সাদিয়া নাসরিন

লেখক ও এক্টিভিস্ট

সাদিয়া নাসরিন এর নারীবাদী কবিতা

জীবন বোঝেনি ওইটুকু মেয়ে

জীবন বোঝেনি ওইটুকু মেয়ে

তবু ছিন্নভিন্ন যোনীপথ নিয়ে রক্তাক্ত বেঘোর

জরায়ুদায়গ্রস্থ মেয়েটি

নারীজন্মের দায় মিটিয়েছে দুই টাকার ব্লেডে কেটে কেটে

বড় করা যোনিপথে অবিরাম রক্তধারায়;

 

জীবন বোঝেনি মেয়ে, বোঝার সময় আসেনি

তবু সে নারী হলো,

পুরুষের আরামের শরীর হলো, শরীরের ভারে নত হলো,

অপ্রস্তুত শষ্যক্ষেতে তার হিংস্র পুরুষের চাষ হলো রাতভর...

বাঁচেনি মেয়ে, শুধু একটা জীবিত শরীর নিয়ে

আরো, আরো ঘুম,

মৃত্যুঘুম ঘুমিয়ে অমন চুপচাপ পড়ে আছে হলুদ খেতে,

হলদে পাখি মেয়ে

 

আমরা আরো, আরো অনেক হলুদের খেত বানিয়ে

অপেক্ষা করবো
ওরা আমাদের কন্যাদের যোনিপথ ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে বড় করবে বলে…

 

একটি মেয়ে বড় হচ্ছে 

একটি মেয়ে বড়ো হচ্ছে

বারো ছেড়ে তেরো হচ্ছে, সেই মেয়েটি বড়ো হচ্ছে

সেই মেয়েটি আমার, সেই মেয়েটি তোমার ও,

সেই মেয়েটি আমাদেরই।

 

সেই মেয়েটি বড় হচ্ছে

চারপাশে তার বেড়া উঠছে, কাঁটাতার জড়িয়ে ধরছে

নিজের ভারে নত হচ্ছে, কুঁজো হয়ে বুক লুকোচ্ছে,

আড়াই হাত কাপড় টেনে এক বুকে তার ধর্ম,

অন্য বুকে সমাজ ঝুলছে; তার পাশে সব

পুরুষ শ্বাপদ ভীড় জমাচ্ছে

হলুদের খেত ঘন হচ্ছে, পাট গুলো সব উঁচু হচ্ছে

সবখানে দাঁতাল শুয়োর তেড়ে আসছে। 

 

সেই মেয়েটি বড় হচ্ছে,

সমাজ নাকি নষ্ট হচ্ছে! নেতা এবার আইন বানাচ্ছে;

মেয়েটাকে নাকি বাঁচাতে হবে!

মাংসের দরে তাই বেচতে হবে; চাঁদমামা গান,

খেলার পুতুল, কাজলা দিদি......রাত পেরোতেই ছাঁদনা তলায়

রাতের হাতে নারী হচ্ছে সেই মেয়েটি, মস্ত পুরুষ খুবলে খাচ্ছে

ভাতের হাঁড়ি, কুলের আঁচার, ডালের বড়ি

রাতের বেলা পিষ্ঠ হওয়া, ছিঁড়ছে জীবন এলোপাথাড়ি

দেশের নেতা মুচকি হেসে সেই মেয়েটির মাজা ভাঙছে

 

সেই মেয়েটি বড় হয়ে,

তে-বছরেই ফেরত এলো ভরদুপুরে

নিজের জীবন নিজের কোলে, একলা হলো আবার মেয়ে;

আবার মেয়ে বড়ো হচ্ছে, আবার মেয়ে ভয় পাচ্ছে

সমাজ নাকি চোখ তাতাচ্ছে! 

ঘরের টিনে ঢিল পড়ছে, দাঁতাল শুয়োর তেড়ে আসছে,

চারপাশে সব পুরুষ শ্বাপদ ভীড় জমাচ্ছে।

 

জেগে আছি, আমি বেঁচে আছি

তোমার লক্ষণরেখা পেরিয়ে

আমি শুধু আমার জন্য, আমার শক্তিতেই বাঁচবো,

তুমি তা মানতে পারোনি

তাই বুঝি, আমার নত মুখ, নিচু ঘাড়, পাকা করমচার মতো

লাল দুটি চোখ দেখে আমার কান্নার গভীরতা মাপতে চেয়েছিলে?

তুমি দেখোনি, তোমার বাড়ির উঠোনে জীবনের স্বর্ণখনি পুঁতে রেখে

আমি কেমন হাসতে হাসতে চলে এসেছিলাম?

ফিরে ও তাকাইনি...

 

আমার আজন্ম উঁচু মাথা আর সিনা টানটান

করে দাঁড়িয়ে থাকা উদ্ধত অহঙ্কার আহত করেছিল তোমাকে;

আমার অমন অশেষ অমল বাঁচতে জানাটাই মৃত্যুবাণ

হয়ে বেজেছিলো তোমার বুকে;

তাই বুঝি হন্যে হয়ে আমার ভাঙ্গা টুকরো দেখতে চেয়েছিলে তুমি?

 

কিন্তু জেনো,

ওই ধুলোর মতোই উড়তে উড়তে আমি এখনো বেঁচে আছি ঝড় হবো বলে

আস্তাকুঁড়ের লজ্জা গিলে খেয়ে আমি বেঁচে আছি

অনিবার্য সূর্যের দাহ হবো বলে;

মেঘের জঞ্জাল উড়িয়ে নেয়া বাতাসের মতো,

কালো সমুদ্রের বুক চিরে আলো নিয়ে আসা নাবিকের মতো জেগে আছি আমি

সন্ত্রাসের রাতের মুখোমুখি দাঁড়ানো সাহসের মতো,

অবারিত, অশেষ অলৌলিক সুন্দর স্বচ্ছ ভোর হয়ে

আমি জেগে আছি,

আমি বেঁচে আছি,

এখনো তুমুল বেঁচে আছি।  

 

ও মেয়ে, তবু তুমি ভালো থেকো

ভালো থাকা দায় ইদানিং জীবনে মরনে,

অকালের এই কালে ভালো থাকা মানে নারীর লজ্জার লাল,

নিরবিচ্ছিন্ন ধর্ষনের আনন্দ ঢেউ

ভালো থাকা এখানে যা কিছু গর্বের,

অন্যায় আর অসততার আঘাতে ভেঙ্গেচুরে যাওয়া

ভালো থাকা মানে ক্ষমতায়নের মায়াবী কপাট,

ভালো থাকা মানে সংরক্ষিত আসনে পুরুষতন্ত্রের জয়োল্লাস

আর অধিকার অধিকার চমৎকার সাপ লুড়ু খেলা।

 

ভালো থাকা এখানে নারী নিপীড়নের

অপমান আর বেদনার গান একসু্রে গাঁথা

এই উত্থিত পৌরুষের দেশে তবু

ভালো থেকো মেয়ে, খাদের পর খাদে লাফিয়ে

ভালো থেকো মেয়ে বাসে টার্মিনালে ঘরে স্কুলে গা বাঁচিয়ে।

 

কোথায় পালাবে?

তার চেয়ে ভালো এখানেই মরে গিয়ে বেঁচে থাকো।

ও মেয়ে! তবু তুমি ভালো থেকো কোনোরকম

যতটুকু ভালো থাকা যায়!

 

 

আর জন্মে সে মানুষ নয়, জরায়ু হবে

ও সোনা মেয়ে,

এজীবন তোমার নয়, যে জীবনে আঁধারের ভাঁজ

কেটে কেটে আলো জ্বালে ঝিঙ্গুরের ঝাঁক;

জাদু মেয়ে, এ জীবন তোমার নয়

যে জীবনে ফুল পড়ে, চন্দন পড়ে, সবুজ হাসিতে

মেরুদন্ড গড়ে নিয়ে বেঁধে দিতে পারবে মজবুত ইমারত।

 

মধু মেয়ে !

তোমার জীবন কেবল স্তনের ভার, যোনীর দায়,

ক্ষতবিক্ষত ধর্ষনের অভয়ারণ্য

ফতোয়ার পাথর, নিষেধের কাঁটাতার, আপোষের বেড়াজাল

আগামীর জীবন তোমার কেবলই সতীদায়গ্রস্থ

বেহুলা হয়ে গড়ে যাবে পুরুষের জন্য নিশ্ছিদ্র লোহার বাসর। 

 

জীবনের দামে জেনে গেছে মেয়ে

আর জন্মে সে মানুষ নয়, জরায়ু হবে

আরামের মেয়ে হবে; লক্ষ লক্ষ হিংস্র যোনিখেকো পুরুষ

সুতানালি সাপ হয়ে

কিলবিল করবে তার শরীর জুড়ে;

মেয়ে শরীরের চিতায় পুরুষের কামনার আগুন জ্বলবে অনন্তজীবন

কাঁকন মেয়ে, জেনে যাও তবে

তোমার জীবনে ভগবান জন্মাবে না

ভগবানের জন্য তোমার জীবন জন্মাবে না।

5141 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।