সাঈদা সুলতানা এ্যানি

আর্কিটেক্ট, এক্টিভিস্ট।

দুঃখ : জীবনের নিখাদ উপলব্ধির নাম

মাঝে মাঝে পৃথিবীতে নিজেকে বড় একা আর অসহায় লাগে

আজ যেমন।
আমার বুয়া খুব অসুস্থ। জীবন মরণের সীমানায়।
সতেরো বছর আগে একদিন আমার সংসারে এসেছিলেন তিনি। সাধারণের চেয়ে লম্বা, ধবধবে ফর্সা, অপূর্ব সুন্দর চেহারার একটা মানুষ। পান খান আর খালি হাসেন। খুব ভালো রান্না করেন। আমার সংসারটা মায়ায় ভরিয়ে দিলেন। টুকটাক ভুল ত্রুটি হলে যে বকা দেবো তার জো নেই। সব কথার উত্তর ওনার হাসি। পান খাওয়া লাল ঠোঁটে হাসি যেন ধরে না। আমার বাচ্চারা ওনার চোখের মণি। বাচ্চারা ওনাকে দাদু বলে ডাকে।
খেতে ভালোবাসতেন খুব। আর আমি সব সময় চাই আমার কাছে যারা থাকে তারা যেন স্বাধীন ভাবে থাকে। যা ইচ্ছা খায়। যেমন ইচ্ছা চলে। আমি নিজেও খুব ধরাবাঁধা নিয়মে সংসার করতে পছন্দ করি না।
চড়ুইভাতির মতো সংসার আমার পছন্দ।

বুয়া বছর খানেক পরপর একবার বাড়ি যেতেন চির বিদায় নিয়ে। যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েই কাঁদতে শুরু করতেন আমাদের জন্য। আমি জানতাম উনি আবার ফিরে আসবেন। ঠিক চলে আসতেন। 

মাত্র তেইশ বছর বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। তিনটা বাচ্চা তখন। আর একটি বাচ্চা পেটে। বাবার মৃত্যুর পর জন্ম নেয়া মেয়ের নাম রাখলেন "দু:খ"।

সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে এই অপূর্ব সুন্দর মানুষটা আর বিয়ে করলেন না। সব মেয়েদের ভালো বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন। কিন্তু উনি কারো উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেই উপার্জন করতেন। দৃঢ়চিত্ত, অসীম জীবনীশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ। জীবনে কতো যুদ্ধ, কতো একাকী পথ পার হলাম, কতোজন আসলো গেলো, বুয়া কখনো আমাকে ছেড়ে গেলেন না। উনি আমার প্রচন্ড সুখ দেখেছেন আবার দু:খও দেখেছেন। আমার জীবনের অনেক ঘটনার নীরব স্বাক্ষী উনি। তাই আমার জন্য ওনার চোখে বাঁধভাঙ্গা জল।

ওনার চোখে আমি সুন্দরতম মানুষ। আমার উপর মানুষের নজর আছে মনে করতেন। পান পড়া দিয়ে ঝাড়ফুঁক করতেন প্রায়ই! বাচ্চাদের ওনার জন্য বকা দিতে পারতাম না কখনো।

হাইব্লাড প্রেশার ছিলো। অসুস্থ হয়ে পড়তেন মাঝে মাঝে। কাজ করতে পারতেন না। নতুন কাজের লোক দেখলে চোখ ছলছল করতো বলতেন 'আপা আমারে বিদায় করে দেবেন?' আমি বলতাম আমি কাউকে বিদায় করি না। আমার দুয়ার সব সময় খোলা যখন ইচ্ছা আসবেন যাবেন। ধীরে ধীরে বয়স বাড়লো। সতেরো বছরতো কম সময় নয়। গত পাঁচবছর আগে বাড়ি যেয়ে ফিরলেন একবছর পরে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ কুঁজো হয়ে গেছেন। সব চুল চোখের পাতা সাদা হয়ে গেছে।

সেই অবস্থায় আমাদের সব কাজ করছেন। আমি ওনার মনোবল দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, গুছানো। অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। কোনো বাড়তি চাওয়া নেই। এমনকি নিজের বেতনটাও চাইতেও লজ্জা পেতেন। গত বছর বেশি অসুস্থ হয়ে বললেন আপা আর কাজ করবো না যাই। চলে গেলেন। গত ক’মাস আগে আবার আসলেন আমার জন্য দু’জন মানুষ নিয়ে। আসলে যেখানেই থাকেন ওনার মন পড়ে থাকতো আমার চিন্তায়। এবার শরীর বেশি খারাপ। একটা চেয়ারে বসে সারাদিন আমাদের নজরে রাখেন, সারারাত এবাদত করেন। আর আমি ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই ওনার স্পর্শে চমকে উঠতাম। যে মানুষ টা দাঁড়াতে পারে না আমার পা টিপছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি জোর করে সরিয়ে দিতাম।

একদিন বললেন আমার কাছে যদি টাকা থাকতো আপারে একটা নীল শাড়ি কিনে দিতাম। এভাবে আমার আর আমার সন্তানদের স্পর্শের মায়া আর আদরে আগলে রেখেছেন এই মমতাময়ী।
আমি একদিন বললাম "বুয়া আপনার একটা ইচ্ছার কথা বলেন। যদি আমি পূরণ করতে পারি।" 
অন্তত একটা মানুষের ইচ্ছাপূরণ।
আহা মানুষ! 

অনেক ভেবে বললেন "চিটাগাং দেখতে মন চায়।" 
আর দিন পনেরো আগে বললেন দোকানের আলু দেয়া পোলাও খাবেন অর্থাৎ কাচ্চি বিরিয়ানি।

তখন উনার পেটটা ভালো ছিলো না। তাই আমি ভাবলাম একটু সুস্থ হোক। এভাবে আমাদের জীবনের সাথে আষ্টপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মানুষটা আজ স্ট্রোক, হার্ট এটাক, নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে।
আমি তীব্র অপরাধ বোধে ভুগছি, আমি কি আমার দায়িত্ব ঠিক পালন করেছি? আমি চিটাগাং নিলাম না, কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ালাম না। ঠিক চিকিৎসা করাচ্ছি তো?

আজ বিকেলে হাসপাতালে আমি আমার অজান্তে বলে ফেললাম, 
বুয়া, আমাকে ফেলে যাবেন না।
আমি কি বললাম আর উনি কি বুঝলেন জানি না আমাদের দু’জনের চোখ বেয়ে নীরবে পানি ঝরছিলো কেবল।

আমি আশা করি উনি আবার আমার কাছে আসবেন।

4500 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।