সুষুপ্ত পাঠক

বাংলা অন্তর্জালে পরিচিত "সুষুপ্ত পাঠক" একজন সমাজ সচেতন অনলাইন একটিভিস্ট ও ব্লগার।

মা-মাসিদের রকেট উৎক্ষেপণ

ভারতের চন্দ্রাভিযানে ৫৪ জন নারী বিজ্ঞানীর নেপথ্য ভূমিকা দেখে বিস্ময় হতবাক উচ্ছ্বাস উল্লাস চলতে চলতে কিছু কথা বলে নেয়া উচিত বলে মনে করছি। প্রথমত 'আরে মহিলাগো বুদ্ধি' উপমহাদেশের পুরুষদের এই অবজ্ঞার দিন শেষ হতে চললো...। ইন্টারনেট আসার পর মানুষের জানার পথ সহজ হয়েছে। যেমন আমি এখন বলছি, আমাদের মহাকাশে উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রের নাম 'বিভা'। HD 86081 তারাটি আবিষ্কারের পর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল ইউনিয়ন এই তারাটি কোলকাতার নারী বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরীর নামে নামকরণ করে। বিভা চৌধুরী কসমিক রশ্মি ও পার্টিক্যাল ফিজিক্সের উপর অসামান্য কিছু গবেষণা করায় তাকে এই সম্মানটুকু দেয়া হয়েছিলো। ফলে আজ আপনি জানতে পারলেন মহাকাশ গবেষণায় নারী বিজ্ঞানীদের উপস্থিতি নেহাত কম নয়। আজকের তরুণটি তাই কখনো মেয়েদের বুদ্ধিভিত্তিক লেবেল নিয়ে কটূক্তি করতে গেলেই থেমে যাবে। কারণ সে জানে তার জ্ঞানবুদ্ধি থেকে বিভা চৌধুরীর জ্ঞানবুদ্ধি নিশ্চয় অনেক এগিয়ে ছিলো। বিভা চৌধুরী দেখতে আমাদের মা-মাসি-খালাদের মতন! শাড়ি পরা এই মাসি-পিসি টাইপের বিজ্ঞানীকে দেখলে মনে হয় এইমাত্র বুঝি রান্নাঘর থেকে শাক চচ্চড়ি করে আসলেন...। মেমসাহেব হলে না হয় একটু আধটু উপমহাদেশীয় পুরুষদের সম্ভ্রম জাগতো। কিন্তু এ যে বিভা মাসি... তার এত বুদ্ধি? তবে যে পাড়ার সবজান্তা পিশেমশাই বলেন, মেয়েমানুষের বুদ্ধি ছোঁ!...

ভারতীয় মহাকাশ গবেষণায় ৫৪ জন নারী বিজ্ঞানী নিয়ে আমাদের আগ্রহের মূল কারণটি এখানেই। আপনার কন্যাটি, আপনার বোনটি, আপনার স্ত্রী, প্রেমিকাকে মনের গভীরে যে গোপন পুরুষতান্ত্রিকতায় আপনার চেয়ে দুর্বল মনে করেন সেটির দেয়ালে একটি আঘাত আজ হানতে পারে। আপনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভারতীয় নারী বিজ্ঞানীদের দিকে একটু চেয়ে দেখুন। মনে হচ্ছে না আমাদের পাড়ার পরচর্চাকারী মাসি-খালাম্মাদের গ্রুপ? ঐ যে বাচ্চাদের স্কুলের সামনে নারীদের দেখেন, যাদের টপিক নিয়ে হাস্যরস করেন, তারা সকলেই আমাদের সামাজিক ভিকটিমের শিকার। তাদের 'গৃহবধু' বানিয়ে রেখে তাদেরকে নিয়েই করছি মশকারা! এই ৫৪ জন নারীকে দেখে তাই পুরুষতন্ত্র ভয় পাচ্ছে! এভাবে চলতে দিলে কি পুরুষকে নারীরা 'মানবে'? নারী হলো পুরুষের পোষা গৃহপালিত প্রাণী। একদম অনুগত। তার সম্পত্তি। তাকে খাবে, ছিঁড়বে, মারবে... যা খুশী তাই। কিন্তু চাঁদের দক্ষিণ মেরুর মাটির নিচে কী আছে, এমন চিন্তা করা নারী তো পুরুষতান্ত্রিক পুরুষকে ভীত করবেই। ফলে আজকের উচ্ছ্বাসের আড়ালে ক্ষুব্ধ ছদ্মবেশী পুরুষতান্ত্রিকতাকেও মাথায় রাখতে হবে।

পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীর হাতেই সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল। ফলে নারীদের সেই সভ্যতায় কীর্তিমান পুরুষের সংসার সামলানোর পিছনেই সময় ব্যয় হয়। কয়েক হাজার বছরের এই সামাজিক পরিস্থিতিতে নারীদের মনোজগতই হেঁসেল কেন্দ্রিক হয়ে যায়। সমাজে প্রচলিত হয় নারীরা পুরুষদের চেয়ে মেধায় দুর্বল। যদিও ইতিহাসে ক্লিওপেট্রা নামের মিশরীয় নারী সম্রাজ্ঞীর কথা আমাদের জানালেও আমরা সেটা ভুলে যাই। গত তিন হাজার বছর ধরে যত ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারা সকলেই নারীকে পুরুষের চেয়ে বুদ্ধিতে পিছিয়ে উল্লেখ করেছে। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের বড় শত্রু হয়ে দেখা দিয়েছিলো আসলে বিজ্ঞান। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে মানুষ জানতে পারছিলো হোমোসেপিয়েন্স নারী পুরুষের মেধার সক্ষমতা একই। মানব সভ্যতায় কৃষিকাজের সূচনাই করেছিলো নারীরা। ফলে তারা সে সময় পেশীবহুল নারী ছিলো সেটি স্পষ্ট।

ভারতে নারীদের অবস্থান খুব ভালো সেটি বলা যাবে না। কন্যা সন্তান জন্মের ভয়ে ভ্রূণ হত্যার মতো ঘটনায় ভারতে নারীদের কী চোখে দেখা হয় সেটি স্পষ্ট। নারীদের আজও ভারতে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হয়-- সেটি একজন বাবার, একটি পরিবারের জন্য রীতিমত বোঝা। একটি মেয়ের "সতীত্ব" ঠিকঠাক  পাহারা দিয়ে একটি সৎপাত্রে কন্যাকে তুলে দেয়ার যে দীর্ঘ প্রস্তুতি-- কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাই পরিবারগুলো খুশী হতে পারে না। পুরুষতন্ত্র কী করে নিজের গলার ফাঁস নিজেই পরেছে এটি তার একটি উদাহরণ। কেবলমাত্র তার যৌনতার নারীকে বশে রাখতে সে পিতা হিসেবে এরকম জগদ্দল পাথর মাথায় নিয়েছে!

অর্থনৈতিক চাপে পুরুষতান্ত্রিক দেয়ালগুলো ভেঙে যাচ্ছে। ফলে বাড়ির মেয়েদের বাইরে কাজ করতে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে পরিবারগুলো। এখনো অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোতেই কেবল কন্যাদের বিয়ে দেয়ার জন্য লেখাপড়া শেখানো হয়। যাতে কোনো বড় সরকারী চাকুরে, সেনা অফিসার, প্রবাসী ধনী এসে তার মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু যেসব পরিবারে অর্থনৈতিক সেই সচ্ছলতা নেই, সেখানে ঘরের মেয়েদের বিয়ের জন্য পেলেপুষে রাখার কোনো সুযোগ নেই। ভারতের মতো দেশে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে পুরুষতান্ত্রিকতাই সরাসরি বিরোধ জারি করেছে। সে অর্থে ভারতের প্রধান ধর্ম এখানে ভূমিকা নেয়নি। যদি নিতো তাহলে ধর্মীয় উন্মাদনায় ভারতও পিছিয়ে নেই। রকেটকে পুজো দিয়ে ভারতীয় গবেষণা সংস্থা ইসরো বহুবার বিতর্কিত হয়েছে। হিন্দু ধর্মে- সরাসরি বললে ইসলামের মতো সীলছাপ্পর সমেত দলিল যদি থাকতো তাহলে ভারতের নারীদের বেরিয়ে আসাটা সহজ হতো না। পাকিস্তানের একজন নারী থেকে ভারতীয় একজন নারী স্বাধীনতায় কয়েক পয়েন্ট এগিয়ে থাকবে কারণ ভারতীয় নারীটির ধর্ম ইসলাম নয়, তাকে ইসলামী ভাবধারার মুখোমুখি হতে হয় না...।

আফগানিস্থানে তৃতীয় শ্রেণির পর মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবার নিউজটির পর পরই আমরা জানতে পারলাম ভারতের চন্দ্রাভিযানের পেছনে ৫৪ জন নারী বিজ্ঞানীর নিরলস মেধা দিনের পর দিন কাজ করে গেছে। একটা কথা সব সময় বলি, ভারতীয় মুসলিম নারীরা সবচেয়ে সৌভাগ্যবান কারণ তাদের কোনদিন ইসলামী শাসনে পড়তে হবে না। যে কোনো অমুসলিম প্রধান দেশের মুসলমানরা সৌভাগ্যবান যে তাদের কোনদিন ইসলামী শাসনে যাবার রিস্ক নেই। যে ইরানে ৭০ দশকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নারীদের ছিলো অবাধ জ্ঞান চর্চার জায়গা তারাই স্রেফ মুসলিম প্রধান হওয়ার কারণে ইসলামী শাসনের জোয়াল টানছে! মাথা খোলা রাখায় তাদেরকে রাস্তার পুলিশ পেটাচ্ছে। ভারতে আজও নারীরা বৈষম্যের শিকার। আজও তারা পুরুষদের চেয়ে সুযোগ কম পায়। তবু ভারতের খাঁচাটির কোনো ছাদ নেই। কেউ চাইলে সেই খাঁচা বেয়ে হাত-পা ছিঁড়ে টপকে খাঁচার বাইরে চলে আসতে পারে। যে ৫৪ জন নারী ইসরোতে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছে তাদের জীবন এর বাইরে হবে তেমন কোনো কারণ নেই। কিন্তু মুসলিম সমাজের খাঁচাগুলোর ছাদ আছে। ছাদটি লোহার শিকে আচ্ছাদিত। ফলে ৭০-৮০ দশকের আফগানিস্থান-ইরান হয়ে যেতে পারে সপ্তম শতাব্দীর অন্ধকারাচ্ছন্ন। ভারতে জন্ম নেয়া এই মুহূর্তের কন্যা সন্তানটি- যদি সে মুসলিম ঘরের হয়ে থাকে, সে কি আফগানিস্থানে জন্ম নেয়া কন্যা সন্তান থেকে হাজারগুণ বেশি সৌভাগ্যবান নয়? কে বলতে পারে সে ভবিষ্যতে ইসরো’র প্রধান হবে না? কিন্তু আফগানিস্থানে জন্ম নেয়া কন্যা সন্তানটি?

ইউরোপে নারীদের আজকের যে অবস্থান, এক‘শো দেড়‘শো বছর পেছনে গেলেই সেটি দেখতে পাওয়া যাবে না। ইউরোপের নারীদের মুক্তি মিললো কীভাবে? রেঁনেসার যুগে যে দার্শনিকদের উত্থান ঘটেছিলো তাদের দার্শনিক অবস্থানগুলো ছিলো সরাসরি প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত। ফলে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো বিদ্রোহ বিপ্লবে প্রথম যে কাজটি করেছিলো সেটি হচ্ছে রাষ্ট্র থেকে ধর্ম নামক পরগাছাটিকে ছেটিয়ে বিদেয় করা। রাতারাতি সে সমাজে নারীর ভূমিকাই গেলো বদলে। নারীর প্রধান শত্রু এই "ঐশ্বরিক নির্দেশ"! যেখানে তাকে অর্ধ-মানুষ করে রেখেছে। বাংলাদেশের মতো দেশের নারীদের সর্বপ্রথম তাদের বিরুদ্ধে বলা তথাকথিত "ঐশ্বরিক নির্দেশ" অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের খাঁচার উপর কোনো ছাদ নেই। কিন্তু মুসলিমপ্রধান হওয়ার কারণে মাথার উপর গরাদ পড়ার রিস্ক ষোল আনা। ফলে সময় এখনই- চারপাশের খাঁচাটিকে ঝাঁকুনি দিয়ে ভেঙ্গে ফেলার...।

912 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।