লাবণী মণ্ডল

নারীবাদী লেখিকা।

কবে, কখন শুনবেন -‘লাবণী’কে ধর্ষণ করে, মেরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে!

ধর্ষণ! ধর্ষণ নিয়ে একটি শব্দও লিখতে ইচ্ছে করে না। তবুও লিখি! তবুও বলি! তবুও রাস্তায় দাঁড়াই! প্রত্যেক দিনই যখন ধর্ষণের খবর নিয়ে কথা বলতে হয়, লিখতে হয়-তখন মানুষের মনস্তত্বে আর নতুন কিছু কি প্রবেশ করতে পারে? মানুষ কি ভাবতে পারে- সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্নও দেখতে পারে? যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারী, শিশুই কেউ-ই নিরাপদে নেই সে রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে কেমন একটা লাগে যেন- ঠিক না বলুন! হ্যাঁ, তবুও আমরা স্বপ্ন দেখি, কিসের স্বপ্ন জানেন- এই পৃথিবীটা একদিন আমাদের বাসযোগ্য হবে, এই পৃথিবীটা একদিন আমাদের হবে। আর সেজন্যই পরিবর্তনের যোদ্ধা হতে হবে আমাদেরকে, লড়াইয়ের দায়ভারটাও নিতে হবে। 

চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডে দুই কিশোরী আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে- যে ঘটনাটি এবারই নতুন ঘটলো বা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না এমন নয়! কিশোরী দুইটির দোষ ছিলো তারা প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয় নি- আচ্ছা প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে, বিছানায় যেতে রাজি না হলে কি নারীদেরকে ধর্ষণ করা, মেরে ফেলা জায়েজ হয়ে যায়- হ্যাঁ, এই পুরুষতান্ত্রিক, ভোগবাদী সংস্কৃতিতে এটা মোটামুটি জায়েজ করেই নিয়েছে। এই যে জায়েজ করে নিয়েছে এর বিরুদ্ধেই আমাদের কথা বলতে হবে। মানববন্ধন, সেমিনার, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সব জায়গাই এই কথাটিই পরিষ্কার করে বলতে হবে- এর সাথে এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি জড়িত। এই সমাজের বর্তমান সংস্কৃতি খুন, ধর্ষণ, রাহজানি, কালোবাজারির। সুতরাং, এই সমাজব্যবস্থার দিকে দৃঢ়ভাবে আঙ্গুলটা তুলতে হবে। নচেৎ একটা প্রতিবাদ, মানববন্ধনে কিচ্ছুটি যায় আসে না-এই রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারক-বাহকদের। 

চারদিকে উন্নয়নের ঢোল পিটানোর মধ্যেই আমরা যখন প্রতিনিয়তই ধর্ষণের খবর পাই, শিশুহত্যার খবর পাই তখন সেটা আর গণ মানুষের উন্নয়ন থাকে না। সেই উন্নয়ন হয় একটা শ্রেণির, একটা গোষ্ঠির। এই যে শ্রেণিটা এই শ্রেণিটাই সকল অন্যায়, অবিচার করে দেদারসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধর্ষকদের তেমন কোনো শাস্তি আমাদের চোখে পড়ছে না কেনো, যাও দু-একটা পড়ছে তাদের শাস্তি কার্যকর করা হচ্ছে না কেনো-এর পিছনের শক্তিটা কার বা কাদের? আমরা যারা ভাবতে চাই, ভাবাতে চাই তাদের ভিতরে এই প্রশ্নগুলো উঠা স্বাভাবিক নয় কী! খুব স্বাভাবিক! 

এহেন উন্নয়নের মুখে থু-থু ফেলার রুচিবোধটাও আমার ব্যক্তিগতভাবে নেই। আমি প্রকৃতিগতভাবে একজন নারী। আমি যখন আরেক নারীকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলার নিউজ দেখি তখন মাথাটা ঠিক রাখতে পারি না- বিশ্বাস করুন! আমি পাগলপ্রায় হয়ে যাই। এটা সমাধান না জেনেও পাগল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা জন্মে! হাসছি, বেড়াচ্ছি, কাজ করছি, খাচ্ছি সবই ঠিক আছে কিন্তু আমার বোনকে ‘ধর্ষণ’ করেই ক্ষান্ত হয় নি তাকে মেরেও ফেলেছে। ভাবতে পারি না! কতটা পৈশাচিক মনস্তত্ব ধারণ করলে এটা সম্ভব! ‘মানুষ’ কতটা বর্বর হলে এটা সম্ভব!

একটা মানুষের সুস্থ, সবলমতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে- নেই বলুন! আমি যদি শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করি- কেনো তিনি এই ধর্ষণ নিয়ে কথা বলেন না, তার ধরাটা কোথায়? তার পরিবারের কান্না আজও সে আটকে রাখছে, আজও কান্নাও করে যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন তিনি চোখের জল ফেলবেন- এটাই স্বাভাবিক! কিন্তু, অন্যের পরিবারের কান্নায় তার চোখে জল কই, তার বিচারব্যবস্থার পদক্ষেপ কই? তার এগুলো দায়িত্ব নয়? যদি, দায়িত্ব না হয় তবে তার জনগণের প্রতিনিধি হয়ে ওখানে বসে থাকার দরকারটা কী? এখনই সময় এগুলো নিয়ে আঙ্গুল তুলতে হবে বন্ধুরা! নচেৎ, আমি/আপনি কেউ-ই বাদ যাবো না! কবে, কখন শুনবেন -‘লাবণী’কে ধর্ষণ করে, মেরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে! হয়তো একটা নিউজও হবে, হয়তো ফেইসবুকে লেখালেখিও হবে তাতে আমার কী হবে বলুন! আমার পরিবারের কী হবে বলুন! আমার প্রিয় ব্যক্তিটার কী হবে তাতে- কিচ্ছু হবে না! শুধুই আফসোস আর আফসোস! এই যে আফসোস আর আফসোস এর থেকে বের হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

সুশীলীয় প্রতিবাদ না করে হেডকোয়ার্টারে কামান দাগানোর প্রস্তুতি নিতে হবে। সরকারকে বাধ্য করতে হবে আর একটা ধর্ষণের কথা শুনলে আপনার ক্ষমতা ছাড়তে হবে, জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তানা হলে এগুলো চলতেই থাকবে, ঘটতেই থাকবে- আর আমরা বোকারামের মতো ইস্যুর নীচে ইস্যু ফেলে হাসতে হাসতে চলতেই থাকবো। কারো জন্য তো কিছু থেমে থাকে না বলুন! থাকে কি? তবুও ভেতরটা মোচড় দিয়ে, প্রতিরোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠে- সবকিছুই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। নিয়ন্ত্রণ করি নিজেকে- কিসের যেন ভয়ও তাড়া করে! আমরা সবাই মুক্তি চাই, সুন্দর পৃথিবী চাই, সুন্দর মানবজীবন চাই কথাটা তো সত্যি- তবে কেনো আমরা একতাবদ্ধ হতে পারি না, কেনো আমরা একই পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে একই শ্লোগানে মুখরিত হতে পারি না- ভয়টা কিসের আমাদের? হারানোর ভয়? কি হারানোর ভয়! যদি কোনো ভয় না থাকে তবে চলুন আমরা গড়ে তুলি সাম্যের পৃথিবী। যে পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ এই পৃথিবীর সকল আনন্দ-বেদনা উপভোগ করতে পারবে।

1589 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।