মাজুল হাসান

কবি ও গল্পকার জন্ম : ২৯ জুলাই ১৯৮০, দিনাজপুর। পড়াশুনা করেছেন দিনাজপুর জিলা স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অর্নাস।। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: বাতাসের বাইনোকুলার ● বাঙলায়ন প্রকাশনী, ২০১০। মালিনী মধুমক্ষিকাগণ ● বাঙলায়ন প্রকাশনী, ২০১৪। ইরাশা ভাষার জলমুক ● চৈতন্য, ২০১৬। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: টিয়ামন্ত্র ● ভাষাচিত্র প্রকাশনী, ২০০৯। নাগর ও নাগলিঙ্গম ● বাঙলায়ন প্রকাশনী, ২০১২। অনুবাদগ্রন্থ: টানাগদ্যের গডফাদার, রাসেল এডসনের কবিতা ● চৈতন্য, ২০১৬। মাজুল হাসান পেশায় সাংবাদিক। বর্তমানে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বার্তা বিভাগে কর্মরত।

কাজুও ইশিগুরো’র সাক্ষাৎকার

প্রাককথন: ২০১৫ সাথে কাজুও ইশিগুরোর উপন্যাস দ্য ব্যারিড জায়ান্ট প্রকাশিত হবার পর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ভেনেটি ফেয়ারের স্টাফ ও সাহিত্য সমালোচক এন্ডারসন টেপার। এখন পর্যন্ত লেখা ইশিগুরোর সর্বশেষ উপন্যাস দ্য ব্যারিড জায়ান্ট। এটি প্রকাশিত হবার পর নিউইয়র্ক টাইমস রিভিউ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় এই বইটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা–সমালোচনা হয়েছে। বিশেষত ড্রাগনসহ এর কল্পভৌতিক উপাদান নিয়ে সমালোচনার তীব্র হুল সহ্য করতে হয়েছে ইশিগুরোকে। তাই তিনি বলেছিলেন—কেউ কেউ এর মূল উপজীব্য যুদ্ধবিরোধীতা ও স্মৃতি–বিস্মৃতির দ্বন্দ্ব পাশ কাটিয়ে অন্য বিষয়গুলো নিয়ে বেশি কথা বলেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন বইটির জেনার নিয়ে—এটা কি উপন্যাস, কল্পকাহিনি নাকি সাইন্সফিকশন (সাইফাই)। এই সাক্ষাৎকারেও সেই আক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়, যদিও জেনার নিয়ে চিন্তা করতে রাজি নন ইশিগুরো। এই সাক্ষাৎকারে বাড়তি পাওয়া ইশিগুরোর সাহিত্য বিষয়ক চিন্তাধারা, লেখন ও ভাবনা পদ্ধতিও। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ ভাষান্তর করেছেন কবি ও গদ্যকার মাজুল হাসান।

গুডরিডস: আপনি বলেছেন কিভাবে আপনি এর প্রাগৈতিহাসিক আবহটি গ্রহণ করেছিলেন, যাতে করে ইতিহাসের একটি শূন্য আধ্যায়ে আপনি যুদ্ধ ও সামষ্টিক স্মৃতিচেতনা নিয়ে কিছু বলতে পারেন। কিন্তু কিছু রিভিউ পড়ে কি আপনার মনে হচ্ছে না, সমালোচকরা যতটা এই বিষয়ে আলোকপাত করেছে তার চেয়ে বেশি মেতেছে অপরাপর বিষয় নিয়ে?

কাজুও ইশিগুরো: মোটের ওপর আমার মনে হয় আমি যা করতে চেয়েছি পাঠকরা তার সারমর্ম পেয়েছেন। কিন্তু আমি লক্ষ করেছি এবং আমি এতটা আশা করি নি যে, আমার মনে হয় আমি ঢুকে পড়েছি একটি বৃহত্তর বলয়ে চলমান একটি বিতর্কে যেটাকে আপনি বলতে পারেন ‘সিরিয়াস সাহিত্য’। এটা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে কয়েক যুগ আগে সাইফাই নিয়ে যা ঘটেছিল, এরপর তো সাইফাই তো অনেকখানি মেইনস্ট্রিমে চলে এসেছে, এখন কেউ এর অদ্ভুতুড়ে (ডিস্টোপেইন সেটিংস) ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। আমি সেইসব লেখকদের হতাশাগ্রস্ততাকে বুঝতে পারি, যাদের কাল্পনিক উপকরণ যেমন ড্রাগন বা অন্যকিছু ব্যবহার করতে দেয়া হয় না, এমন একটা লেখক-পাঠকের কমিউনিটি আছে যারা নিজেদের অপাঙ্‌ক্তেয় ভাবতে থাকে।

এই বইটা বের হওয়ার ফলে অনেক মানুষের সামনে একটা সুযোগ এসেছে, এই কাঠামোগত জায়গাটায় কী থাকতে পারে বা পারে না সেই বিষয়টি নিয়ে তারা নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে পারছে। আমার মনে হয় পরবর্তী জেনারেশন এসব ক্ষেত্রে অনেক বেশি উদার।

গুডরিডস: আপনার বইটা অবশ্যম্ভাবীভাবে আজকের দুনিয়ার কিছু জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনাকে উস্কে দেয়। কিন্তু এর মূলে তো নব্বই দশকে বলকান এবং রুয়ান্ডায় যা ঘটেছিল সেটাই?

কাজুও ইশিগুরো: আমি বলব ওসব বিষয় আমার আগ্রহকে চাগিয়ে দিয়েছে, যদিও সেই অর্থে সেগুলো আমার সাবজেক্ট মেটার ছিল না। আমি বড় হয়েছি কোল্ডওয়ারের ছায়ায়, ইউরোপের বেশির ভাগ মানুষের মতো আমিও ভাবতাম যেকোনো দিন পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে যাবে। ১৯৮৯ সালে কোল্ডওয়ারের সমাপ্তিতে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি এবং আশাবাদী হয়ে উঠি। কিন্তু ক’বছর যেতে না যেতে যুগোশ্লাভিয়ার আমরা বিভেদ হাঙ্গামা দেখলাম।  আমার মনে হয় তখন চাপা পড়া স্মৃতি আর শত্রুতা সার্ফেসে চলে এল, ঘটল উদ্‌গিরণ। কিছু বোঝার আগেই, আমরা আবারও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিক্ষেপিত হলাম, এবং সেব্রেনিৎসা গণহত্যা দেখে মনে হলো এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসা আরেকটা কিছু। রুয়ান্ডা অতটা কাছের নয়, কিন্তু ওখানেও খুব আতঙ্কজনক বর্বরতা হয়েছে। তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগল, যে মানুষগুলো এত বছর পাশাপাশি ছিল, কি এমন ঘটল যে তারা একে অন্যকে ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠল?

গুডরিডস: আরেক দিক দিয়ে দেখলে এই বইটা  অনেকটাই প্রেমকাহিনি, যদিও সেটা হয়তো প্রথাগত প্রেমের বই না…

কাজুও ইশিগুরো: হ্যাঁ। দ্য ব্যারিড জায়ান্টের বিষয়বস্তু আসলে প্রেমের—আমার মনে হয় প্রেম হলো একটা বিশাল যাত্রা যা মানুষ একত্রিতভাবে পাড়ি দেয়। এক্সেল আর বেট্রিসের দেখা হলো এবং ওরা প্রেমে পড়ল। আর যে কারণে এটা স্মরণ ও বিস্মৃতির উপন্যাস তাই প্রশ্ন ওঠে—কি হবে যখন আপনি ভিন্নভাবে পুরনো স্মৃতি মনে করতে শুরু করেবন? সেইসব কালো, অস্বস্তিদায়ক স্মৃতি নিয়ে আপনি কী করবেন? এমনটা জাতিগত জায়গাতেও, মানুষের মাঝে এমন স্মৃতি থাকে যা অতীতে মাটিচাপা অবস্থায় থাকে। সেগুলো মাথাচাড়া দিলে কি মানুষে মানুষে প্রেম শেষ হয়ে যাবে? অন্যভাবে যদি বলি, আপনি যদি সেসব স্মৃতি না-ও ঘাটেন, তারপরেও কি এই প্রেম অকৃত্রিম হয়ে যায়? আমার মনে হয় এক্সেল ও বেট্রিসের ডিলেমাও সেটা।  তারা প্রবৃত্তিগতভাবে তাদের স্মৃতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে, এবং তাদের ন্যূনতম আত্মবিশ্বাস ছিল যে তারা যাই আবিষ্কার করুক না কেনো তাতে তাদের প্রেম আর সুদৃঢ় হবে। কিন্তু বইয়ে ঘটনা যত গড়াতে লাগল তাদের মনে উঁকি দিতে লাগল সন্দেহ।

গুডরিডস: গুডরিডস সদস্য আলি আপনার বৈচিত্র্যময় কাজের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। উনি জানতে চান, আপনার আগ্রহের জায়গা এত বিচিত্র যে আপনার পরের বই সম্পর্কে আগাম অনুমান করা কঠিন… আপনি কিভাবে ঠিক করেন যে এই বিষয়টায় লিখবেন?’

কাজুও ইশিগুরো: আমি এটাকে সেটিং বা জেনার সম্পর্ক বলে ধরে নিচ্ছি। আমার বিষয়বস্তু গভীরভাবে ভাবলে স্মৃতি অথবা স্মৃতি ও বিস্মৃতির উভয়সংকট (ডিলেমা)। যদিও আমি সচেতনভাবে জেনার নিয়ে কিছু ভাবি না—সর্বতভাবে আমি যা চেষ্টা করি তা হলো গল্পটা যাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

গুডরিডস: পারসপেক্টিভ নিয়ে কিছু কথা। গুডরিডস সদস্য ডন লিপেন-এর কৌতূহল; দ্য ব্যারিড জায়ান্ট -এর বেশির ভাগ অংশ কেন আপনি উত্তমপুরষ (ফার্স্ট পার্সন) বর্জন করলেন?

কাজুও ইশিগুরো: দুটো প্যাসেজ আছে একটা গোয়াইন ও অন্যটা একদম শেষে বোটম্যানের, দ্য ব্যারিড জায়ান্ট-এর অন্য সবখানেই থার্ড পার্সনের হয় এক্সেল অথবা বালক এডউইনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম উপর্যুপরি ফাস্ট পারসনের বয়ানকে এড়িয়ে যাওয়ার, কারণ আগাগোড়া আমার ইচ্ছা ছিল এমন একটি উপন্যাস লেখা যা একটা সমাজের স্মৃতি, কোনো একক ব্যক্তির নয়। দ্য রিমেইন অফ দ্য ডেস এবং নেভার লেট মি গো—এই বইগুলোর জগৎ একটি চরিত্রের মধ্যেই বিরাজমান; কিন্তু একটি জাতি ও তাদের সামষ্টিক স্মৃতি বলে কথা, আমার মনে হয়েছে আমি তেমনটা করতে পারি না। শুরু থেকেই আমার মনে হয়েছে, একটা বড় ক্ষেত্রে আলোকপাত করতে হলে আমাকে উত্তমপুরুষ (ফাস্ট পারসন) থেকে বেরুতে হবে।

গুডরিডস: দ্য রিমেইনস অফ দ্য ডে এবং নেভার লেট মি গো’র চলচ্চিত্রায়ন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

কাজুও ইশিগুরো: দুটো মুভি নিয়ে আমি দারুণ সন্তুষ্ট। এটা আমাকে গভীর সুখানুভব দিয়েছে যে একটা কাহিনি যেটা আমি কল্পনা করেছি, সেটা নিয়ে অন্য প্রতিভাবান লোকেরা তাদের নিজেদের সৃষ্টিকর্ম হিশেবে তৈরির চেষ্টা করেছেন। আমি চাই চলচ্চিত্রের নিজস্ব শৈল্পিক দৃঢ়তা। আমার উপন্যাসের অনুগামিতার চেয়ে এটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ।

গুডরিডস: আপনার লেখন প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু বলুন। কোনো ইউনিক মেথড বা রুটিন?

কাজুও ইশিগুরো: হয়তো আমি অন্য লেখকদের থেকে আলাদা নই, সম্পূর্ণ ড্রাফ্ট করার চেয়ে আমি একটা একটা ব্লকের পর ব্লক ফেলে এগুতে পছন্দ করি। এক্ষেত্রে একটাই ব্যতিক্রম—নেভার লেট মি গো। ওটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটানে লিখেছি। কিন্তু অন্য বইগুলোর বেলায় আমি ৩০-৪০ পৃষ্ঠা খুব সচেতনভাবে লিখেছি, চারপাঁচ বার রিভাইস দিয়েছি, দেখেছি কোনো ভুলচুক হলো কিনা? আরেকটা নতুন ব্লক তৈরির আগে আমি নিশ্চিত হতে চেয়েছি আমি মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য ও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছি। আমি যথেচ্ছা শৈল্পিক সিদ্ধান্ত নিতে চাই না যেটা বইয়ের পরবর্তী অংশে জটিলতা তৈরি করে।

গুডরিডস: যখন আপনি লিখতে শুরু করলেন তখন কোন বইগুলো বা কোন লেখকরা আপনাকে প্রভাবিত করেছিল?

কাজুও ইশিগুরো: শার্লোট ব্রোন্টির দুটো উপন্যাস জেন এয়ার এবং ভিলেট;  আমার ওপর ভিলেট-এর প্রভাব ছিল মারাত্মক। টিনএজে দস্তেভয়েস্কিকে ভালোবাসতাম। আর আমি আমার জেনারেশনের অনেক লেখককে ভালোবাসি, জ্যাক ক্যারোয়াক-এর অন দ্য রোড আমার কাছে বই আর রক মিউজিকের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন। এখানে ব্রিটেনে বেড়ে ওঠার সময়; আমার স্বপ্ন ছিল অ্যামেরিকা ও হিটচ্যাক যাওয়া, কারণ আমি সেইসব মার্কিন রক গানগুলো শুনে ফেলেছিলাম। আমার মনে হয় তেমন উদ্দীপনার উদ্ভাস শুধু ক্যারোয়াক-এর অন দ্য রোড-এর মতো বইয়েই থাকা সম্ভব। এটা পড়ে আমার ধারণা জন্মালো ‘বই একটা দারুণ ব্যাপার’।

গুডরিডস: আপনি কি একজন লেখক হিশাবে নিজের সম্পর্কে সচেতন?

কাজুও ইশিগুরো: হ্যাঁ। হ্যাঁ।(হাসি)। আমার যে আয়তনের (পরিসর) পাঠক, ব্যাপারটা আমার কাছেই একটা অদ্ভুত দুর্ঘটনার মতো। নিশ্চয় আমি সৌভাগ্যবান, আমার বইগুলো যাকে বলে সাহিত্যবাজারের বাইরেও সাড়া ফেলেছে। মুভিগুলো সাহায্য করেছে। ভেতরে ভেতরে সব সময় একটা চিন্তা কাজ করে—এতবড় পাঠককুলের কোন অংশটার দিকে আমার মনোযোগ দেয়া উচিত? আমি কি আমার মগজে তাদের বহন করি, জনসংখ্যাগত দিক থেকে, ভৌগোলিক দিক থেকে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে? নাকি আমার যা করার তা করে যাব আর তারা আমাকে অনুস্মরণ করবে?

2320 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।