মিলু শামস

সাংবাদিক

কৃত্রিম শিক্ষাব্যবস্থার ফলিত রূপ

ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষাকে সেই শুরু থেকেই সাধারণের নাগালের বাইরে রাখার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো টোল, চতুষ্পাঠী, পাঠশালার যুগ পেরিয়ে ইংরেজ আমলে তা আরও শাণিত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। শাসন-শোষণকে সুসংগঠিত প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার জন্য শিক্ষাকেও সুশৃঙ্খল কাঠামো দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কাজ তারা করেছিলো কৃত্রিম উপায়ে।

ইংরেজ শাসনের আগে ভারতে একক একটি শিক্ষা কাঠামো না থাকলেও পাঠশালার মধ্যে দিয়ে নিজস্ব শিক্ষা পদ্ধতি চালু ছিলো। যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো শিক্ষার্থীদের বাস্তব জ্ঞান দেয়া। নিজস্ব এ শিক্ষা পদ্ধতিকে বিকশিত করার সুযোগ না দিয়ে ইংরেজরা পাঠশালা ম্যানেজমেন্টকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় বাইরে থেকে একে ইউরোপীয় ধাঁচের কাঠামো মনে হলেও শিক্ষার অন্তর্গত রূপটি হয়ে পড়ে দাস মনস্তত্ত্ব নির্ভর।

‘ভারতীয় মহা বিদ্রোহ’ বইয়ে প্রমোদ সেনগুপ্ত বিষয়টি এভাবে বলেছেন, ‘হাজিরা খাতা রক্ষা, ‘পাঠ্যক্রম বিন্যস্ত করা এবং বিভিন্ন শ্রেণির জন্য ভিন্ন ভিন্ন আসন নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা বোধ ছিলো পাঠশালাসমূহকে পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে পুনর্গঠনের ভাবনারই অন্তর্নিহিত দিক। ইংরেজ প্রবর্তিত নতুন শিক্ষারীতির বাহ্যরূপ ইউরোপীয় হলেও কার্যত তা হয়, ঔপনিবেশিক দাসতান্ত্রিক শিক্ষারীতি। অনিয়মিত উপস্থিতি ও ছাত্র বেতনের অনাদায়কে এ সময় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়, সনাতন পাঠশালা ব্যবস্থার মূল উপাদানই ছিলো সারল্য ও আন্তরিকতা। ছাত্র-শিক্ষকরা কোন কড়া আইনের বাঁধনে বাঁধা ছিলো না। কিন্তু এক্ষণে প্রথমবারের মতো বিশেষ অপরাধের জন্য বিশেষ শাস্তি দানের ব্যবস্থা করা হলো। গুরু ধীরে ধীরে একজন সামান্য সরকারী ভৃত্যে পরিণত হতে থাকলেন।’

এই ভৃত্যে পরিণত হওয়া শিক্ষকরাই নানা স্তরে এরপর যে শিক্ষা দিতে থাকলেন তা ভৃত্য মানসিকতাই তৈরি করলো। শিক্ষার সামগ্রিক যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হলো তা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পর্ব পেরিয়ে আমরা যখন বাংলাদেশ পর্ব পাড়ি দিচ্ছি শিক্ষা তখন পুঁজির নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি বিপণনযোগ্য পণ্য। শতকরা নব্বই ভাগ জিপিএ-৫ তাই পুঁজির প্রলোভনকে যত নিশ্চিত করে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য চিত্ত বিকাশের সম্ভাবনাকে ততই খারিজ করে। প্রায় কিছুই না পড়ে বা পাঠ্যবই সম্পর্কে সামান্য ধারণা নিয়ে এই যে শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ বন্যায় ভেসে যাচ্ছে এর গুণগতমান নিয়ে দায়িত্বশীল প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে।

আগে ভালো ছাত্রছাত্রীদের অনেকেরই মূল লক্ষ্য থাকতো বিজ্ঞান গণিত বা অর্থনীতির মেজর ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা করে শিক্ষার পরিপূর্ণতা উপলব্ধির দিকে। এখন এসব মৌলিক বিষয়ের দিকে আগ্রহ প্রায় শূন্যের কোঠায়। শিক্ষার মূল লক্ষ্য আবর্তিত জব অপরচুনিটি কেন্দ্র করে। তাই শিক্ষার্থীদের মূল মনোযোগ বিবিএ এমবিএ ইত্যাদির দিকে। শিক্ষা ব্যবস্থা জব অপরচুনিটি কেন্দ্রিক হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘চিত্ত বিকাশ’-এর পথ এখন প্রায় পুরোপুরি বন্ধ। চিত্তের বিকাশ মূলত হয় শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্র জীবনে। সে জীবন যদি পুরোটাই জিপিএ-৫-এর ফ্রেমে আবদ্ধ হয়ে পড়ে তা হলে তার পরিণাম অন্তঃসারশূন্য হওয়াই স্বাভাবিক। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক সাফল্য দেখাতে গিয়ে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানাচ্ছেন না তো? সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করে একটি ভালো উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে জিপিএ-৫ যেভাবে মহামারীর আকার ধারণ করছে তা আতঙ্কজনক। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রশ্নফাঁসের সংক্রমণ। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত এতে আক্রান্ত।

1526 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।