনে বিন্দু পরিমাণ আঘাত করার কথা নিষেধ করা হয়েছে। দু:খের বিষয়, এরাই এখন বিভিন্ন ধর্মের ঝান্ডা উড়িয়ে বেড়ায়!

তিন.

বিগত ২০১৮ সালের মে মাসে উচ্চস্বরে "আল্লাহু আকবার" বলার কারণে এক মুসলিমকে ১৫০ সুইস ফ্রাংক জরিমানা করেছিলো সুইস পুলিশ। সেই কেস আদালত পর্যন্ত গড়ালে এবং তাতে পুলিশ বিজয়ী হলে কোর্ট ফিসহ সেই মুসলিম ব্যাক্তিটিকে ২১০ সুইস ফ্রাংক দিতে হয়েছে! এই হারের অন্যতম কারণ হচ্ছে, পুলিশ প্রমাণ করতে পেরেছে যে -এখানে আত্মঘাতি হামলাকারীরা হামলা করার আগে "আল্লাহু আকবার" বলে তারপর হামলা করে।

সকল ধর্মের বিশ্বাসীদের কাছেই তারা যাকে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে জানে, সে ই সর্বোৎকৃষ্ট; সে হিসাবে সুইজারল্যান্ডের এই ঘটনা একজন মুসলমানের জন্য কতটা কষ্টের আর লজ্জার, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! অথচ মৃত্যুর পর শুধু ৭২ হুরের লোভে নিজ ধর্মকে পণ্য বানানো ব্যবসায়ীদের কিন্তু এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি হয় নি!

চার.

উপরে এতক্ষণ ধর্মকে পুঁজি করে সুবিধাভোগী যেসব মানুষের কথা বললাম, হাটহাজারীর আল্লামা শফি সাহেব এবং তার অনুসারী রা হচ্ছে সেই দলের মানুষদের একটা রুপ।

এরা নিজেরা আধুনিক সভ্যতার সকল সুবিধা প্রাপ্ত হয়ে -অন্যদের উপদেশ দিবেন 'আইয়ামে জাহেলিয়াত' এর যুগ পড়ে থাকতে, এরা নিজেদের সুবিধামতো শিক্ষিতা নারীদের সেবা নিয়ে -দান ভিক্ষা নিয়ে "জননী" ডাকতে ও বাঁধে না কিন্তু আপনার আমার জন্য ধর্মের ফতোয়া দেবেন কন্যা সন্তানকে স্কুল কলেজে না পাঠানোর, চাকুরী তে না পাঠানোর। শুধু ফতোয়া দিয়েই এরা থামে না, সেই ফতোয়া যাতে অক্ষরে অক্ষরে আপনি আমি পালন করি, তার ওয়াদা ও করিয়ে নেন। কি ভয়ংকর - ধূর্ত এরা, কখনো চিন্তা করেছেন কি?

এরা জানে, আমাদের কন্যা সন্তানেরা শিক্ষিত হয়ে উঠলে -প্রতিটি মা শিক্ষিত হয়ে উঠলে একদিন পুরো সমাজ শিক্ষিত, আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে, ধর্ম আর অধর্মের পার্থক্য ও সবাই নিজেরাই বুঝতে পারবে।

সেদিন এদের এই ধর্মের নামে খোলা মুদি দোকানগুলো বন্ধ করে দিতে হবে তাই তারা সেই ঝুঁকিটুকু ও নিতে চান না। এমনিতেই আমাদের অঞ্চলের মানুষ ধর্মের ব্যাপারে অনেক সুক্ষানুভুতি সম্পন্ন, জনসংখ্যার একটি বড় অংশ অশিক্ষিত -আর এখন বেশীরভাগই ওয়াজের নাম করে সেই সুযোগটাই এই ধর্মের ব্যবসায়ীরা কাজে লাগায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ঘৃনা ও বিদ্বেষ ছড়াতে, নারীকে শুধু ভোগ্যপণ্য অথবা তেতুল হিসাবে উপস্থাপন করে আদি রসাত্বকভাবে বয়ান করতে, এমনকি নিজের লাভ পকেটে রেখে নিজের ধর্মকে ও পণ্য বানাতে।।

বিশ্বাস না হয়, অনলাইনে ঘুরে বেড়ানো হাজার হাজার ওয়াজের ভিডিওগুলোর কিছু দেখতে পারেন; এগুলোর মাঝে খুব কম ভিডিওই পাবেন যাতে নারীদের সমন্ধে অসংখ্য আপত্তিকর কথা নেই!

অথচ সমাজের দুর্নীতি, দুর্নীতিবাজ, শিক্ষার অবক্ষয়, দুর্বল আইন শাসন ব্যবস্থা নিয়ে এদের বয়ান শুনবেন খুবই কম আবার কখনো একদমই না! এদের যাবতীয় সমস্যা নারীর সমস্যা -নারীর শিক্ষায়, নারীর উপার্জনে, নারীর স্বাধীনতায় এমনকি নারীর ভাস্কর্যে ও!

সর্বশেষ

এই যে বিগত কয়েক দশকে ধর্মের দেয়াল তুলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি, একে অন্যের প্রতি অসহিষ্ণু ব্যবহার, সমাজে নারীর নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানো, মানুষের চিন্তাভাবনা সার্বিকভাবে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া -এই কাজগুলো খুব সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে সমাজে এরা নিজেদের অবস্থান দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে চলেছে।

কিন্তু এত কিছুর পরেও নারীর শিক্ষা, চাকুরী, খেলাধুলায় সফলতা, সার্বিক স্বনির্ভরতা কোনো কিছুই থেমে থাকে নি বরং এসব ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক ভালোভাবেই এগিয়ে গিয়েছে আমাদের নারীরা। এখন সময় হয়েছে এইসকল ধর্মের দোকানদারদের আইনের আওতায় আনা এবং দেশের সাধারন মানুষদের শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা।

যারা একজন মানুষকে সম্মান করতে জানে না, নারী দেখলেই যাদের জিহ্বা লালা সিক্ত হয়- তারা ধর্মকে কতটুকু সম্মান করবে? সময় হয়েছে ধর্মের নামে অধর্ম ছড়ানো এসব নোংরা ধর্ম ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরার, এদের কে শেখাতে হবে যে, ধার্মিক হওয়ার আগে মানুষ হওয়া প্রয়োজন।

অন্যথায়, যুগে যুগে অন্যের ধর্মচর্চা নিয়ে এরা অসম্মানজনক মন্তব্য করেই যাবে; আল্লাহু আকবার এর মতো সুন্দর নিরীহ দুটি শব্দ পৃথিবী জোড়া মানুষের ভয়ের কারণ হয়ে থাকবে, আর এইসব ধর্মের ধ্বজাধারীরা নারীদের তেতুল বলে -অশিক্ষিত রেখে, নিজেদের জিহ্বা শানিত করেই যাবে।

 

1668 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।