আমি আমার সেকজুয়াল হ্যারাজমেন্টের কথা বহুবার এই ফেসবুকেই লিখেছি। জুড়ে দিলাম শেষে। এই ক্ষুদ্র জীবনে রাস্তার অচেনা লোক, বয়ফ্রেন্ড, আংকেল, প্রগতিশীল বর্ণচোরা মানুষ সবার কাছেই সেকজুয়ালি হ্যারাজড হয়েছি। শারীরিক ভাবে না হয় মৌখিক ভাবে।
#Me_too এর ঝড় আমাকে দেখাচ্ছে আমি শুধু একা না। আমার মত অনেক প্রিয় আপুদের গল্প এক। নির্যাতিতদের গল্পের শেপ একই থাকে। বাসে কিংবা লেগুনা, রান্নাঘর কিংবা ড্রয়িংরুম সব এক।
খুব ভালো লাগছে, আজকে এই হ্যাশট্যাগের বর্ণনায় কত মেয়ে নিজের মনের কথা লিখছে। গত দুই বছর আগেও আমি আমার পাশে এতজনের ভয়েস রেইজ দেখি নি। দেখি নি বলে ভার্সিটির হল, গ্রামের বাড়ি এমনকি আমার আত্মীয় স্বজন বাড়ি বয়ে এসে কম অপমান করে নি আমাকে। কেনো ঢেকে রাখি নি জীবনের অন্ধকার গল্পগুলো! কেনো পাবলিক করেছি গোপন ব্যাপারগুলো?
কিন্তু আমি বা আমার মতো যারা সেদিন এই নোংরা গোপনকে, ট্রমাটাইজড অতীতকে পোষ্টমর্টেম করে পাবলিক করেছিল, তাদেরই সেই সামনে আসার বদৌলতে আজ ফেসবুক জুড়ে পাচ্ছি Me too এর ঝড় ।
কত মেয়ে খুলে দিচ্ছে নিজের মনের ঝাপি! এই যে মেয়েগুলো বুঝে গেছে নিজের সেকজুয়াল হ্যারাজমেন্ট হওয়াটা নিজের কোন লজ্জার ব্যাপার না। নিজের ঢেকে রাখার জিনিস না। যারা হ্যারাজ করে, লজ্জা পাওয়া উচিত তাদের! কেনো ভিকটিম লজ্জা পাবে?
এই বোধটা জরুরি ছিলো! এই বোধের পরেই আসবে প্রতিবাদ! ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প!
আমি সেই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলার ঝড়ের প্রতীক্ষায় থাকলাম।
আমার #মি টু এর গল্প
এক
সাবালিকা হবার তিন মাসের মধ্যে প্রথম আমি চাইল্ড অ্যাবিউজের শিকার হই। বয়স তখন আমার মাত্র দশ। ফ্রক পরে এদিকে সেদিকে ঘুরে বেড়াই। নিচতলার ভাড়াটিয়ারা চলে গিয়েছিলো বলে, ওখানে দৌড়াদৌড়ির জন্য ফাঁকা ঘর পেলাম। রোজ নতুন লোক বাসা দেখতে আসতো। তাদের মধ্যেই এক মধ্যবয়সী লোক একদিন বাসা দেখতে আসে। যথারীতি প্রচণ্ড চঞ্চল মেয়ে আমি দৌড় ঝাঁপ দিচ্ছিলাম আর বকবক করছিলাম ঐ আঙ্কেলের সাথে। হুট করে আমার শরীর ঠেস দিয়ে ধরল দেয়ালে। তারপর কি বিশ্রী জাপটাজাপটি শুরু করলো আমার দশ বছরের সদ্য বেড়ে উঠা শরীরটা নিয়ে। ভয়ে থরথর আমি কাউকে কিচ্ছুটি না বলে, বাসায় এসে ভাইয়ার কাছে বললাম “এক লোক আমাকে......।”। ভাইয়া নাইনে পড়তো, কি বুঝছে জানি না, দৌড়ে লোকটাকে মারতে গিয়েছিলো। সে লোক চলে গিয়েছিলো অনেক দূরে। কাঁদতে কাঁদতে অবশেষে মাকে সব কথা বলি, মাও কান্না শুরু করে। তারপর আমাকে বকলো “এতো চঞ্চল ক্যান আমি?” আমি নীরব।
বহুদিন ধরে এই ট্রমাতে আমি ছিলাম। ব্যাগের ভিতর পেপার কাটার নিয়ে ঘুরতাম, কোনোদিন যদি দেখি লোকটার হাত কেটে নিবো। ট্রমাতে ছিলো মা নিজেও, মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠতো। বাসার বাইরে আমার ফ্রক পরা হারাম হলো, আমাকে জোব্বা টাইপের ড্রেসের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা হলো। অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলা নিষিদ্ধ হলো। আমি বেড়ে উঠতে থাকলাম একটা রংহীন শৈশবে। বাইরে খেলতে যাওয়া না, অনর্থক ঘুরতে যাওয়া না। সবকিছুতে নিষেধের বেড়াজাল।
জাস্ট একটা ইন্সিডেন্ট আমার গোটা লাইফের হিসেবগুলো এলোমেলো করে দিল। ডুবিয়ে দিয়েছিলো এক হতাশায়। নিজেকে খালি ঘেন্না লাগতো, সময় সময় মনে হতো যেন আমি শুধু মাংস। পুরুষরা আমার কাছে হয় উঠলো এক একটা চলমান পুরুষাঙ্গ। বিভীষিকার জীবন কাটিয়ে হলিক্রস কলেজে পড়ার সময় কিছুটা মুক্তির আস্বাদ পেলাম। কিন্তু কখনই নিজেকে বাঁচাতে করতে পারিনি কিছু নোংরা কড়াল থাবা থেকে। ছেলেদের কাছে আমি প্রথাগত সুন্দরীর হিসাবে পড়ি না। কিন্তু এই অসুন্দর মেয়েজীবন আমাকে রক্ষা করে নি। আমি শুধু প্রতিদিন বাইরে থেকে এসেছি, বালতি বালতি পানি ঢেলে শুদ্ধ হয়েছি। কিন্তু মুক্তি পাই নি।
আমার মতো এই নষ্ট শৈশব কাটিয়েছে অনেক ছেলে এবং মেয়ে। ঘটনার বহুদিন পর এক ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছিলো, যে মাত্র ৮ বছর বয়সে তার এক চাচী দ্বারা অ্যাবিউজ হয়। তখন শান্তি পেয়েছিলাম এই ভেবে, একা আমিই নোংরা হইনি। কিন্তু এ থেকে মুক্তি কোথায়? কবে ছোট্ট ছোট্ট নিস্পাপ বাচ্চাদেরকে একটা সুন্দর শৈশব দিতে পারবো, যেখানে লাগেনি কোনো কালিমা? পারভারশন জগতকে গ্রাস করছে, মুক্তি পায় না আমাদের শৈশবও। এই নোংরামির মধ্যে থেকে তবুও আশা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি , একদিন আমি মা হব! সেদিন আমার মেয়ের জীবনে হয়তোবা এই ঘটনাগুলো ঘটবে না! নিশ্চিন্ত মনে সে ছুটে যাবে এ গলির মোড় থেকে ও গলির মোড়ে, ছোট্ট লাল ফ্রক পড়ে, কোনো পশুর হাত আগাবে না তার দিকে!
দুই
অফিসে বসে স্ট্যাটাসটা লিখছি । বাসে গায়ে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতির জীবন তো অনেক দেখলাম, আজ যা দেখলাম সেটা ভাবনার বাইরে ছিলো! আমার চেনা শহর, চেনা রাস্তা, এভাবেই আমার কাছে বিষাক্ত হয়ে ধরা পড়ে। মোঃপুর বিআরটিসি বাস ধরে গুলশান আসি। ভিড় বাসে, মহিলা সিট দখল হয়ে আছে, এক লোক উঠে দাঁড়াল বসতে বললো। আমি তো খুশি। থ্যাংকস জানিয়ে সিটে বসলাম। ভিড় বাসে না উঠলে সকাল সাড়ে আটটার অফিস আমি ধরতে পারতাম না।
যাই হোক, লোকটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমার সাইকোলজিতে বললো, আমি উঠলে এই সিটে বসবে বলেই দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার। তো বিআরটিসি বাসের সিটগুলো একটু উঁচুতে থাকে। আমার হাঁটুর সঙ্গে শক্ত কিছু লেগে আছে। আমার মন বললো, প্যান্টের পকেটে অনেকের সেলফোন থাকে, তারই কিছু। চলন্ত বাসে সব বুঝাও যায় না। ফার্মগেটে যাবার পর বুঝলাম, ঐটা সেলফোন না! আমার মাথাতেও যা আসে নি, সেই জিনিসই লাগিয়ে রেখেছে আমার হাঁটুর সঙ্গে। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম “কই নামবেন আপনি? কি করতেছেন”। লোকটা দ্রুত সরে গেলো, প্যান্টের জিপার লাগালো, আমি দেখলাম প্যান্টের সাইড দিয়ে ভেজা একটা দাগ, আমি চিৎকার দিচ্ছি, হাত কামড়াচ্ছি।, চলন্ত বাস থেতে লোকটা নেমে গেলো। মেয়েরা সান্ত্বনা দিলো, বুঝলো, কাউকে বলতে পারছি না, বুঝাতে পারছি না। এমন কিছু কি করে হতে পারে আমার সঙ্গে? বহুদিন পর এইরকম কেসে হুট করে চোখ দিয়ে পানি বের হলো।
বহুদিন এইগুলার সঙ্গে লড়াই করে আসছি। ফেবুতে, ব্লগে, রাস্তায়। আজকাল গায়ে হাত দিলেই চিল্লাফাল্লা করি, মাইর দেই। কিন্তু এই কেস সম্পূর্ণ অন্য। এই অভিজ্ঞতায় পড়ি নি। বিশেষ করে যে লোক আমাকে সিট ছেড়ে বসতে দেয়, সম্মান করে, সেই এমন কিছু করতে পারবে, আমার মাথাতেও আসে নাই।
অফিসে এলে সহকর্মী আতিক ভাই বললো “কাঁদতেছিস ক্যান”। ঘটনা খুলে বললাম, ভাইয়া বললো “এইরকম হয় জানতাম, ভিকটিমের কাছে প্রথম শুনলাম, আমারই বিশ্বাস হচ্ছে না, এইরকম হয়?”
পারভারশন কোনো জায়গায় নেমে গেছে, আমি নিজে ভাবতেও পারি না! এর চাইতে জঘন্য কি হতে পারে? প্রতিদিন ভিড় বাসের মেয়েরা এই পারভারশনের শিকার হচ্ছে।
মা কে ফোনে মাত্র বললাম। মায়ের কথা “অফিসে সবাইকে ক্যান বলছো? নিজে তো মারতে পারই নি, আবার সবাইকে বলছো। চুপিচুপি খালি আমাকে বাসায় এসে বলতা, অফিসে চুপ করে থাকতা, অফিসে সবাই যখন হাসবে তোমাকে নিয়ে তখন কি হবে? লজ্জা নাই তোমার? জব ছেড়ে দাও, আর করতে হবে না”।
তিন
ওয়াসা ভবন থেকে বেরিয়ে রাস্তার উলটা পাশে দাঁড়িয়ে আছি, গুলশানে অফিসে যাবো নাকি টিএসসি তে একজন প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যাবো কি না বুঝছি না।
মানুষটাকে ফোন দিয়ে কেওয়াজ করছি, একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এক সিএনজি এসে দাঁড়াল সামনে। পরনে লাল জামা, লাল ওড়না, চুল খোলা, আমি জোরে জোরে কথা বলছি, সিএনজি সামনে দাঁড়িয়ে চালক ইশারা দিলো। আমি পাত্তা না দিয়ে, কথা বলছি, হাসছি। আবার ইশারা দিলো যার অর্থ দাড়ায় ‘সিএনজিতে আস”। আমিও চোখের ইশারায় বলি “মানে কি?”। এইবার যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা “চলে আয়, গাড়িতে, রেট কত?”। আমি চিৎকার করে বললাম “কি বলতেছেন? যাব না তো! ডাকছি আপনারে?” চালক মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। পাশে একটা দারোয়ান দাঁড়ান। আমি বললাম “সিএনজি ডাকলো ক্যান”। আমার তখনও বিশ্বাস হচ্ছিলো না, কেউ আমাকে ডাকতে পারে এইভাবে! দেখলাম দারোয়ান হাসে, বুড়া দোকানদার হাসে! সব হাসে! তীক্ষ্ণ হাসি! আমার কি খারাপ লাগে? পরে বলি।
বাস ধরতে হাঁটা ধরি। সামনে পড়ে “হাত দেখি” সাইনবোর্ড। ১০ টাকা দেখে। দাঁড়িয়ে যাই। জব পেয়ে টাকা উড়ানোর বাই হয়েছে। ১০ টাকা দিয়ে বলি, “আমার ভবিষ্যৎ কি”। বলল “স্বামী লুইচ্চা হবে, টাকা পয়সা হাতে থাকবে না, প্রেম করে বিয়ে হবার চান্স নেই”, প্রেম করছি একটা (একটা না অনেকগুলাই করছি) ছেড়ে গেছে, আমার নীল পাথর লাগবে, তাবিজ লাগবে”। আমি হেসেই যাচ্ছি। শেষে চাচাকে ডেকে বললাম “কয় বছর ধরে হাত দেখেন”। ৩০ বছর ধরে হাত দেখেন। দুই দুইটা বিয়ে করেছে। এক বউ মারা গেছে, আরেক বউ অচল। “আরেক বউ অচল” বলার সময় আমার দিকে একটা ছোট্ট চোখ টিপ দিলো। আমি বুঝলাম “অচল” এর গূঢ়ার্থ !
নাহ! সেক্সজুয়াল ইন্ডিকেশন কথা বলে আজকাল চোখ টিপ দিলে বড় হাসি পায়! কারণ আমি কি প্রকার ত্যাঁদড় এদের জানা নেই! এদের এটুকুই শান্তি!
কিংবা সিএনজিআলা ডেকেছে বলে কষ্ট নেই এই ভেবে “আমার রেট এত কম, আমারে সিএনজিআলা ডাকে”
বরং আমার খারাপ লাগে, সত্যিই কোনো দুপুরে, বা রাতে ওই কাওরান বাজারের রাস্তায়, যে মেয়েটি লাল জামা পরে দাঁড়িয়ে থাকে, তাঁকে যখন সিএনজিআলার ডাকে সত্যিই সাড়া দিতে হয়, তখন তার মুখটা কেমন হয়! হ্যাঁ হাসি তো একটা থাকবেই! খদ্দেরকে অভ্যর্থনা দেবার হাসি! কিন্তু তার বাইরে বুকের ভিতর উথলে ওঠা কষ্ট, খিদেয় পেটে চো চো করার যন্ত্রণা! সেগুলো কে জানবে?
বাস পেয়ে উঠে পড়ি। বাসের সাঁই সাঁই শব্দ, সে মেয়েকে চোখের সামনে নিয়ে আসে! ওটা আমি না, কিন্তু আমারই তো সত্ত্বা আরেক!
বিঃদ্রঃ কেউ হাত দেখাতে চাইলে ০১৯২৭৭৯৪৮৮৭ এ ফোন দিন। নামটা সেভ করা হয় নি। এক তিনকালের বুড়ো, আপনি মেয়ে হলে হাত দেখার পাশাপাশি চোখ টিপ দিবো ফ্রি তে।