আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন ফ্রিদা কাহলো!
আমার নিজের জীবনের পরতে পরতে যে শিল্পীর বেদনাঘন জীবন এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে বারেবার সেই প্রিয় শিল্পী ফ্রিদা কাহলোকে নিয়ে লিখতে চেয়েছি অনেক আগেই। জানার স্বল্পতাকে অতিক্রম করে আরো বেশী জানতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় কেটে গেছে অনেকটা সময়! লেখা আর হয়নি।
ফ্রিদা কাহলোকে বলা হয় বিংশ শতাব্দির সবচেয়ে বেদনালীন এক শিল্পী যিনি সৃষ্টি করেছেন এক জীবন মথিত বেদনাগাঁথার ধারাবাহিক ক্যানভাস। যাতে ঠাই পেয়েছে তার ছোট্ট বেলার নীলবাড়ী। জন্মের পরে কঠিন ব্যাধি পলিও। ১৮ বছর বয়সে স্কুল বাসে ভয়াবহ এক্সিডেন্ট। হাসপাতাল, নার্স, তীব্র ব্যথা, সমস্ত শরীর জুড়ে বেদনার দুরন্ত নীল নির্যাস। মেক্সিকান বিপ্লব, মেক্সিকান শিল্প, প্রাচীন সভ্যতা, স্বামী দিয়েগো রিভেরা, সম্পর্কের টানাপোড়ন, প্রেম, বানর, গাছপালা, কন্টক, শেকড়বাকড়, রিবন, রঙিন গাউন, ফুল, লতাপাতা সর্বপরি সন্তান ধারনের অক্ষমতার হতাশা ও অশ্রু। এর সকল কিছুই তাঁর ছবির প্রধান উপজীব্য।
ফ্রিদা কাহলো বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবার চেয়ে আলাদা এক অপরুপ সৌন্দর্য মাখা মুখবায়ব, এক তড়িৎ আলোক শিখা। যার পরনে উজ্জ্বল রঙের দীর্ঘ ঘাগরা নীচে রিবনের কারুকাজ। গলায় ঝোলানো রঙিন উত্তরীয় আর তাঁর মাথায় সাজানো ফুলের পশরা, যেনো এক অভূতপূর্ব ফুলদানী। লম্বা কালো চুলে দু'দিক দিয়ে কলাবেনী গেঁথে তাতে তাজা ফুল দিয়ে সাজানো। যেনো অনন্য সাধারন এক পুষ্প প্রদর্শনী। কতো যে সহজ কতো যে মনোহর।
ওঁর পুরো নাম ম্যাগডালেনা কারমেন ফ্রিদা কালো (কাহলো) ১৯০৭ সালের ৬ই জুলাই মেক্সিকো শহরের অদূরে ছোট্ট একটি গ্রাম কোয়োকানে জন্মগ্রহন করেন! বাবা কার্ল উইলহেলম কাহলো ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান, জার্মান। ১৮৭১ এর দিকে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি এসেছিলেন জার্মানী থেকে মেক্সিকোতে একজন অভিবাসী হিসেবে এবং আসার পর পরই নাম পরিবর্তন করে মেক্সিকান নাম গিলেরমো কাহলো নামে পরিচিত হন। মা মাটিল্ডা ক্যাল্ডেরন কাহলো, ছিলেন আদি এমেরিন্ডিয়ান ও মেক্সিক্যান স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত।
গিলেরমোর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি মাটিল্ডাকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির চার মেয়ের ভেতর ফ্রিদা ছিলেন তিন নাম্বার। মাটিল্ডা, আড্রিয়ানা, ফ্রিদা ও ক্রিস্টিনা ছাড়াও গিলেরমোর প্রথম স্ত্রীর ঘরে তাঁর আরো দুটি কন্যা মারিয়া লুইসা ও মার্গারিটাকে নিয়ে ছিল তাদের একটি বড়োসড়ো পরিবার। মেক্সিকোর প্রথা অনুসারে আরো অনেকের মতই গিলেরমোও শ্বশুরের ফটোগ্রাফী ব্যবসায়ে অংশ নেন এবং অসাধারন মেধার পরিচয় দেন। ফটোগ্রাফীতে তাঁর এই কৃতিত্বের জন্য মেক্সিকো সরকারের কমিশন পেয়ে মেক্সিকোর প্রথম সরকারি ফটোগ্রাফার হিসেবে যোগ দেন তিনি। পরে মেক্সিকান বিপ্লব (১৯১০-১৯২০)এর কারণে সে চাকুরীর কাল খুব একটা দীর্ঘ হয়নি!
১৯০৭ এ মেক্সিকান বিপ্লবের শুরুতে যে বাড়ীতে ফ্রিদা জন্মগ্রহন করেন 'নীলবাড়ী' নামে খ্যাত সেই নীল রঙের বাড়ী (লা কাসা আযুল) পরবর্তীতে তার জীবনে ও শিল্পকর্মে একটি বিশেষ প্রভাব ফেলেছে! ১৯১০ সালে মেক্সিক্যান বিপ্লব যখন শুরু হয় তখন ফ্রিদার বয়স তিন। যুদ্ধের ডামাডোলের ভিতর বেড়ে উঠতে উঠতে, নিত্য গোলাগুলির শব্দে বাড়ীর ভেতর মা ও বোনেদের সাথে কান চেপে লুকিয়ে পালিয়ে থাকতে থাকতে কেটেছে শৈশব। যখন তাঁর মাত্র ৬ বছর বয়স, তখন আক্রান্ত হন পোলিওতে যা তার ডান পা'কে ক্ষতিগ্রস্থ করে! আনন্দে খেলে বেড়ানোর সে সময়টিতে তাঁকে পড়ে থাকতে হয় নীলবাড়ীর একলা ঘরে একা একা। তার ডান পা শুকিয়ে চিকন হয়ে যায়। সম্ভবত এ কারণেই বড় হবার পরে ফ্রিদা বেশির ভাগ সময়ে কালারফুল লম্বা গাউন অথবা লম্বা স্কার্ট পরতেন। প্রায় নয় মাস বিছানায় থাকার পর যখন ফ্রিদা একটু সুস্থ হয়ে ওঠেন, তৎকালীন মেক্সিকো সমাজের প্রথা ভেঙ্গে বাবা তাকে আরো সারিয়ে তুলতে নিয়ে যান সকার খেলতে, সুইমিংএ এমন কি মেয়েকে নিয়ে যান রেস্লিং করাতেও।
আস্তে আস্তে পোলিও থেকে কিছুটা সেরে উঠলেন ফ্রিদা। ভর্তি হলেন নাম করা স্কুলে, পড়াশুনা করতে থাকলেন। স্বপ্ন দেখলেন ডাক্তারী পড়ার। এ সময় স্কুলের রাজনীতি সচেতন স্কলার স্টুডেন্টদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয় এবং তাদের মধ্যে আলেহান্দ্রো গোমেস এরিয়াসের সাথে একটি রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরি হয় তার। কিন্তু দুর্ভাগ্য আবারো তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে তার পিছুপিছু। ১৯২৫ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৮ বছর বয়সে একটি সাংঘাতিক এক্সিডেন্টে ফ্রিদা ভয়ানক ভাবে আহত হন। স্কুল বাস ও ট্রলি কারের সঙ্ঘর্ষে ভয়াবহ ভাবে ভেঙ্গে চুরে চুরমার হয়ে যান ফ্রিদা। তাঁর কলারবোন, রিবস, স্পাইনালকর্ড, পেলভিকবোন, জরায়ু, সব কিছু মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভালোকরে সব বোঝার বয়স না হতেই ঘটে যায় ভয়ংকর সব ঘটনা। ফ্রিদার জীবন হয়ে যায় এলোমেলো। এই এক্সিডেন্ট কেড়ে নেয় তাঁর মা হবার ক্ষমতা যা পরবর্তীতে তাঁর ভেতরে অসম্ভব হতাশার সৃষ্টি করে।
শুরু হয় যুদ্ধ। জীবন মরনের সাথে যুদ্ধ। সারা দেহে কঠিন ব্যান্ডেজ নিয়ে, প্রায় পয়ত্রিশটির মত অপারেশান করিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় হাসপাতালে কাটিয়ে অবশেষে বাড়ী ফেরেন তিনি। শেষ হয়ে যায় তার ডাক্তারী পড়ার স্বপ্ন। ব্যথায় বিপর্যস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা দিনগুলোতে মা তাঁকে বানিয়ে দেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছবি আঁকার মত বিশেষ ধরনের ইজেল। ছবি আঁকা ছবি তোলার মানুষ ছিলেন তাঁর বাবা, ফলে নানা রকম রঙ তুলি আর অয়েল পেইন্ট এনে বাবা তার আদরের মেয়েটিকে ছবি আঁকায় সাহায্য করেন।
শুরু হয় ফ্রিদার নতুন জীবন। জীবনের ছবি আঁকা আর রঙ তুলির খেলাই তার একমাত্র সাথী হয়ে ওঠে। সমস্ত শরীর জুড়ে এই তীব্র বেদনার খেলা তার অসংখ্য পেইন্টিং এর ভেতরে তুলে এনেছেন একান্ত বৈভবে। আরোগ্য লাভের অপেক্ষার পাশাপাশি ছবিকেই বেছে নেন আপন উপলব্ধি ও অনুভব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। তার নিঃসঙ্গতা, তার বাহ্যিক ও অন্তর্গত বেদনা ও বিভীষিকাময় এক্সিডেন্টের কথা একে একে সব তুলে আনেন রঙ তুলিতে। আঁকতে শুরু করেন তার আত্মপ্রকৃতি। কিন্তু কেনো আত্মপ্রকৃতি! এ বিষয়ে নিজেই বলেন "আই পেইন্ট সেলফ পোর্ট্রেইটস বিকজ আই এম সো অফেন এলোন, বিকজ আই এম দ্যা পারসোন আই নো বেস্ট।'
ফ্রিদার ১৪৩ টি পেইন্টিং এর মধ্যে ৫৫ টাই তার আত্মপ্রকৃতি যার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে নিজস্ব বেদনার অপূরণীয় ক্ষত। তাঁর ছবিকে সুররিয়েলিস্টিক ধারার না বলে বার বার তিনি বলতে চেয়েছেন 'আমি কোনো স্বপ্ন আঁকিনি আমি কেবল আমার জীবনের রুঢ় বাস্তবতাকেই আঁকতে চেয়েছি।' আদি মেক্সিকান সংস্কৃতির শেকড়ের রস ফ্রিদাকে আপ্লুত রেখেছে সবসময় যা তার ছবিতে একান্ত প্রণিধানযোগ্য। তাঁর ছবিতে নাটকীয় চরিত্রের আবির্ভাব, চড়া রঙের ব্যাবহার, কন্টক, রিবন ও মেক্সিকান সংস্কৃতির হৃদয়মূলে স্পর্শ করা স্টাইল সব মিলিয়ে একটি সংবেদন মূর্ত হয়ে ওঠে। একটি ছবিতে তিনি এঁকেছেন তাঁর রোগশয্যার চারিদিকে অসংখ্য মৃত্যু এসে আনন্দ নৃত্যরত। অসুস্থ থেকে থেকে মাঝে মধ্যে এমনটাই দেখতে পেতেন তিনি। এঁকেছেন স্নেহময়ী নার্সের কোলে দুধ পানরত ছোট্ট ফ্রিদা। কখন এঁকেছেন নিজেকে একান্ত করে ভগ্ন হৃদয়, ছেড়া জরায়ু, না জন্মানো ভ্রূণ, ছেঁড়াখোঁড়া ছিন্ন ভিন্ন নিজেকে নানা রকম অশুভ ইঙ্গিতে ঘেরা আলোছায়ায়। যে ছবি কাঁদায় তৃষ্ণার্ত সাগরকেও ।
আবার সুস্থ হয়ে ওঠেন ফ্রিদা। আবার চেষ্টা করেন স্বাভাবিক জীবন যাপনের। পড়াশুনার পাশাপাশি ইয়াং কমিউনিস্ট লীগ ও মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে কাজ করতে থাকেন। এরপর ১৯২৭ সালে ফ্রিদার দেখা হয় বিখ্যাত মেক্সিকান পেইন্টার কমিউনিজমে বিশ্বাসি দিয়েগো রিভেরার সাথে। দিয়েগো তখন মেক্সিকোর পাব্লিক মিনিস্ট্রি অব এজুকেশানে একটি বড় মাপের ম্যুরাল তৈরী করছিলেন। ফ্রিদা তাঁকে নিজের গোটা চারেক ছবি দেখতে দেন। ফ্রিদার পেইন্টিং তাকে অত্যন্ত মুগ্ধ করে তিনি ফ্রিদার মধ্যে শিল্পের এক অপার সম্ভাবনা দেখেছিলেন। এসময় ফ্রিদা তার অনুপ্রেরনায় প্রচুর ছবি আঁকেন যাতে দিয়েগোর ছবির ভাবধারার একটি স্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা যায়। এভাবে ফ্রিদার শিল্পীসত্বার একটি শক্তিশালী উন্মেষ ঘটে দিয়েগোর একান্ত অনুপ্রেরনার ভেতর দিয়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মুগ্ধ ফ্রিদা ও দিয়েগোর ভেতরে একটি গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ১৯২৯ সালে বয়সের দুস্তর ব্যাবধান সত্বেও, মায়ের অমতেই, দিয়েগোর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ফ্রিদা।
ফ্রিদা ও দিয়েগো কিছুদিন বসবাস করেন সানফ্রান্সিস্কো, ক্যালিফোর্নিয়া যেখানে ফ্রিদা ও দিয়েগোর যৌথ শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয় 'সিক্সথ এনুয়াল এক্সিবিশান অব সানফ্রান্সিস্কো সোসাইটি অব ওমেন আর্টিস্টস' এর সৌজন্যে। 'মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট' নিউইয়র্কে দিয়েগো রিভেরার পেইন্টিংস ছাড়াও নেলসান রাকাফেলারের কমিশনে বেশ কিছু কাজ করেন দিয়েগো। এসময় তাঁরা নিউইয়র্কে বেশ কিছুদিন ধরে বাস করেন। নিউয়র্কের পরে আবার তারা মুভ করেন ডেট্রয়েট মিশিগানে। যেখানে দিয়েগো কাজ করেন ডেট্রয়েট ইন্সটিটিউট অব আর্টস এর সাথে। দুজনের মিলিত জীবনের শুরুতে বেশীর ভাগ সময়েই দিয়েগোর মান, সুনাম, সম্মান, এওয়ার্ড ও প্রতিষ্ঠার পিছনে পিছনে সাথী হিসেবে ছুটতে হয়েছে ফ্রিদাকে। কিন্তু এ অবস্থা খুব বেশীদিন ছিলো না তাঁদের। দু'জনেই পেরিয়ে গেছেন বহুবার বহু বিচ্ছেদ। দু'জনে আলাদা থেকেছেন, আবার এক হয়েছেন আবার আলাদা।
তাঁদের এই বিবাহ বন্ধন সুখকর হয়নি কোনোদিন। দিয়েগো এবং ফ্রিদা দু'জনেই ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। তাদের উভয়েরই জীবনে এসেছে বহু নারী ও বহু পুরুষের সাহচার্য। সুন্দরী, বিদ্যুৎ চমকের মত এক অসামান্য নারীর নাম ফ্রিদা কাহলো। তাঁর জীবনের প্রতিটি বাঁকে মন দেয়া নেয়ার উত্তেজনাকর অধ্যায়ের অবতারনা ঘটেছে। বাইসেকচুয়াল ফ্রিদা নারী ও পুরুষ উভয়েরি সংস্পর্শে এসেছেন। দিয়েগো ফ্রিদার মেয়ে বন্ধুদের মেনে নিলেও কিছুতেই মানতে পারেননি তাঁর ছেলে বন্ধুদের আবার দিয়েগোও নানান নারী সংস্পর্শে এসেও ক্ষান্ত হননি। তিনি গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়েন ফ্রিদার ছোট বোন কৃষ্টিনার সাথে। ফ্রিদা সেইখানেই পেয়েছেন চরম আঘাত। দিয়েগোর সাথে তাঁর জীবনকে এঁকেছেন এভাবে - যেনো সে দীর্ঘ রঙিন গাউন পরা এক কংকাল।
দিয়েগো এবং ফ্রিদা দুজনেই খুব ভালোবেসেছিলেন দু'জনাকে আবার চরম ঘৃনা আর অবহেলাও যেন ঠিক বসে ছিল তার উল্টোদিকের ফ্লাটে। প্রায়শই তাদের বাসা আলাদা হয়ে যেতো আবার তারা এক হতেন । ১৯৩৯ এর নভেম্বরে ফ্রিদা ও দিয়েগো ডিভোর্সে গেলেও ঠিক এক বছরের মাথাই ১৯৪০ এর ডিসেম্বরে তারা পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ভালো হয়নি। সত্যি বলতে কী এ সম্পর্ক আর কোনোদিনই ভালো হতে পারেনি। শেষ দিন পর্যন্ত ফ্রিদা প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রনায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন। একদিকে দিয়েগোকে প্রানভরে না পাওয়া, দিয়েগোর বিশ্বাসঘাতকতা, বয়সের বিস্তর ব্যাবধান ও দিয়েগোর অবহেলা সর্বোপরি একটি সন্তান ধারন করতে না পারার অসহায়ত্ব ফ্রিদাকে তিলে তিলে পাগল করে দিয়েছে। তাঁর ভাষায় 'দেয়ার হ্যাভ বিন টু গ্রেট এক্সিডেন্ট ইন মাই লাইফ, ওয়ান ওয়াজ দ্যা ট্রলি এন্ড দ্যা আদার ওয়াজ দিয়েগো।' দিয়েগো ওয়াজ বাই ফার দ্যা ওয়ার্স্ট।'
সম্পর্কের ঝঞ্ঝা তাদের দু'জনকেই করেছে বিক্ষুব্ধ। বারে বারে তাঁরা ছিটকে পড়েছেন যন্ত্রনার আবর্তে। যদিও তাদের দু'জনেরি রাজনৈতিক আদর্শের কঠিন মিল ছিল এবং বিয়ের পর থেকে দিয়েগোর পাশাপাশি ফ্রিদাও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করেন।
ফ্রিদা ও দিয়েগোর বিয়ের এক বছরের মধ্যে ১৯৩০ এর দিকে তাঁরা ঘনিষ্ট হন রাশান কমিউনিস্ট নেতা ও রেড আর্মির প্রতিষ্ঠাতা লিও ট্রটস্কির সাথে। তিনি ছিলেন রাশান সিভিল ওয়ারে, বলসেভিক বিজয়ের প্রধান নেতা ও ট্রটস্কিজমের প্রবক্তা। ১৯৩৭ এর দিকে যোসেফ স্টালিনের সময়ে ট্রটস্কি তাঁর নিজের দেশে মৃত্যুদন্ডের পরোয়ানা মাথায় নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে পালিয়ে নরওয়ে হয়ে মেক্সিকোতে আসেন রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্যে। দিয়েগো এবং ফ্রিদা দুজনেই ছিলেন ট্রটস্কির ঘনিষ্ট এবং একান্তজন। ট্রটস্কি প্রথমে দিয়েগো ও পরে ফ্রিদার বাড়ীতে থাকেন পরে তিনি অবশ্য কোয়োকানে তাঁর স্ত্রী নাটালিয়া সহ আলাদা বাসা নিয়ে চলে যান যেখানে ১৯৪০ এ দিকে সোভিয়েত পন্থী আতাতায়ীর হাতে নিহত হন ট্রটস্কি। বলা হয়ে থাকে ফ্রিদার বাসায় থাকাকালীন সময়ে ট্রটস্কির সাথে তার একটি গভীর অনুরাগের সম্পর্ক জন্ম নেয়। ট্রটস্কি সারা সোভিয়েত রাশিয়াকে নাড়া দিয়েছিলেন কিন্তু ফ্রিদা কাহলো সেই ট্রটস্কির হৃদয় দোলা দিয়ে ছিলেন তাঁর যাদুকরী ছোঁয়ায়। ট্রটস্কির কাছেও বোধ করি ফ্রিদা এক মুগ্ধ বিস্ময়ের নাম।
১৯৩৮ এ তিনি পরিচিত হন শিল্প সাহিত্য আন্দোলনের পথিকৃত আন্ড্রে ব্রেটনের সাথে এবং একই বছর নিউইয়র্ক সিটি গ্যালারীতে আয়োজিত হয় ফ্রিদা কালো'র খুব বড় একটি একজিবিশান। যেখানে তাঁর প্রদর্শিত ছবির অর্ধেকই বিক্রি হয়ে যায় এবং তিনি দুটি কমিশান'স লাভ করেন।
১৯৩৯ এর দিকে ফ্রিদা কিছুদিন বাস করেন প্যারিসে এবং তাঁর ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেখানে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে মার্সেল দুচাম্প ও পাবলো পিকাসো'র সাথে। এসময়ে তিনি আঁকেন তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডাবল সেলফ পোট্রেটটি। যেখানে সম্পূর্ন হার্ট সহ কালারফুল গাউনে ঢাকা ফ্রিদা আর অন্যটিতে সাদা কাপড়ে ঢাকা ভাঙ্গা হার্ট নিয়ে রক্তাক্ত ফ্রিদা। এ ছবিটি ভালোবাসাসিক্ত ও ভালোবাসাহীন ফ্রিদাকে প্রতিনিধিত্ব করেছে বলে ধরা হয়। ১৯৪১ এ ফ্রিদা কালো মেক্সিকান সরকারের কাছ থেকে অনেক কাজের অনুরোধ পান কিন্তু তিনি তা করতে পারেননি কারন তাঁর বাবার মৃত্যু তাঁকে আবারো শারীরিক ভাবে অসুস্থ করে তোলে বিশেষ করে সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা তাঁর জীবনকে কন্টকময় করে তোলে। এসময়ে তিনি আঁকেন 'দ্যা ব্রোকেন কলাম।' যেখানে ফ্রিদা তার সারা শরীরে সার্জিক্যাল করসেটের উপরে পেরেক লাগানো এবং মেরুদন্ডকে সুসজ্জিত কলাম হিসেবে দেখান। অন্য এক ছবিতে নিজেকে আঁকেন কন্টকাকীর্ন বৃক্ষের ডালপালার উপরে শুয়ে আছেন তিনি। আবার অন্য ছবিতে দেখি কন্টক হার গলায় একটি ছোট্ট হামিংবার্ড লকেট হয়ে দুলছে সেখানে।
১৯৫০ থেকে শুরু হয় তাঁর শারীরিক ধ্বস। গ্যাংরিন হয়ে ডান পা একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। প্রায় বছর ধরে পড়ে থাকেন হাসপাতালে। চলতে থাকে অপারেশানের পর অপারেশান। কিন্তু কিছুই থামিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে তাঁর পেইন্টিং থেকে। নিজেই বলেছেন ' আই এম নট সিক, আই এম ব্রোকেন, বাট আই এম হ্যাপী এজ লং আজ আই ক্যান পেইন্ট' অথবা 'ফিট হোয়াট ডু আই নিড ইউ ফর, হোয়েন আই হ্যাভ উইংস টু ফ্লাই।'
১৯৫৩ তে তাঁর প্রথম একক একজিবিশান হয় মেক্সিকোতে এবং ফ্রিদা হাসপাতাল থেকে এম্বুলেন্সে করে স্পেশাল বেডে শুয়ে আসেন তাঁর ছবির প্রদর্শনীতে। ১৯৫৪ তে আবার হাসপাতালে আসেন ধরে নেয়া হয় এ সময় তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। দু'মাস পরে আবারো আসেন ব্রংকিয়াল নিউমোনিয়া নিয়ে। অসুস্থতা, রোগ শোক কোনো কিছুই তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি এমন কি মৃত্যুর আগে ২রা জুলাইতেও তিনি এসে দাঁড়ান রাজপথে মানুষের অধিকারের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
জুলাই ৬ তাঁর ৪৭ তম জন্মদিনের মাত্র ৭ দিন পরে জুলাই ১৩ তে তাঁর অতি প্রিয় নীলবাড়ীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফ্রিদা কালো।
মৃত্যুর কারন রিপোর্ট করা হয় পাল্মোনারি এম্বোলিজম। কিন্তু একথাও লোকমুখে বলা হয় যে ফ্রিদা কালো আত্মহত্যা করেন। তিনি নিজে বলেন ' আই হোপ দ্যা এন্ড ইজ জয়ফুল এয়ান্ড আই হোপ নেভার টু রিটার্ন।'
এই অসাধারন গুনী শিল্পীর মুল্যায়ন হতে সময় লেগেছে আরো । তার মৃত্যুর বহু বছর পরে আজ তাঁকে জানছে মানুষ। ১৯৫৮ তে মেক্সিকোর কোয়োকান শহরে তাঁদের নীল বাড়ী ফ্রিদার স্মৃতিময় মিউজিয়াম হিসেবে সাধারন মানুষের জন্যে খোলা হয়। তাঁর জীবন নিয়ে লেখা হয় অসংখ্য বই । ২০০২তে তৈরী হয় অসাধারন চলচ্চিত্র 'ফ্রিদা কাহলো'
ফ্রিদা কাহলো! আমার মুগ্ধ বিস্ময়! অজানা বেদনার কালো পর্দা সরিয়ে বুক দিয়ে আবাহন করেছেন কন্টকশয্যা। বেদনার পেয়ালায় ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে আস্তে আস্তে পান করেছেন শিল্পিত হেমলক। ফ্রিদা কাহলো উন্মোচন করে গেছেন এক অন্য পৃথিবী যেখানে এ বিশ্বের প্রতিটি নারী ও প্রতিটি নারী শিল্পী শুনতে পান তাঁর আপন বেদনার অনুরনন ! জয় ফ্রিদা কাহলো! জয় হোক শিল্পের।
'মাই পেইন্টিং ক্যারিস উইথ ইট দ্যা মেসেজ অফ পেইন।'