লিলিথ অন্তরা

আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। প্রগতিশীল আন্দোলন সমূহের সক্রিয় কর্মী। নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক মানবিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছি। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন এর কেন্দ্রীয় সদস্য।

আমার মা ঝর্ণা

পুরুষতন্ত্রের মহান দায়িত্ব কাঁধে চাপিয়ে অনেকেই নিজের নামে পরিচিত হয়ে উঠতে বাধাপ্রাপ্ত হন, এবং শেষ পর্যন্ত হয়তো হয়েও উঠতে পারেন না। তাই আজকের লিখায় তার নাম ধরেই কথা বলতে চাই। আমি মনে করি, অমুকের স্ত্রী আর তমুকের মায়ের চেয়েও নিজের নামটা অনেক বেশী জরুরি। ঝর্ণা নিজে ছোটবেলা থেকে কখনোই ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে নি। সে স্বপ্ন দেখেছিলো আর্টিস্ট হওয়ার, চারুকলায় পড়ার, রং নিয়ে খেলার। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপিয়ে দেয়া 'মহান' দায়িত্ব কাধে নিয়ে পুরোদস্তুর হোমমেকার বনে গেলেন। তারপর আমার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই প্রশ্নের উত্তরের ধরণ ছিলো,

-তোমার বাবা কি করেন?

-সরকারী চাকরি।

-মা কি করেন?

-কিছু না, গৃহিণী।

আজ বুঝতে পারি, "কিছু করেন না, মা গৃহিণী" এই উত্তরের মধ্য দিয়ে, অবচেতন ভাবেই মায়ের অবৈতনিক, অস্বীকৃত অথচ বিশাল শ্রমকে কিভাবে অসম্মান করতাম! 

পরিবারে নারী গড়ে প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা গার্হস্থ্যশ্রম দেয়। যদি এই শ্রম স্বীকৃতি পেত এবং জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হতো, তবে তা জিডিপির ১০% হতো। এতো গেলো অর্থনৈতিক হিসাব! আর যদি সে পেশাজীবী মা হয়, তবে তো আর রক্ষাই নেই! বাংলাদেশে পর্যাপ্ত ডে-কেয়ার সেন্টারের প্রবল অভাব তারাই বুঝতে পারে। ফলে এই ডাবল বার্ডেনের আড়ালে চাপা পড়ে যায়, তার ইচ্ছাগুলো। আর এই গার্হস্থ্য শ্রম শুধু তার দৈহিক শ্রমই শোষণ করে না, তার মানসিক বিকাশ আর স্বপ্নগুলোকেও বাধাগ্রস্ত করে। শেষ পর্যন্ত তার নিজের নাম, নিজের পরিচয়, নিজের স্বপ্ন বলে কিছুই থাকে না।প্রথমে বাবার পরিচয়ে, তারপর স্বামীর, অতঃপর সন্তানের পরিচয়ে সে বেচে থাকে। 

গালাগালি পরে করেন ভাই! আমি মাতৃত্বকে মোটেই ছোট করছি না বরং ৯মাস অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে, নিজের পেটের ভেতর অস্তিত্ব অনুভব করা তারপর একে বড়ো করা, এটা এক দুঃসাহসিক কাজ। কিন্তু সমস্যা হলো যখন এই দুঃসাহসিক কাজটাই নারীর জন্য মুখ্য এবং একমাত্র মহান দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়! এই সন্তান যে আসলে সমাজের সন্তান হয়ে বেড়ে ওঠার কথা ছিলো, এই সন্তানের পরিচয় যে শুধু পুরুষের বংশের ধারক না, এই বিষয়গুলো বিদ্যমান থাকলে, সমাজে নারীর সম্মান এবং অংশগ্রহণ আরো ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেত। 

আমার মায়ের কাছে ফিরে যাই। তো ঝর্ণা ২৩ বছরের সংসার জীবনে রুটি বেলতে বেলতে আর্টিস্ট হওয়ার স্বপ্নটা হয়তো ভুলেই গেছে। গরম ভাতের ধোয়ায়, হয়তো তার হারমোনিয়ামের রীডগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। আমাদের কে স্কুলে, কোচিং এ নিয়ে আসা যাওয়া করতে করতে, হয়তো তার গবেষণা করার ইচ্ছাগুলো পথ হারিয়েছে। আমাদেরকে হোমওয়ার্ক করাতে করাতে হয়তো তার নিজের শৈশবের স্মৃতিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের মতো কোনো কোনো সন্তানই হয়তো বড়ো হয়ে, তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসছি! আমরা বড়ো ব্যস্ত যে! 

ছোটবেলা থেকেই মা-ই আমার পড়াশুনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলো। শহরের সবচেয়ে নামী স্কুলে পড়ানোর জন্য তার সে কি পরিশ্রম! সেই পরিশ্রমকে কি করে অস্বীকার করি? আজো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মা সকলের জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যায়, চরম মমতা দিয়ে, তাকে কি করে এড়িয়ে যাই? কী স্বার্থপর আমরা তাইনা? 

মা-ই আমার জীবনে একমাত্র মানুষ যাকে ধরে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে পারি,যার জন্য ভাবতে গেলে আমার চোখের কোণ ভিজে ওঠে, ভয়াবহ ঝড়ে যখন বিদ্ধস্ত হয়ে পড়ি, একমাত্র সে-ই বুক পেতে দেয় আশ্রয়ের জন্য, যখন সব সম্পর্কগুলো দূরে সড়ে যায়, তখন একমাত্র মা-ই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সব বুঝে নেয়, তখন নিজেকে অপরাধী মনে হয়!  

আমার অসুখে যে সবচেয়ে বেশী চিন্তিত থাকে, আমার ফেরার পথের দিকে যে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে, জীবনের সবচেয়ে টানাপোড়নের মুহুর্তগুলোতেও যে আমায় ভুল বোঝেনা, শক্ত করে যে আমার হাত চেপে ধরে, তাকে সময় না দিলে, ছোটবেলার সেই মারমুখী, কঠোর মা, এখন গালফুলিয়ে অভিমান করে বসে থাকে,  সে আমার মা, আমার বন্ধু, আমার ঝর্ণা। 

ঝর্ণা তোমায় প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে অনুভব করি। পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি ভালোবাসা..... 

 

1334 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।