ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

ম্যাচো ম্যানদের দীর্ঘ আধিপত্যের যুগ শেষ হতে চলেছে

আমার আব্বার সাথে আম্মার বয়সের পার্থক্য ছিলো দশ বছরেরও বেশি। এটা সেই সময়ের জন্য অস্বাভাবিক কিছু না। তাঁদের প্রজন্মের প্রায় সকল স্বামী স্ত্রীরই বয়সের ব্যবধান ওরকম ছিলো। দাদা-দাদি, নানা-নানি প্রজন্মের ক্ষেত্রে হয়তো সেই ব্যবধানটা আরো বেশিই ছিলো। পরিবারের মধ্যে আমিই প্রথম বিপ্লবী ভূমিকা নেই। ছাত্রত্ব শেষ হবার সন্ধিক্ষণেই বিয়ে করে ফেলি আন্নাকে। আন্না আমার সহপাঠিনী ছিলো। এটা নিয়ে আড়ালে আবডালে সমালোচনাও হয়েছে। কেউ কেউ আন্না আমার চেয়ে বয়সে বড় এই রসালো বক্তব্যও ছড়িয়েছে নানা দিকে। বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। আন্না আসলে আমার চেয়ে চার মাসের ছোটো। বয়সে বড় হলেও কিছু আসতো যেতো না আমার কাছে। আমি যেহেতু আড়ালের কথাকে কোনো গুরুত্ব দেই না, উপেক্ষা করে চলি, এটা আমাদের জন্য কোনো সমস্যা হয়ে আসে নি।

স্বামী স্ত্রীর বয়সের এই ব্যবধান ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। শুধু কমেই যে আসছে তাই না, ইদানীং অনেক নারীই তাদের চেয়ে কম বয়সী পুরুষ বিয়ে করছে। পাশ্চাত্যে এটাকে সহজভাবে নিলেও, আমাদের দেশে সহজভাবে নেওয়া হয় না। কয়েক বছর আগে সুবর্ণা মুস্তফা সৌদকে বিয়ে করার পরে তীব্র সমালোচনা নেমে এসেছিলো মিডিয়া জুড়ে। আমাদের দেশে সুবর্ণা ব্যতিক্রম হলেও পাশ্চাত্যের মিডিয়া জগতে এটা বিরল কিছু না। ডেমি মুর, ম্যাডোনা, এঁরা নিজেদের বয়সের চেয়ে অনেক ছোটো ছেলেকে বেছে নিয়েছেন নিজেদের সঙ্গী হিসাবে।

আমাদের দেশে সুবর্ণাকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলেও, নারীদের ক্ষেত্রে নিজেদের চেয়ে বয়সে কম ছেলে বিয়ে করার সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম না। মিডিয়া জগতে যেতে হবে না, আমাদের আশেপাশে তাকালেই আমরা এখন এগুলো দেখতে পাই।

প্রচলিত ধারণা হচ্ছে নারী কর্কশ ধরনের প্রকৃত পুরুষ পছন্দ করে। এই প্রকৃত পুরুষের সাথে মিল রয়েছে তার বহু আগের গুহায় বসবাস করা পূর্বপুরুষের। আধুনিক যুগের পালিশ করা পুরুষ তার পছন্দের আওতায় পড়ে না। অন্যদিকে পুরুষের ক্ষেত্রে পছন্দ হচ্ছে নরম, কোমল এবং নমনীয় নারী। এই নারী তার রিপুর চাহিদা পূরণ করবে, তার সন্তান ধারণ করবে। কিন্তু, এখনকার বাস্তবে এসে দেখা যাচ্ছে নারী এবং পুরুষের এই চাহিদা আসলে প্রচলিত ধারণার সাথে মিল রাখছে না।

পুরুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়, টিন এজ বয়সে এরা এদের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় নারীকে আদর্শ প্রেমিকা হিসাবে চিন্তা করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই চিন্তা-ধারা ভিন্ন হতে থাকে। ষাট বছরে পৌঁছার পরে সেই একই পুরুষ মনে করে তার আদর্শ সঙ্গিনী তার চেয়ে পনেরো বছরের ছোট বলে বিবেচনা করে। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে, পুরুষরা যাদেরকে আদর্শ সঙ্গিনী হিসাবে বিবেচনা করছে, সেই নারীরাও এখন তাদের চেয়ে বয়সে বড় পুরুষের বদলে স্বল্পবয়েসী ছেলেদের দিকে ঝুঁকছে।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ডঃ নরেন্দ্র সিং এর করা একটা নতুন গবেষণায় দেখা যায়, পঁয়ত্রিশ বছর পার হবার পরেই পুরুষের শুক্রাণুর সংখ্যা এবং মান কমতে থাকে আশংকাজনকভাবে। নানা ধরনের উর্বরতা চিকিৎসার কারণে মেয়েদের সন্তান জন্মদানের সময় বর্তমান যুগে এসে যেখানে পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে পুরুষের উর্বরা শক্তি অনেক আগেই ব্যাহত হচ্ছে। ভায়াগ্রার রমরমা যে বাজার, সেটার জন্য পুরুষের এই করুণ দশার বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

নারীদের স্বল্পবয়েসী পুরুষের প্রতি ধাবিত হবার এই কারণকে নৃবিজ্ঞানী ডেসমন্ড মরিস ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্নভাবে। তাঁর মতে, নারীদের এই প্রবণতা আসছে সমাজে নারীর আধিপত্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি হবার কারণে। মসৃণ চামড়া, মেয়েলী চেহারা এগুলো তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য। তিনি বলেন, পুরুষের এই ধরনের নমনীয় চেহারা নারীদের শুধুমাত্র যৌনভাবে আকর্ষণই করছে না, একই সাথে তাকে মাতৃত্বের অনুভূতিও দিচ্ছে। নারীরা যদি আধিপত্যবাদী হতে চায়, তবে ক্রমান্বয়ে তারা বালক চেহারার দিকে ঝুঁকবে।

পুরুষ যেখানে যৌনতার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌঁছায় উনিশ বছর বয়সে, সেখানে নারীর পূর্ণতা আসে তিরিশ বছর বয়সে। এটাও আরেকটা কারণ হতে পারে নারীর ক্ষেত্রে অল্পবয়েসী সঙ্গী বেছে নেবার। যদিও নারী তার সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারায় একটা বয়সে গিয়ে, পুরুষের ক্ষেত্রে এটা ঘটে না। কিন্তু, আশ্চর্যজনক হচ্ছে, বয়স্ক পুরুষের যৌন চাহিদা যেভাবে হঠাৎ করে নীচের দিকে নেমে আসে, বয়স্ক নারীর ক্ষেত্রে তা ঘটে না। চল্লিশের পরেই পুরুষের যৌনচাহিদা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশোর্ধ নারীদের ক্ষেত্রে চাহিদা কমে আসার প্রবণতা কম।

সেক্সুয়াল সিলেকশনের ডারউইনিও তত্ত্ব যেখানে দাবি করে, নারী বেছে নেবে আক্রমণাত্মক স্বভাবের সুঠামদেহের সুদর্শন পুরুষকে, যার সফল হবার সম্ভাবনা বেশি, আধুনিক নারী সেই তত্ত্বকে অস্বীকার করে বেছে নিচ্ছে অপেক্ষাকৃত শান্ত স্বভাবের কোমল পুরুষকে।

২০০২ সালে স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সেইন্ট এন্ড্রুজের মনোবিজ্ঞানীরা একটা মজার গবেষণা করেছিলেন। ছাত্রদের মধ্য থেকে বেশ কিছু ছবি জোগাড় করে, চৌত্রিশজন নারীকে সেগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নম্বর দিতে বলা হয়েছিলো। নারীদের জন্য আদর্শ পুরুষের যে চিত্র সেখানে উঠে এসেছিলো তার বৈশিষ্ট্যগুলো এরকম। বড় বড় চোখ, মসৃণ চামড়া, সমবিন্যস্ত মুখমণ্ডল, খাড়া নাক এবং মসৃণ চোয়াল। গবেষকরা স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তাদের আদর্শ পুরুষ দেখতে খানিকটা মেয়েদের মতো। এর ভিত্তিতে তারা এই উপসংহারে পৌঁছান যে, আধুনিক নারী পুরুষালী রাফ এন্ড টাফ সৌন্দর্যের বদলে মেয়েলী যত্নবান বৈশিষ্ট্যকেই প্রাধান্য দেয়। যে সব পুরুষের চেহারা দেখলে বোঝা যায় তারা বাচ্চাদের খাওয়াতে পারবে না, গোসল করাতে পারবে না বা ডায়াপার চেঞ্জ করতে পারবে না, মেয়েদের পছন্দের তালিকা থেকে তারা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।

ম্যাচো ম্যানদের দীর্ঘ আধিপত্যের যুগ শেষ হতে চলেছে, আসছে মিনমিনে স্বভাবের মেয়েলী পুরুষদের পরম সময়।

1674 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।