লুতফুন নাহার লতা

অভিনেত্রী ও লেখক

ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের প্রতিবাদটি সঠিক হওয়া চাই

সম্প্রতি প্রায় প্রতিদিনই দেশে ধর্ষনের ঘটনা শোনা যাচ্ছে। ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না। তবে কি কেবল আমরা যখন জানতে পারছি তখনই এই ঘটনা ঘটছে! না। ঠিক তা নয়। আসলে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার শতকরা দশ ভাগও আমরা জানতে পারি না। সমাজের অশিক্ষা, ভুল শিক্ষা, অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মের ভয়, বিচারহীনতা, পুলিশি ঝামেলা, দূর্বলের উপরে সবলের প্রতাপ, ভয় ভীতি, ধর্ষণ প্রমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অমানবিক প্রক্রিয়া ইত্যাদির কারণে এই বিষয়গুলো যতটা সম্ভব চেপে যাওয়া হয়। সামনে কেবল তখনই আসে যখন হত্যার মতো ঘটনা গুলো ঘটে যায়। সম্প্রতি, ঢাকার ওয়ারীতে সাত বছরের ফুটফুটে ছোট্ট সায়মাকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছে। কিছুদিন আগে বাসের ভিতরে নার্স তানিয়াকে ধর্ষণ শেষে বাস থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করা হয়। ধর্ষণের মামলা তুলে না নেয়ায় কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারা হয় নুসরাতকে। তনুকে আর্মি ক্যান্টন্মেন্টের ভিতরে রেখে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। ছোট্ট মেয়ে পূজার কথা নিশ্চয়ই আপনারা ভুলে যাননি। মাদ্রাসাগুলোতে ধর্ষণ, বলাৎকার, হত্যা চলছেই। পাহাড়ে পাহাড়ে চলছে ধর্ষণ আর হত্যার উৎসব।

তো সবাই জানতে চায় কেমন করে এর সুরাহা হবে। আর কেনোই বা হলো এমনটা। আগে তো এতো ব্যপকহারে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। কথাটা ঠিক নয়, আগেও ঘটেছে। মানুষ ছিলো কম, মিডিয়া এত সোচ্চার ছিল না, আর বিগত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের মানুষ বেড়েছে ব্যপক হারে, কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় রকমের কোনো পজেটিভ পরিবর্তন আসেনি বরং সারাদেশে ছাত্র ছাত্রীদের কোচিং স্কুলের উপরে নির্ভরশীল করে তুলেছে এক শ্রেনীর শিক্ষকেরা। তাদের লোভ লালসার কাছে জলাঞ্জলি হয়ে গেছে নৈতিকতা এবং আদর্শ। দেশের প্রান্তিক শিশুটিকে শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। একমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা না করে ইংলিশ স্কুল, বাংলা স্কুল, সরকারী স্কুল, বেসরকারীস্কুল, মাদ্রাসা, ইসলামিক স্কুল এই রকম নানাবিধ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেই সাথে ভাগ হয়ে যাচ্ছে দেশের আগামী প্রজন্ম। ভাগ হয়ে যাচ্ছে তাদের চিন্তা চেতনা, মন মানসিকতা, বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আগামী পৃথিবী গঠনের স্বপ্ন গুলোও।

ধর্ষণের জন্যে অসম মনস্তাত্বিক অবস্থা বা বিকৃতি তো বটেই, অবদমিত যৌন ক্ষুধা, হতাশা, একাকীত্ব, সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব, অর্থনৈতিক বঞ্চনা, পূর্ণ কর্ম সংস্থানের অভাব, নারী সম্পর্কে এক ধরনের বিদ্বেষ, অশ্রদ্ধা, ঘৃণা, দেশে যথাযথ আইন ও এর সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার প্রবনতা, পরিবার ও সমাজের ভয়ানক কুসংস্কার, অনৈতিক কর্মকান্ডে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা এর প্রায় সব কিছুই দায়ী!

ফেসবুকের কল্যাণে সমাজের এই একটি বিশেষ শ্রেণীর তরুনদেরকে দেখতে পাই আলাদা করে। এদের বেশীর ভাগই ১৫ থেকে ২৫ এর তরুন ছেলে। ছবিতে দেখতে এরা সবাই বেশ নায়কোচিত। এরা বাংলা শুদ্ধ ভাবে লেখতে পারে না। এদের অধিকাংশের প্রোফাইলে বা কাভারে থাকে তসবীসহ কোরানের ছবি, হিজাবী শিশুকন্যার মোনাজাতের ছবি, অথবা ইসলামের তরবারীর ছবি। অথচ ইনবক্সে এরা অশ্লীল সব ছবি আপলোড করে পাঠায়। নারীর শরীর বা যৌন সম্পর্কের ছবি। কখনো কখনো পুরুষের যৌনাংগের ছবি। একবার একজন বলে কয়ে নিজের বোনের সঙ্গে শারীরিক মিলনের ভিডিও পাঠালে তার ওয়ালে গিয়ে দেখি প্রোফাইলে লেখা 'আই লাভ মাই সিস্টার।' এই সব বিকৃতি নিয়ে তরুন সমাজের একটি বিরাট অংশ মশামাছির মতো সারাদেশ ভরে গেছে। নৈতিকতা এরা জানে না। এদেরকে জানাবার মতো কোনো ব্যবস্থায়ও এরা বড় হয় নাই। ফলে এদের কাছে একটি শিশু মেয়েকে ধর্ষণ করে তাকে আঁচড়ে, কামড়ে, খামচে খেয়ে মেরে ফেললে কিচ্ছু এসে যায় না। ওরা জানে ওদের কিচ্ছু হবে না যেমন এদেশের মানুষেরা চাইলেই গরম ভাতের মাড় গায়ে ঢেলে দিয়ে একটা কুকুরকে হাসতে হাসতে মেরে ফেলে তেমনি। ধর্ষন মামলার আসামী কয়দিন থাকে জেলে! গ্রেফতার হলেও ক'দিন পরে বেরিয়ে এসে নির্যাতিত মেয়েটিকে আর তার পরিবারকে হুমকি দিতে থাকে।

বাংলাদেশ এতো মানুষের একটা দেশ। অপরিকল্পিত সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ থাকে গায়ে গায়ে লেগে। মানুষ ঘুমায় রাস্তায়। মানুষ লেপ্টে থাকে চামড়ার পোকার মত। আধমরা জীবন তবু তাদের যৌন ক্ষুধা মরে না। তা মিটাতেই হয়। কারন সে সংযম শেখেনি। নিজেকে সম্মান করা শেখেনি, শেখেনি কিভাবে সম্মান করতে হয় অন্যকেও। তাই তার ধর্ষর্ণের শিকার হয় রাস্তায় ঘুমানো ভাসমান দূর্বল যে কেউ। ব্যপারটা বড়লোকের ক্ষেত্রেও তেমনি, স্ত্রীর সাথে, কি বাড়ীর কাজের মেয়েটির সাথে তাতে পুরুষের কিচ্ছু যায় আসে না। যেভাবেই হোক যৌন চাহিদা মিটলেই হল। বিশেষ করে পুরুষটি যদি হয় অর্থে বিত্তে বলিয়ান, সমাজের উপরতলার লোক, তাহলে তার জন্যে আইনের সংজ্ঞা যায় বদলে, পুলিশ দারোগা ক্রসফায়ার এসব চমৎকার ভাবে বদলে যায়। আমি তো বলব শতকরা ৭০ ভাগ বাড়িতেই কাজের মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ধর্ষণের শিকার হয় বিচারহীন।

ধর্ষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও এর বিচারের জন্যে আইনের সংস্কার হওয়াটা খুব জরুরী। বাংলাদেশে সম্প্রতি দেখতে পাই প্রতিবাদের ভাষা এবং এর পদ্ধতি ও মাধ্যম বদলে গেছে। গত বছর ২০১৮ সালে সারা দেশে পরিবহন ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে জুনিয়র হাই ও হাই স্কুলের ছেলেমেয়েরা। দিন দুই তিন একটা মডেল ওরা স্থাপন করে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। বড়রা নয়। দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক জনক জননীরা রাস্তায় নামেনি নেমেছে বাচ্চারা। বড়দের লজ্জা থাকলে ওরা মুখ দেখাতে পারতো না। কিন্তু না, নির্লজ্জ অভিভাবকদের গাড়ীর বহর আবারো সেই আগের মতোই ভয়াবহ ভাবে চলছে। ফিটনেস বিহীন, কালো ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার হয়ে এক ঘন্টার পথ পাঁচ ঘন্টায় যেতে পারছে না। যানবাহন চলাচলের সমস্যা, সড়ক দূর্ঘটনা কিছুই কিন্তু বন্ধ হয়নি। গাড়ি যারা চালায় কিম্বা গাড়ির মালিকেরা কিছু শিক্ষা নেয়নি ছোটদের কাছে। অকাজের কাজ হয়েছে সারা বিশ্বে এই সংবাদ ফলাও করে ছেপেছে। পৃথিবীর যে কোনো দেশের কাছে বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আপনি মুখ উঁচু করে কথা বলতে আর পারবেন না। আপনার হয়তো দরকারও নেই কিন্তু আপনার সন্তানের গায়ে এই অপমান লাগবে।

এবার আবার খুব অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখছি একটি ছবি। সোশাল মিডিয়াতে ফেসবুকে দেশে দেশে এই ছবি ঘুরছে। সায়মা যে স্কুলে পড়তো সেই স্কুল কতৃপক্ষ স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে লাইন করে দাঁড়িয়ে হাতে প্লাকার্ড দিয়ে দিয়েছে সায়মাকে ধর্ষণ করে হত্যার প্রতিবাদের জন্যে। কেমন করে কোন আইনে এই শিশুগুলোকে ব্যবহার করছে এরা ! একটা শিশুকে ধর্ষন করেছে এবং মেরে ফেলেছে এর মতো ভয়ংকর অপরাধ আর হয় না। কিন্তু স্কুলের এই এতটুকুন বাচ্চাদেরকে কি এভাবে ব্যবহার করা যায়! না উচিত! বড়দের মিছিল মিটিং প্রতিবাদ সমাবেশ মানব বন্ধন কোথায়? একটি অপরাধের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না করে, এই এত্তটুকুন শিশুদেরকে সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহার করে আমরা আর একটি অপরাধ করছি না কি!

অবাক হচ্ছি, খুবই অবাক হচ্ছি দেশের বয়স্করা, যারা শিশুদেরকে রক্ষা করার কথা তারা এটাকে সাপোর্ট দিচ্ছে। মানব বন্ধন, প্রতিবাদ, মশাল মিছিল, মিডিয়াতে ঝড়, সেসব নেই। এই ছোট শিশুদের ছবি পাব্লিক করার পারমিশন দিয়েছে তাদের বাবা মা? স্কুল কি সেই পারমিশন স্লিপ দেখাতে পারবে? এটা কি আদৌ করা যায়? শিশুদের অধিকার আইন কি বলে? এভাবে বিনা অনুমতিতে কারো বাচ্চার ছবি সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহার করা রীতিমত অপরাধ। দেশে আইন আর আইনজ্ঞরা বিবেচনা করুক ধর্ষকের ভয়ংকর অপরাধের কঠিন শাস্তি কি হতে পারে। শাস্তি হোক যাতে চারিদিকে ধর্ষকের চিহ্ন না থাকে কিন্তু এইভাবে স্কুলের শিশু বাচ্চাদেরকে ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা হওয়া উচিৎ। কারণ একটি শিশুর বাঁচবার অধিকারের জন্যে প্রতিবাদ মিছিলে নামিয়ে আরো শিশুদের জীবনকে অরক্ষিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ২০ কোটি মানুষের লজ্জা এই ছবিটি। একজন শিক্ষক আমাকে প্রশ্ন করেছে তোমাদের দেশের বড়রা কি মরে গেছে! আমি তাকে বলতে পারিনি আমাদের দেশের বড়োরা এখন খুব বেশী ব্যস্ত ঘরে, দপ্তরে, কর্মে আর ক্লাবে ধর্ষণ ঠেকাতে ব্রথেল খোলার পরিকল্পনা নিয়ে, ওদের সময় নেই প্রতিবাদের। শিশুদের নিজেদের প্রতিবাদ তাই নিজেদেরই করতে হচ্ছে। ওরাই বিচার ব্যবস্থা ঠিক করবে, ধর্ষণ বন্ধ করবে, এটাই কি আমাদের বড়রা আশা করছেন! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য দেশের পুরুষকুলকে আহ্বান জানিয়েছেন প্রতিবাদে যুক্ত হতে। আশা করেছিলাম তিনি এ ব্যপারে আরো কঠোর হবেন।

পাঁচ সাত বছরের বাচ্চাদের হাতে ধর্ষকের ফাঁসির দাবীর প্লাকার্ড না তুলে দিয়ে ওই প্লাকার্ড, পোস্টার নিয়ে বাবামায়েরা, শিক্ষকেরা, দেশের আপামর জনগণ রাস্তায় নামুক। ওরা কি বোঝে ধর্ষ্ণ কি! বড়োরা কি মনে করেন এই শিশুদের এখনি জানার সময় ধর্ষণ কি এবং কেনো হয়! খুবই লজ্জার কথা! শিশুদেরকে এভাবে মিডিয়াতে এক্সপোজড না করে তাদের নিরাপত্তা দিন। সাংবাদিকদেরও উচিৎ শিশুদের জন্যে নিউজ করার যে এথিকস তা মেনে চলা। পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশেই আইন আদালতের যে কোনো কিছু থেকে শিশুদেরকে আলাদা রাখা হয়। মিডিয়াতে আনলেও তাদের মুখের উপরে একটি ব্লকার ব্যবহার করা হয় যাতে বাচ্চাটির মুখ দেখা না যায়। তাকে চেনা না যায়। বাবা মায়ের বিনা পারমিশানে স্কুলের বাচ্চাদের ছবি সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহার করা যায় না। এই বাচ্চাদের ছবি, ইউনিফর্ম ইত্যাদি ইনফরমেশন পাবলিক করে বা মিডিয়াতে দিয়ে ওদেরকেও বিপদের মুখে ফেলা হচ্ছে। এই ছবির একটি বাচ্চাও যদি কোনো বিপদে পড়ে তাহলে কে দেবে এর জবাব? কোনো মায়েরই উচিৎ না তার বাচ্চার ছবি যত্র তত্র ব্যবহার করতে দেয়া। আমি তো আমার শিশু বাচ্চাকে দেবো না। আমি নিজে রাস্তায় নামব। সেই জন্যেই আমি বড়ো আর ওরা শিশু। বাচ্চাদের প্রটেক্ট করা বড়োদেরই দায়িত্ব।

বাংলাদেশ, আমার দেশ। মানুষের অধিকার চেয়ে ওই দেশের রাজপথে ঝরেছে আমারো ঘাম আর অশ্রু। যত দূরে যাই তবু বলে যাবো মানুষের সভ্যতার কথা। সভ্যতার কথা আমাদের সকলেরই এখন সমস্বরে বলা প্রয়োজন।

1677 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।