অমরত্বের প্রত্যাশা নেই নেই কোন দাবী দাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া
মুহূর্ত যায় জন্মের মতো অন্ধ জাতিস্মর
গত জন্মের ভুলে যাওয়া স্মৃতি বিস্মৃত অক্ষর
ছেঁড়া তাল পাতা পুঁথির পাতায় নিঃশ্বাস ফেলে হাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া।
গান গাই বটে, আসলে কি তাই? “প্রতিটি জীবিত মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবে” জেনেই প্রতিটি জীবিত মানুষেরই মরণের পরেও বেঁচে থাকার এই আকুতি চিরন্তন। সেই থেকেই নানান সৃষ্টি। গল্প, কবিতা, গান, ব্যবসা, দান, অবদান, স্থাপনা, রাজ্য পাট কীসের মধ্যে দিয়ে নয়। নানান কীর্তি’র মধ্যে দিয়েই মানুষ মরণের পরেও বেঁচে থাকতে চায়। এই আকুতি থেকে প্রাচীন মিশরে “মমি”র চেষ্টা হয়েছে। মিশরের সমস্ত মন্দির গুলো’র গায়ে নানা রকম চিত্রে ইতিহাস গাঁথা বর্ণনা করে সময়কে বেঁধে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে আজকের পরিমাপে তিন মানুষ সমান উঁচু উঁচু নিজেদের ভাস্কর্য। অটোমান, মুঘল সম্রাট’রা করিয়েছেন নিজেদের প্রতিকৃতি। নানা কবিতায়, গল্পে, গানে এই আকুতি বিভিন্ন ভাবে হাজার বছর ধরে নিবেদিত হয়েছে
সেতারেতে বাঁধিলাম তার, গাহিলাম আরবার--
মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়।
“সৃষ্টিকর্তা”র ধারনাও কিন্তু এই আকুতির মধ্যে থেকেই এসেছে। মানুষ নিজের মতো করে ভেবেছে বলেই, এই পূজা, এই আরাধনা, এই ইবাদতের অবতারণা। নইলে যিনি সর্বশক্তিমান তার কি দায় পরেছে কে তাঁকে নিয়ে ভাবছে কি না ভাবছে সেই কথা ভাবতে? মানুষের এই চাওয়ার সুযোগ নিয়েই যুগে যুগে এসেছে “ধর্ম” এর ধারনা। “লাইফ আফটার ডেথ” এই ধারনাটিই ধর্মের মূল পুঁজি, এটুকু সরিয়ে নিলে বাকী সমস্ত কিছুই অন্তঃসারশূন্য। মানুষ যেহেতু তার কল্পনাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নি, তাই কাল্পনিক এই সৃষ্টিকর্তা’ও অমরত্ব চান তার সৃষ্টির মাঝে, স্তুতি চান, চান সবাই তার কাছে নতজানু হোক। প্রত্যেকটি ধর্মেই স্বর্গ, নরক, পুর্নজন্ম এই বিষয় গুলো এসেছে, কোনো ধর্মই নেই যেখানে এই উপাদান গুলো নেই। ঘুরে ফিরে “লাইফ আফটার ডেথ” কিংবা অমরত্ব এর অসীম চাহিদাই ধর্মের আঁধার কিংবা আবশ্যিক উপাদান।
মরে গিয়েও অন্ততকাল বেঁচে থাকার এই আকুতি থেকেই মানুষের যাবতীয় সৃষ্টি, সন্তান, বংশ, পরিবার কি নয়? নিজের নাম যেনো রয় সদা বহমান। “কীর্তিমানের মৃত্যু নেই”। এই বিভ্রম থেকে পৃথিবীর খানিকটা অনুন্নত অংশ কখনও মুক্ত হতে পারবে না। প্রথম বিশ্বের জীবন এতটাই ব্যস্ততা আর জাগতিক চাপের মধ্যে দিয়ে যায় যে, কোনো একটা “ধারনা”র পেছনে খরচ করার মতো ঠিক এতটা সময় সে দেশের মানুষের হাতে থাকে না। উন্নত জীবন ধারা যেমন দেয় অনেক ঠিক তেমনি নেয়ও অনেক। এখানে হাতের কাছে চিত্ত বিনোদনের এত খোরাক মজুদ যে, মানুষ বেঁচে থেকেই সব উপভোগ করতে চায়। অতৃপ্ত আত্মা’র অতৃপ্ত বাসনা, অন্য কোথাও অন্য কোনো সময়ে বা জীবন এখানে তত জনপ্রিয় নয়।
হয়তো এই একটা কারণেই “ধর্ম” ধারনাটি যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর নির্দিষ্টি একটি জায়গাতেই প্রতিপালিত হয়ে আসছে। বিশেষ একটি ধর্ম লালনের যেই মূল খনি তারা এখন অর্থনীতিতে স্বয়ং সম্পূর্ণ বলে তাদের জীবন রীতি পরিবর্তনের প্রকাশ্য ঘোষনা দিয়েছেন, এত দিন চলছিলো সবই কিন্তু অঘোষিত। এখন আর নেই কোনো রাখ ঢাক গুঢ় গুঢ়। যত দিন দারিদ্রতা আর অতৃপ্ত আত্মার অতৃপ্ত বাসনা থেকে পৃথিবীর ঘন জনবসতিপূর্ণ এই এলাকা’র মুক্তি আসবে না, থাকবে না সুস্থ চিত্ত বিনোদনের সুযোগ, জীবন যাত্রার মান মানুষকে মানবিক জীবন ধারন করার সুযোগ করে দেবে না, ধনী আর দরিদ্রের এই অসম পার্থক্য বিরাজমান ততদিন এই কাল্পনিক সুখের আনন্দ থেকে কেউ তাদের বঞ্চিত করতে পারবে না, এই যে তাদের একমাত্র সুখ। সামগ্রিকভাবে অনুন্নত জীবন যাপন, চিত্ত বিনোদনের অপযার্প্ত সুযোগ, নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে এই ধারনাটিকে টিকিয়ে রাখবে।
আমি চলে গেলে ফেলে রেখে যাব পিছু।
চিরকাল মনে রাখিবে, এমন কিছু,.
মূঢ়তা করা তা নিয়ে মিথ্যে ভেবে।
ধুলোর খাজনা শোধ করে নেবে ধুলো,
চুকে গিয়ে তবু বাকি রবে যতগুলো.
গরজ যাদের তারাই তা খুঁজে নেবে।