আমাদের দেশের নারীরা পদে পদে বিভিন্ন রকম সহিংসতার শিকার হন। আমাদের দেশে বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট কোথাও নারীদের জন্য নিরাপদ না। কখন? কোথায়? কোন নারী? কিভাবে? নির্যাতনের শিকার হন তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এর প্রধান কারণ হলো আমাদের দেশে নারীদের নিরাপত্তার জন্য যে আইন রয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকার কারণে নারীরা সবচেয়ে বেশী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই চোখে পরছে দেশের গ্রাম-গঞ্জ হতে শুরু করে সর্বত্রই নারী নির্যাতন হচ্ছে। আইনের শাসন যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হতো তাহলে নারীরা এত সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হতো না। বাংলাদেশের শহরগুলোর ৫৪ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হন। এই নারীরা আইন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে খুব বেশি সহযোগিতা পান না। এদেশের শহরগুলোর গণপরিবহন ও নগর কাঠামোও নারীবান্ধব নয়। তাই নারীর নিরাপত্তা বিষয়ে নেপাল, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, জর্ডান, ব্রাজিল এবং জিম্বাবুয়ের মতো দেশগুলোর থেকেও খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের। উন্নয়ন সংস্থা একশন এইড-এর নতুন এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘কার শহর?’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে একশন এইড বাংলাদেশ। একইদিনে বাংলাদেশসহ ৪৫টি দেশে গবেষণাটি প্রকাশ করা হয়। একশন এইড কাজ করে আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার এমন ১০টি দেশের উপর গবেষণাটি করা হয়। দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর ৩৯.৩২, অবস্থান ষষ্ঠ এবং প্রাপ্ত গ্রেড ডি। অর্থাৎ বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার হার উচ্চ। নগরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই খারাপ পরিস্থিতিতে আছে। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা, আইন বাস্তবায়ন না হওয়া, জেন্ডারবান্ধব নগর পরিকল্পনার অভাব, নারী ও মেয়ে শিশুর জন্য সীমিত এবং অনিরাপদ গণপরিবহনের কারণে বাংলাদেশের এই অবস্থা।
নারীর নিরাপত্তার বিষয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত কঙ্গোর মতো অবস্থা বাংলাদেশের। এখানকার শহরের ৫৪.৭ শতাংশ নারী কোনো কোনোভাবে সহিংসতার শিকার হন। সহিংসতার শিকার নারীদের ৬৫ ভাগ সমাধান খুঁজতে গিয়ে দ্বিতীয়বার হয়রানির শিকার হন পুলিশের কাছে। তাই ৫৭ শতাংশ নারী মনে করেন, তাদের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে নেয়া হবে না।
গবেষণা অনুযায়ী, নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে বাংলাদেশে সমন্বিত আইন আছে। তবে গণপরিসরে নারীদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। আবার যে আইন আছে সেখানে যৌন হয়রানি বন্ধে সরাসরি কোনো বিধান নেই। যে কারণে জনপরিসরে যৌন হয়রানি হলে আইনিভাবে প্রতিকার খুবই কম পান নারীরা। আবার ‘যৌন হয়রানি’ শব্দটি কোনো আইনে পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়ন করা নেই।
প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনায় জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি মাথায় নেয়া হয় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর শূন্য। বাংলাদেশের শহরগুলোতে নারীরা গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, না জানিয়ে ছবি তোলা, নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গি ও কটুক্তিসহ নানা বিড়ম্বনার শিকার হন। ৪৯ শতাংশ নারী গণপরিবহনে এবং ৪৮ শতাংশ গণসেবা গ্রহণে অনিরাপদ অনুভব করেন। গণপরিবহনের নকশা ও চলাচল পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি মাথায় রাখা হয় না।
গণপরিসরে যৌন হায়রানি বন্ধে আইন করা যেতে পারে। যাতে করে ওই আইনের আওতায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি করা যেতে পারে। অপরদিকে যৌন হয়রানি বিষয়ে আমাদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের মনসিকতায়। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রসাশনকে সচেতন হতে হবে। গেল ৪০-৪৫ বছরেও নারীদের নিরাপত্তার জন্য শহরগুলোতে কোনো যাত্রী ছাউনি করা সম্ভব হয়নি। দুঃখের বিষয় যৌন হয়রানি বন্ধে এখনো আমাদের দেশে সুনির্দিষ্ট আইন নেই। নারীবান্ধব শহর তৈরিতে নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
একবারে আমাদের দেশে নারী সহিংসতার মাত্রা একদম শূন্য-তে নিয়ে আসা সম্ভব না। রাস্তাঘাটে নারীদের হয়রানি বা সহিংসতার বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। অনেক সহিংসতার ঘটনা ঘটে কিন্তু সেটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পর্যন্ত আসতে অনেক সময় লাগে তাও আবার প্রমাণ সহকারে। সমন্বিতভাবে কাজ করলে পরিবহন ব্যবস্থা নারীবান্ধব হবে।
গবেষণার সুপারিশমালায় বলা হয়, ঘরে-বাইরে এবং গণপরিসরে নারীর প্রতি সহিংসতার বিস্তারিত তথ্যসমূহ সংরক্ষণ করতে হবে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সরকারি কাঠামো, কর্মক্ষেত্র, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরণে প্রত্যক্ষ সরকারি নীতিমালা, সেবাসমূহ এবং প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে এবং নগর পরিকল্পনা হতে হবে জেন্ডারবান্ধব প্রভৃতি। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে হলে আমাদের সরকারের আইনের পাশাপাশি সর্বাগ্রে আমাদের মনমানসিতার পরিবর্তন করতে হবে।
শুধু সরকারের আইনের সাহায্যে নারী নির্যাতন ও তাদের প্রতি সহিংসতা রোধ করা সম্ভব না। দেশের প্রতিটি এলাকায় নারী নির্যাতনের ব্যাপারে ইউনিয়ন ভিত্তিক কমিটি করে ও তা প্রতিরোধ করা যেতে পারে। তাছাড়া স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসাও এর ব্যাপারে আলোচনা করে সমাজকে ও সমাজের লোকজন কে সচেতন করে তোলা যেতে পারে। আর আমরা যারা নিজেদের কে মানুষ বলে দাবি করি তাদের সবাইকে একটি কথা চিন্তা করতে হবে, যে আমাদের ও মা ও বোন রয়েছে। যেকোন মহিলার সাথে খারাপ ব্যবহার করার আগে আমাদের ভাবতে হবে, যে আমাদের ও মা ও বোন রয়েছে। নিজের মা ও বোনের কথা চিন্তা করলে হয়তো মহিলাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার চিন্তাটা আর মাথায় আসবে না।
দেশের বিভিন্ন এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে আরও সচেতন হতে বলে মনে করেন দেশের বিজ্ঞমহল। তাছাড়া নারীদের কে নারী হিসাবে দেখার মনমানসিকতা আগে তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশের নারীরা যদি তাদের চলার পথে নিরাপত্তা না পায় তাহলে তারা দেশের উন্নয়নের কাজে অবদান রাখতে পারবে না। বর্তমানে শত বাধাঁ বিপত্তি সত্ত্বেও আমাদের দেশের নারীরা ঘরের কোনে বসে নাই। তারা বর্তমানে লেখা-পড়ায় উচ্চশিক্ষিত হয়ে দেশসেবার কাজে নিজেদের কে নিয়োজিত রাখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আসন প্রধানমন্ত্রী হতে শুরু করে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণস্থানে তারা অধিষ্ঠিত রয়েছে। তাদের চলাফেরা ও লেখা-পড়ার ক্ষেত্রে যদি আমরা আরও সহযোগিতা করতে পারি তারা আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।