মাহমুদা পারভীন

১৯৭১ সালে জন্ম নেয়া মাহমুদা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে সম্মান শেষ করার পরে "কবি নজরুল সরকারি কলেজ"-এ শিক্ষকতার সাথে যুক্ত আছেন।

ফুলগুলো যেনো কথা (প্রথম পর্ব)

১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন। বাটাভিয়া, সুরকর্তা, টাইপিং, বালি বেড়িয়ে একদিন গেলেন জাভা দ্বীপের রাজা সুসুহুনন এবং রাজপুত্র অভিমন্যুর আমন্ত্রণে রাজবাড়ীতে। সেইবার রাজা রবীন্দ্রনাথকে অনেক উপহার দিলেন। দ্বীপগুলোর প্রকৃতি তো কবিকে মুগ্ধ করেছিলোই, সেই সাথে উপহারের একটা কাপড় এবং এর রঙ, নকশা তাঁকে অভিভূত করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো এই বিশেষ কাপড় পরার অধিকার কেবল রাজকীয় মানুষেরই রয়েছে। তিন মাসের এই ভ্রমণে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী ছিলেন শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ কর। কবির আগ্রহে শিল্পী সুরেন কর জাভা দ্বীপের শিল্পীদের কাছে শিখে নিলেন এই কাপড়ের নকশা এবং রঙের পদ্ধতি। শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিবারেরই প্রতিষ্ঠিত আরেক প্রতিষ্ঠান "শ্রীনিকেতন" এর কর্মীদের এক বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। জাভা থেকে শিখে নেয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে শিল্পী সুরেন কর কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিলেন এবং কর্মীরা কাপড়ে দারুণ সব নকশা করা শুরু করলেন। নতুন এই কাপড় ভারতে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে গেলো। শ্রীনিকেতনের এই শিল্পে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলো। জাভা দ্বীপ থেকে আগত পদ্ধতিতে তৈরি নতুন এই কাপড়ের নাম "বাটিক"। এটা জাভানিজ ভাষার শব্দ।

এই "আফ্রিকান ডেইজি"/"গাজানিয়া" ফুলগুলো শীতে অনেক ফোটে। এইবার গরমে হঠাৎ হঠাৎ ফুটে আমাদেরকে অবাক করছে।

ডি.এল.রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার রায় ঢাকায় আসবার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে গেলেন। বন্ধুকে বিদায় দিতে সঙ্গে গিয়েছেন কবি নজরুল। ট্রেন ছাড়ার বাঁশি বেজে উঠলে পরে কী মনে করে এক কাপড়ে এক লাফে নজরুল ট্রেনে উঠে গেলেন। দিলীপ কুমার সেইবার ঢাকায় এসেছিলেন পুরনো ঢাকার বনগ্রামের রানু সোমকে তালিম দেয়ার জন্য। রানু সোম তখন ঢাকার বিখ্যাত গায়িকা। নজরুল প্রতিদিন বন্ধুর সাথে রানুদের বাড়িতে যান। তো একদিন নজরুলের গানের আসর বসেছে, এমন সময় রানুর মা সরযুবালা সোম ট্রে ভর্তি চা নিয়ে আসরে ঢুকলে পরে নজরুল হঠাৎ গেয়ে উঠলেন –

"এত চা ও পেয়ালার পরে আনলে বল কে"

পরদিন রানু নজরুলকে একা পেয়ে বললেন – "কাল যে চা নিয়ে গানটা বাঁধলেন, তার সুরটা ভারী মিষ্টি।"

নজরুল মুখ তুলে তাকালেন রানুর কাজল টানা চোখের দিকে এবং সাথে সাথে হারমোনিয়াম টেনে আগের দিনের সুর অবিকৃত রেখে তার উপর নতুন কথা বসিয়ে গেয়ে উঠলেন –

"এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী আনলে বল কে।"

রানু সোম পরবর্তী জীবনে খ্যাতি লাভ করেছেন লেখক প্রতিভা বসু নামে। বেশ কিছু বিখ্যাত সিনেমার চিত্রনাট্য ও তিনি লিখেছেন, তার মধ্যে অন্যতম "পথে হলো দেরী"। প্রতিভা বসুর স্বামীর নাম কবি বুদ্ধদেব বসু।

কাজল টানা চোখের এই ফুলের নাম "black eyed Susan"।

অতুলপ্রসাদ সেন তখন লখনউ এর খ্যাতিমান ব্যারিস্টার। একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলার কাজে অতুলপ্রসাদ গেলেন লখনউ কোর্টে। মামলার প্রয়োজনীয় নথিপত্র এবং গাউন নেবার জন্য তিনি ব্রিফকেস খুলে হতবাক হয়ে গেলেন! কারণ গাউন এবং নথিপত্র কুচি কুচি করে কাটা, বুঝতে পারলেন এই কাজ করেছেন তার স্ত্রী হেমকুসুম!! ভীষণ হতাশ হয়ে তিনি বাড়ি ফিরে এসে দেখেন বাড়ি খালি!! হেমকুসুম একমাত্র ছেলেকে নিয়ে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। স্ত্রীর বিরহে অতুলপ্রসাদ ভীষণ কাতর হয়ে গেলেন। এর মধ্যেই এলো একটা আনন্দের খবর। রবীন্দ্রনাথ লখনউ আসছেন এবং উঠবেন অতুলপ্রসাদের বাড়িতে। আনন্দের পাশাপাশি তিনি খালি বাড়ির কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে মহামান্য অতিথির খবর পেয়ে হেমকুসুম পরদিনই বাড়ি ফিরে এলেন। রবীন্দ্রনাথ সেইবার বেশ কিছু দিন অতুলপ্রসাদ এর বাড়িতে ছিলেন, দারুণ দারুণ সংগীতের আসর বসেছে সেইসব দিনগুলোতে। একদিন রবীন্দ্রনাথ বিদায় নিলেন। প্রফুল্ল মনে অতুলপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরে শোনেন হেমকুসুম আবার ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন!

প্রিয়তম স্ত্রীর এহেন অম্ল মধুর কাণ্ডকীর্তিতে বিমর্ষ হয়ে অতুলপ্রসাদ একটা গান লিখলেন –

"ওগো নিঠুর দরদি, এ কী খেলছ অনুক্ষণ?

তোমার কাঁটায় ভরা বন, তোমার প্রেমে ভরা মন।।"

এই নিঠুর গোলাপ বর্ষায় আবার ফুটেছে। কিন্তু গ্রিলের বাইরে, তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কারণ তার কাঁটায় ভরা গা!

 

 

1345 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।