কয়েস আহমেদ

মানবতাবাদী।

মানবিক প্রজন্মের বিকল্প নেই

ধীরে ধীরে আমরা এক দুঃসময়ের দিকে যাচ্ছি। এক অদ্ভুত সেলফি প্রজন্ম, Selfish প্রজন্ম হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তরুন তরুনী, কিশোর কিশোরীরা ফোনের মাঝে মাথা গুঁজে পড়ে আছে। তাদের মাথা আর সোজা হবে বলে মনে হচ্ছে না।

একটা সময় ছিল, আমরা খুব ন্যাচারাল ছিলাম। ছিলাম প্রকৃতির কাছে। বৃষ্টি এলে আমাদের দল বেঁধে ভিজতে হত। সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্র গ্রহণ দল বেঁধে দেখতাম। অথবা খুব গরমের রাতে সবাই একসাথে ঘরের বাইরে চলে আসতাম। অথবা ছাদে যেতাম। পাশের ঘরের চাচা উনার বিখ্যাত আবহাওয়া রিপোর্ট শুরু করতেন; পূর্ব দিক থেকে হাওয়া বইছে, ঘন্টাখানেকের মধ্যে দখিনের মেঘ ভারী হবে। দুটি মিলে বৃষ্টি হওয়ার চূড়ান্ত সম্ভবনা রয়েছে! ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমরা শুনতাম। ভাল লাগত।

আমাদের হাতে ফোন ছিল না। আমরা গল্প করতাম সামনা সামনি বসে। আমাদের সময় ছিল একে অপরের জন্য। ব্যাট আর বলে আমাদের বিকেল গুলো গেছে। আমাদের ছুটির দুপুরগুলো পুকুরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। দিনগুলো গোসল করে চোখ লাল করে ফেলেছে! অনেক দিন পর দেখা হওয়া আত্নীয়কে যেতে দিতে মন চাইত না। আবার কবে দেখা হবে, আবার কবে কথা হবে! বৃষ্টির দিন গুলোতে আশে পাশের সবাই এক সাথে হয়ে কেরাম খেলার মাঝে যে আনন্দ এর থেকে বড় আনন্দ আর কিবা হতে পারত!

এখন সময় সুবিধার না। সুবোধেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা আমাদের সকল শক্তি, জ্ঞান, বুদ্ধি ইনভেস্ট করছি শিল্পায়নের জন্য। যেখানে উল্টো হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল আমরা যেহেতু মানুষ, তাই মানবিক হব। যান্ত্রিক বা পাষবিক হব না। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি, কিছু বুঝে উঠার আগেই আমরা একটি সেলফি প্রজন্ম হয়ে গেছি। অসুস্থ মায়ের পাশে থেকে সেবা করার বদলে, সন্তানেরা একটি সেলফি তুলে 'আমার মা অসুস্থ সবাই দোয়া করবেন' কেপশান দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। হসপিটালে মৃত্যু শয্যায় আত্নীয় স্বজনদের এই সেলফির প্রয়োজন নেই, ফেসবুকের প্রয়োজন নেই। তাদের প্রয়োজন, সন্তানদের হাত। তাদের একমাত্র চাওয়া এই হাত যেন তাদের কপালে থাকে, হাতে থাকে, স্পর্শে থাকে পরম মমতায়।

আমরা যেখানে বেসিক মানবিক আবেগ আর অনুভুতিগুলোকে হত্যা করছি, সেখানে বড় বড় মানবিকতার আশা করতেও ভয় হচ্ছে। সেই মানবিকতাও আমরা দেখে এসেছি আমাদের লাইফ টাইমে।

যখন কাজী নজরুল ইসলাম জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন প্রমীলা দেবীকে, যখন একজন ধার্মিক হিন্দু, পরিবার নিয়ে দাওয়াত খেতে যান মুসলমান বন্ধুর ঘরে কোরবানী ঈদে। যখন আমাদের ধার্মিক মুসলমান বন্ধুরা সব রকম সাহায্য করে পূজা মন্ডপে, হিন্দু বন্ধুদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। যখন কোন মুসলমান স্বামী ফজরের নামাজ আদায় করে জায়নামাযে বসে থাকে, প্রিয়তমা স্ত্রী গুন গুন করে রবীন্দ্রনাথের কোন গান গেয়ে চা নিয়ে আসে, ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখ তোমার মনের মন্দিরে...! তখন আমাদের ধর্মও থাকে, মানবিকতাও থাকে।

আর যখন আমরা এই দুইয়ের সহবস্থান ধরে রাখতে রাখতে পারি না, যখন আমরা শুধু ধার্মিক হওয়ার জন্য পাশবিক হয়ে যাই, তখন ধর্মও থাকে না, মানবিকতাও থাকে না।

আমি একজন মুসলমান হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে বড় হয়েছি। যেখানে অনেক হিন্দুদের অবদান। আমি যে স্কুলে পড়েছি, সে স্কুলের জায়গা একজন হিন্দু দিয়েছেন। আমি যে হাই স্কুলে পড়েছি তার প্রতিষ্ঠাতা একজন হিন্দু। যে কলেজে পড়েছি, সেটিরও। যে শিক্ষকেরা পড়িয়েছেন অনেকেই হিন্দু ছিলেন। ক্লাস টুতে যে আমি 'মুসলমান' শিশুটি কোন কারনে কেঁদে বুক ভাসাই, 'হিন্দু' শিক্ষিকা সে আমাকে কোলে তুলে সান্তনা দেন, আদর করেন, কান্না থামান। সেখানে হিন্দু-মুসলমান থাকে না। সেখানে সন্তান আর মায়ের মায়া থাকে। সেখানে মানুষ থাকে, সেখানে থাকে মানবতা।

আসুন সকলে মিলে সেই সব মানবতার গল্প বলি। মানবিক হই। একটি মানবিক পৃথিবীর খুব প্রয়োজন, প্রয়োজন মানবিক প্রজন্মের।

(Published as part of social media campaign #BeHumaneFirst to promote Secularism in Bangladesh)

3635 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।