সালমা লুনা

ফিজিক্স আর পলিটিক্যাল সাইন্সে মাস্টার্স করেছেন। লেখালিখি করেন শখে। দায়বদ্ধতা অনুভব করেন নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলায়। হোপ সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিওর প্রেসিডেন্ট তিনি।

লেখাটা নারী’র বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে!

ক’দিন আগে একমাত্র চাচিশ্বাশুড়ি চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। চাচি গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। দু’তিনবছর পরপর আমরা গ্রামে তিনচারদিনের জন্য বেড়াতে গেলে উনার সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো এইটুকু যে, গিয়েই একবার উনার ঘরে গিয়ে দেখা করতাম আবার চলে আসার সময় উনার ঘরে, নয়তো বারান্দার কোণে যে চেয়ারটিতে বসে বসে তার এযাবতকালের চেনা পৃথিবীটা খুব আগ্রহ নিয়ে তিনি দেখতেন- সেই কোণটিতে গিয়ে দেখা করে তাঁর কাছে বিদায় নিয়ে আসতাম। এই ছিলো উনার সাথে ভাস্তে বউয়ের সম্পর্ক।

আমাদের গ্রামে থাকাকালীন সময়টাতে তিনি হয়তো আমাদের ঘরে আসলেন বা আমরাই কেউ গেলাম উনার ঘরে, গল্প বলতে যা বোঝায় তা কখনো হতো না কেননা উনি কথা তেমন বলতেন না। একদম স্বল্পভাষী ছিলেন। 

তাঁর নব্বই বছরের পুরনো ঘোলাটে চোখ। ত্বকে সময়ের অজস্র বিষণ্ণ আঁকিবুকি, ভাঁজ। এইরকম অসংখ্য নারীরা আছেন আমাদের। পাড়াগাঁয়ের সংসার, স্বামী- অনেকগুলো সন্তান, একটা উঠোন, কতগুলো ঘর, ক্ষেতের ধানের হিসেব, ফসলের কেনাবেচা, গাইগরু হাঁসমুরগির ছোট্ট একটা পৃথিবী নিয়ে এতবড় জীবনটা কাটাচ্ছেন, এই ভেবে ভেবে তার মুখের ভাঁজে আমি কি খুঁজতাম জানি না, তবে সেই সকল নারীদের কথা ভেবেই বিষণ্ণ হয়ে যেতাম খুব স্বল্প সময়ের জন্য। যারা এই ছোট্ট পৃথিবীটার বাইরে যে একটা বিশাল পৃথিবী আছে তার কথা জানলেও কখনোই দেখতে পাবে না এই বোধটা বিষণ্ণ করতো আমাকে।

তাঁর শেষ বিদায়ের দিনে ঢাকা থেকে ধনবাড়ি গেলাম। 
উঠোনে খাটিয়ায় শোয়ানো চাচির মাথার কাছে তাঁর দুই কন্যার একজন বসে আছেন। কাঁদছেন, অনুচ্চ স্বরে অনেক আক্ষেপ। মায়ের জন্য কতো কি করতে পারেন নি। 
গ্রামের নারীরা উঠোনে গিজগিজ। তাদের কথা শুনি চুপচাপ বসে। আমার তো কিছু করার নাই। কানে আসে, 'ঝিরাই আসল গো বাপমায়ের নাইগ্যা।' 'ম্যায়ারাই দেহে বাপ মায়েরে', 'একশোডা পুত থাকলিও অবি না -এডা ম্যায়া নাগবিই।'

কথাগুলো খুব বুঝতে পারি, মেয়েরাই আসল। তারাই দেখে বাবামাকে। এমনটাই অহরহ শুনি। সকল বাধা পেরিয়ে সন্তান হিসেবে বাবামাকে দেখাশোনা করার সব সম্মান কন্যাদের।

ছেলেরাও কি কিছুই সহ্য করে না?
তাদেরও কি বাধাবিপত্তি নেই? 
তাদেরও কি পাহাড়সম বাধা পেরোতে হয় না?

দজ্জ্বাল বউয়ের চোখ এড়িয়ে মাকে একটু বিশেষ যত্ন। মায়ের জন্য একটু ফলমূল কিনে দিয়ে আসা। অফিস ফেরত মাকে দেখে আসা। বউয়ের খরখরে গলায়- 'তোমার আর ভাইবোনেরা কি করে' শুনেও নিজেই মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। বউয়ের মা বাসায় থাকতে পারলেও 'তোমার মা ঝামেলা করে' এই অযুহাত মেনে নিয়ে মাকে একটু ধমক দাবাড় দিয়ে বউকে অনুনয় বিনয় তাজিম করে ক’টা দিন নিজ বাড়িতেই রাখা। ভালো খাবারটা বউয়ের বক্র কটাক্ষ আনদেখা করে মায়ের পাতে তুলে দেয়া। 'হসপিটালের টাকা তো দিয়েছোই, থাকতে হবে কেন? তোমারও বয়স হয়েছে' -এই সুকঠিন 'ভালোবাসা' কে উপেক্ষা করে রাতদিন হসপিটালের ডিউটি করা।

এসবও বড় 'কঠিন' করা! 
নারীকে বুঝি এসব করতে হয় না? সইতে হয়না?
হয়। হয়। 
সেও বড় কঠিনে কঠিনে টক্কার ভ্রাতাভগ্নীরা হে! 
তবে নারীর তো জন্মাবধিই কানে তুলো পিঠে কুলো। এটুকু সে সয়েই নিয়ে পিতামাতার জন্য করে থাকে। আমিও আমার বাবামায়ের কন্যাসন্তান। আমরা তিনবোন। আমার বাবামাকে দেখাশোনার পথ আমাদের জন্যেও এতটা মসৃণ নয়। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়েই যেতে হয়েছে, হয়।

এখন প্রশ্ন, যেখানে 'ঝি'রাই আসল বাপে মায়ের সেবার নাইগ্যা' এহেন যে নারী কন্যা হয়ে নিজ পিতামাতার জন্য সব বাধা পেরিয়ে যায় অবলীলায়, সেই মেয়েই স্ত্রী হয়ে কি করে নিজ স্বামী নামক পুরুষটিকে বাধা দিতে পারে পিতামাতার প্রতি যথাকর্ম করতে?

হামেশাই শোনা যায় নারীর রোজগার পুরুষটি স্বামী হয়ে ছিনিয়ে নেয়। স্ত্রীর বাবা মাকে দিতে দেয় না।

সেই নারীই স্ত্রী হয়ে স্বামীর রোজগার ছিনতাইকারী না হোক, বাবামায়ের পুত্রসন্তান ছিনতাইয়ের দায় কেনো নিজ ঘাড়ে নিতে চায় ?

জানি এই লেখাটা অনেককে পোড়াবে, ক্ষুব্ধ করবে এবং নারীর বিরুদ্ধে বলেই মনে হবে। কিন্তু এই অন্যায়টাও দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে সমাজে। লেখাটা সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে । 
নারীর বিরুদ্ধে নয়।

2575 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।