হাই কোর্টে শুনানী ছিলো সেদিন। আমার প্রাক্তন স্বামী হাই কোর্টে মামলা করেছিলো আমার বিরুদ্ধে যে আমি আমার চার বছরের ছেলেকে ঘরে বন্দী করে রাখি, খেতে দেই না, তার বাবার সাথে দেখা করতেও দেই না। তার অভিযোগ আমি বাচ্চাকে গুম করে ফেলবো, কারণ আমি মাদকাশক্ত এবং চরিত্রহীনা। শুনানীর মাত্র দুইদিন আগে আমি কোর্টের নোটিশ পেয়েছিলাম। মাঝে শুক্র শনিবার সব বন্ধ। নোটিশের মূল বক্তব্য পড়ে মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা হলো। কোথায় যাবো, কার কাছে সাহায্য চাইবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার আইনজীবি বান্ধবীকে জানালাম বিষয়টি। সে আমাকে তার যথাসাধ্য সাহায্য করবে বলে আশ্বাস দিলো।
এর কিছুদিন আগে বাচ্চার ভরণ পোষন দেয়া আর বাচ্চার সাথে নিয়ম মাফিক দেখা করানোর ব্যবস্থা করতে সাহায্য চেয়েছিলাম আইন ও শালিস কেন্দ্রের। তারা দুই পক্ষকে ডেকে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে মাসিক ভরণ পোষনের ব্যবস্থা করলো, সাথে বাচ্চাকে তার বাবা কবে কয়দিন কোথায় দেখা করবে সে নিয়মও করে দিলো। আমার প্রাক্তন স্বামী যেহেতু আমার দেনমোহর দেননি, সে বিষয়েও তারা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে ব্যবস্থা করে দিলো। এর কিছু তো সে পুরুষটি পালন করেইনি উপরন্তু আমাকে এর ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় হাই কোর্টের নোটিশ পাঠিয়ে দিলো।
যাক, নোটিশ পাওয়ার পর পরিবারের বয়জোষ্ঠ বড় চাচাকে জানালাম যেনো উনি আমাকে একজন ভাল আইনজীবি দিয়ে সাহায্য করেন। বড় চাচা পেশায় সাংবাদিক ছিলেন, একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দেশে ওনার পরিচিতি ছিলো ব্যপক। তিনি আমাকে ডাকলেন তাঁর বাসায়, পরদিন সকালেই তাঁর কাছে গেলাম। ইতিমধ্যেই আমি এই লোককে (আমার প্রাক্তন) বিয়ে করার শাস্তি ভোগ করছিলাম পরিবারের কাছ থেকে। তার উপর এই মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ায় পরিবারের লোকজন আমার উপর ভীষন বিরক্ত। উনার কাছে যাওয়ার পর সেইসব বিরক্তির প্রকাশ বেশ করে করলেন। আমি অঝোরে কাঁদছিলাম অসহায়ের মতো, কারণ তখন যে যাইই বলুক আমার একজন ভালো আইনজীবি প্রয়োজন। যথেষ্ট রাগারাগির পর উনি একজন এটোর্নি জেনারেল এর ফোন নাম্বার দিলেন যোগাযোগ করার জন্য।
বাসায় ফিরেই ওই আইনজীবির সাথে যোগাযোগ করি এবং নোটিশ সংক্রান্ত সবকিছু জানাই। উনি পরদিন অর্থাৎ শনিবার তাঁর অফিসে যেতে বলেন। ইতিমধ্যে বনানী থানা থেকে আমাকে কল দিয়ে ডাকা হয়, বলা হয়েছিলো থানার ওসি আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন। বিকেলে থানায় গেলাম, গিয়ে শুনলাম ওসি সাহেব নেই, কোনো এক কনসার্টে ডিউটিতে গেছেন আর আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। আমি প্রায় তিন ঘন্টা অফিস রুমে বসে অপেক্ষা করার পর থানার এস আই জানালো, ওসি সাহেবের আসতে আরেকটু দেরি হবে তাই উনি পরে দেখা করবেন। আমি থানা থেকে চলে আসলাম।
পরদিন সকালে আইনজীবির অফিসে যাওয়ার জন্য যেই বের হবো তখনই থানা থেকে আবার ফোন আসলো, ওসি সাহেব আমার সাথে পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করতে চান। বাসায় আমার দুই বাচ্চা ঘুমাচ্ছিলো আর তাদের সাথে ছিলো একজন গৃহপরিচারিকা। আমি তাদেরকে বাসায় রেখে কাউকে কিছু না জানিয়ে থানায় চলে গেলাম, থানাটা ছিলো ঠিক আমার বাসার পেছনে। গিয়ে দেখলাম ওসি সাহেবের রুমে অনেক ভীড়, বাইরে অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ। এরপর আমাকে ডাকা হলো। আমার সাথে থানার এস আই ঢুকলেন রুমে। ওসি সাহেব আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার বাচ্চা কোথায়, তাকে আনেননি কেনো?” আমি তো হতবাক! বাচ্চাকে তো আনার কথা বলা হয়নি। উনি অনেকটা বিরক্তির স্বরে বললেন, “আপনি নিজে কেইসে জড়িয়েছেন সাথে আমাকেও”। অর্থাৎ আমি কোর্টে যেন যথা সময়ে হাজিরা দেই সেই দায়িত্ব ওনাকে দেয়া হয়েছিলো যেটা কোর্টের নোটিসে উল্লেখ ছিলো। উনি আমাকে বললেন, “আমি আপনাকে একজন মহিলা কনস্টেবল দিয়ে দিচ্ছি সাথে, আপনি বাসা থেকে আপনার বাচ্চাকে নিয়ে আসেন।“ সেই মহিলা কনস্টেবল আমাকে রুমের বাইরে গিয়ে বললেন, “আমি আপনার সাথে যাবো আপনার বাসায় এটা দেখতে ভাল লাগে না। আমরা বুঝতে পারছি এখানে কি হচ্ছে। বরং আপনি বাসায় ফোন করে কাউকে বলুন আপনার বাচ্চাকে যেন থানায় নিয়ে আসে।“
বাসায় রয়েছে আমার তেরো বছরের মেয়ে, আমার চার বছরের ছেলে আর গৃহপরিচারিকা। আমি আমার মেয়েকে ফোন দিয়ে বললাম, “আম্মু তোমরা যেভাবে আছো সেভাবেই থানায় চলে আসো”। তখন আমি ওসি’র রুমের বাইরে বসে অপেক্ষা করছিলাম আমার বাচ্চাদের জন্য। থানার এস আই বললো, “আপনার প্রাক্তন স্বামী আপনার নামে একদিনে পাঁচ ছয়টা জিডি করেছে, আমাদের তখনই খটকা লেগেছে ব্যাপারটা।“
এ সময় দেখলাম বাচ্চার বাবা তার এক বন্ধুকে নিয়ে হাজির থানায়। বারবার কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলছে, আবার ওসির সাথেও গিয়ে কথা বলছে। বুঝলাম কোন ষড়যন্ত্র চলছে। আমি সাথে সাথে আমার বড় চাচাকে কল দিলাম। কোনো উপদেশ তো দূর, কাউকে না বলে হুট করে থানায় যাওয়ার বোকামীর জন্য এক রাশ কথা শুনিয়ে ফোনের লাইনটাও কেটে দিলেন। এরপর ফোন করি আমার মাকে। উনি কোনো এক কাজে ছিলেন, কয়েকবার কল করার পর ধরলে আমি ওনাকে সব জানাই এবং থানায় আসতে বলি। উনিও হতাশ করে দিয়ে বললেন, বড় চাচা চাচীকে জিজ্ঞেস করে থানায় আসবেন যদিও পরে এসেছিলেন। এরপর কল করি আইনজীবি আমার স্কুল বান্ধবীকে। সে বললো কোর্ট থেকে বের হয়েই সে আসছে থানায়। ইতিমধ্যে আমার বাচ্চারা চলে এসেছে।
ছেলেকে চিলের মত আমার কোল থেকে ওর বাবা তার কোলে নিয়ে গেলো। আমি তখনো অঝোরে কাঁদছি, দেখি আমার উকিল বান্ধবী চলে এসেছে, সে বিস্তারিত জানতে চাইলো ওসির কাছে এবং যথা সাধ্য চেষ্টা করছিলো আমাকে ওখান থেকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ওসি বললেন শুধু মাত্র আমার নিযুক্ত আইনজীবি পরদিন কোর্টে যাওয়ার গ্যারান্টি দিলে উনি আমাকে ছাড়বেন নাহলে আমাকে বাচ্চাসহ এক রাত থানায় থাকতে হবে। তখনই যোগাযোগ করি আমার আইনজীবির সাথে যার কাছে আমার যাওয়ার কথা ছিলো তখন। উনি আমাকে বললেন ওসি’র সাথে কথা বলাতে। ওসি তাঁকেও একই কথা বললেন। উনি ওসিকে বললেন, উনি একজন জুনিওর আইনজীবি পাঠাচ্ছেন ওনার হয়ে বন্ড সই দিবে এবং আমাকে যেনো ছেড়ে দেয়া হয়। ওসি ওনার কথায় রাজি হলে প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে আইন ও শালিস কেন্দ্রের একজন আইনজীবি এসে বন্ড সই দিলে বাচ্চাসহ আমাকে থানা থেকে ছাড়া হয়।
ততক্ষনে সন্ধ্যা গড়িয়ে প্রায় রাত, আমি বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় ফিরলাম। পরদিন কোর্টে শুনানী, আমার আইনজীবির কাছে নোটিসের কোনো কপি নেই। তিনি এতো বড় মাপের একজন আইনজীবি (এটোর্নী জেনারেল) হয়েও সেদিনই রাতে আসলেন আমার বাসায় নোটিশের কপি নিতে। সারাদিন থানা পুলিশ আর আমার প্রাক্তনের দ্বারা মানসিক, শারিরীক আর সামাজিক ভাবে হেনস্তা হওয়ার পরেও পরদিন কোর্টে যাওয়ার সাহস যোগাতে হয়েছিলো কারণ আর যাইই হোক আমার বাচ্চাকে আমি হারাতে চাই না। আমি সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিলাম সামাজিক ভাবে নিজের আর বাচ্চাগুলোর হেনস্তা হওয়ার জন্য। সারাদিন থানায় আমরা সবাই অভূক্ত, সেখান থেকে ফিরে আমি খেতেও পারিনি। মনে হচ্ছিলো এর চেয়ে চাবুক দিয়ে কেউ গায়ে কয়েকটা বাড়ি দিলে বরং ভাল হতো।
পরদিন রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক জ্যাম, গাড়ী নড়ে তো নড়ে না। তার উপর ফোন কলের পর কল, মায়ের চিল্লাচিল্লি.. টেনশনে মাথা উলোট পালট, পৌঁছাতে আধ ঘন্টা দেরি। হাই কোর্টের কোনো গেইট চিনি না। যাও গিয়ে পৌঁছালাম দেখি প্রাক্তন তার ভাই বন্ধু বান্ধব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাজ রুমের পাশে। আমার মাননীয় আইনজীবি আমার উপর ভীষন ক্ষ্যাপা দেরির কারণে। আমার স্কুল বান্ধবী (উকিল) ছিলো সেদিন আমার পাশে, আর ছিলো “আইন ও শালিস কেন্দ্র” এর আইনজীবি।
আমি কোর্টে যাওয়া মাত্রই হুট করে আমার কাছ থেকে ছেলেকে কোলে নিয়ে নিল তার বাবা। আমি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছিলো আর বলছিলো, “দেখিস, তোর গায়ের ছায়া যেনো না লাগে!" (মানে আমি এতোই অপবিত্র, আমার ছায়া লাগলে ওদের ক্ষতি হবে।)
ওদের ভাবটা ছিলো যেনো সেদিনই বাচ্চাকে নিয়ে ওরা চলে যাবে। শুনানীর জন্য ডাকা হলো যখন, আমার উকিল বললেন "আপনাকে যেতে হবে না"। ওরা সবাই জাজ রুমে গেলো। মাত্র দশ মিনিটের মাথায় সবাই বেরিয়ে আসলো। সেদিনকার জয়টা আমার হয়েছিলো কারণ তারা বাচ্চাকে আবোল তাবোল বোঝানোর সময় সুযোগ পায়নি। আর আমার বিরুদ্ধে যা যা সাক্ষী প্রমাণ তারা জমা দিয়েছিলো তা মহামান্য বিচারপতি দেখেনই নাই। কারণ বাচ্চার বয়স মাত্র তখন চার। বাচ্চা যেকোনো হালে মায়ের কাছেই থাকবে। আর সাক্ষ্য প্রমাণের বিশাল আয়োজন দেখে হয়তো আন্দাজ করাই গিয়েছিলো সব জোগাড় করা হয়েছে আমাকে হারানোর জন্যই। কারন আমার উকিল (বান্ধবী) জাজকে বলেছিলো যে তার বিবাদীকে থানায় আটকে রাখা হয়েছিলো গতকাল সারাদিন।
যুদ্ধ করতে মাঠে নামলে যারা পিছন থেকে আঘাত করে তারা জানে তাদের দূর্বলতা। তাই আমাকে কখনো বুঝতে দেয়নি কখনও আঘাত করা হচ্ছে বা হবে। কোর্টের রায়ে বাচ্চাকে আমার কাছে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত পারিনি। ওরা চোরের মতো আমার বাচ্চাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তখন বুঝিনি, দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করেছিলাম লোকটাকে। বাচ্চাকে নিয়ে গিয়েছিলো বেড়াতে নিয়ে যাবার নাম করে। সেই যে নিয়ে গেলো আর ফেরত দেয়নি। এখন আবার আইন আদালত করে ফেরত পাবার সম্ভাবনা নাই কারণ ওর বয়স আট পেরিয়ে গেছে। আর এতোদিনে ওরা বাচ্চাটাকে কীসব বুঝিয়েছে, বলেছে আমি জানি না। যাও মাসে দুইমাসে তার সাথে দেখা করতে দেয়, আমার বাচ্চা এখন আমারই সাথে কথা বলতে চায় না।
আজো চোখে ভাসে বাচ্চার ডাইরিয়া আর পেট ব্যাথা থাকা সত্বেও বিশ্বাস করে পাঠিয়েছিলাম। সে তার বাবার হাত ধরে পিছন ফিরে আমাকে টা টা দিতে দিতে গিয়েছে। কে জানতো সেই বাচ্চা আমার কোলে তারা আর ফিরিয়ে দেবে না!