সৌম্যজিৎ দত্ত

লেখক, ব্লগার, আইএসআই তে লেকচারার এবং গবেষণারত ছাত্র।

কিরণ, আমি ক্ষমা প্রার্থী!

আজকাল আমি ভীষণ এক অপরাধবোধে ভুগছি। আজ পর্যন্ত আমি চোখের সামনে অনেক দেখেছি যে ছেলেরা মেয়েদেরকে বিরক্ত করছে, মেয়েদেরকে জোর করে প্রেম নিবেদন করছে সামনাসামনি রাস্তাঘাটে বা কখনো সোশ্যাল মিডিয়াতে মেয়েদের মেসেজ করে। একটা মেয়ে যতই বিরক্ত হোক না কেনো, তবু ছেলেটি সেই মেয়েটিকে উত্যক্ত করছেই। বারংবার করে চলেছে। আর যদি মেয়েটি আগ্রহ প্রকাশ না করছে তখন ছেলেটি সেই মেয়েটিকে ভাষার অপব্যবহার করে অশ্লীলতার সীমা অতিক্রম করছে।

মেয়েদের এমন অশ্লীল প্রায় রোজই করা হয় রাস্তাঘাটে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে। এতদিন এসব নিজের চোখে দেখে আমার গা ঘিনঘিন করতো। কখনো কখনো তীব্র বিরোধিতা করেছি, প্রতিবাদ করে উঠেছি পুরুষের এমন আচরণের বিরুদ্ধে গিয়ে। মেয়েদের সাথে কথা বলে তাদের ভরসা দিয়েছি। জানিয়েছি যে সমাজে এমন মানুষও আছে যারা নারীকে ভীষণ সম্মান করে। সেই আমিই কোনো এক দুর্বলতার মধ্যে আবিষ্ট হয়ে একই ভুল করে ফেলেছি। মানুষটির কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থী। হ্যাঁ, আমি তীব্র প্রেমে পড়েছি কিরণ নামের মানুষটির। অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছি মানুষটিকে। এরপরও আমি আমার আদর্শের লক্ষ্যে স্থির থাকতে ভীষণ চেষ্টা করে গেছি। নিজের মনের সাথে তীব্র লড়াই করেছি মানুষটির কাছে এভাবে প্রেম নিবেদন করবো না ভেবে, মানুষটিকে এত বিরক্ত করবো না ভেবে। আমি অনুভব করেছি যে কিরণ সেই এমন একজন মানুষ যার প্রেম, যার ভালোবাসা আমাকে  এমন ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দেবে, যা এই পার্থিব জগতে অমূল্য কোনো রত্নের থেকেও ভীষণ মূল্যবান আমার কাছে। আমার বারবার মনে হয়েছে যে আমি ওর চোখের ভাষায়, ওর কথাতে ডুবে যাচ্ছি আর নিজের মানসিক শক্তি হারিয়ে বারবার মেয়েটির কাছে প্রেম নিবেদন করছি।

আমি জানি না কিরণের মনে তার কি প্রভাব পড়েছে, তবে ওর মুখের ভাষা নিরুত্তর হতেই যেন আমার চেতনা আমাকে জানিয়েছে যে মানুষটিকে আমি ভীষণ উত্যক্ত করেছি বারবার প্রেমের কথা বলে। এতে আমি শুধু ওই মানুষটিকেই অসম্মান করি নি, অসম্মান করেছি আমার আদর্শকেও, অসম্মান করেছি নিজেকেও। এই অপরাধবোধের কারণেই আমি বেশ কিছু সময় ধরে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে দূরে থেকেছি। সোশ্যাল মিডিয়ার সামনে আসলেই বারবার মনে হয়েছে আমি খুব বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছি, যা আমার সম্মানবোধকে নিচু করছে। এটা যেমন ঠিক, যে আমি কখনো অশ্লীল আচরণ করি না কারোর সাথে, তেমন এটাও ঠিক যে অনেক সময় ভদ্র আচরণও ব্যক্তির বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। 

প্রেমে পড়া আমার কাছে নতুন কিছু নয়। ছোট বয়স থেকেই আমি বারবার প্রেমে পড়েছি একের পর এক নারীর। আমার প্রথম প্রেমটি অনেক বছর টিকে ছিলো। একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসতাম, সম্মান করতাম। আমাদের সেই প্রেম যখন মানুষের মনে আলাদা একটা জায়গা করে নিচ্ছে, সম্মানের জায়গা, আমি পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ি তখন। একটা ভীষণ সুন্দর প্রেমের মধ্যে আমি প্রতারণার বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। জীবনে এমনকিছু ভুল হয়ে যায়, যা মানুষ বুঝতে পেরেও নিজেকে শোধরাতে পারে না সহজে। আমিও শোধরাতে পারছিলাম না অনেক চেষ্টা করেও। বয়স অল্প ছিলো। সবে কৈশোর পার করেছিলাম, আমি এক অন্ধকার জগতে পা ফেলি। নেশায় বুঁদ হয়ে যাই। সেই সঙ্গে আমার সাথে জুড়ে যায় বহু নারীপ্রেম। আমি জানতাম যে ঠিক করছি না ওই মেয়েটির সাথে যাকে আমি ছোট থেকে ভীষণ পছন্দ করি, ভীষণ ভালোবাসি। আমি জানতাম যে ঠিক করছি না সেই মেয়েটির সাথে যে মেয়েটি আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে ছোট থেকে। এতকিছু জেনেও, আমি আমার অন্ধকার জগতটা থেকে কিছুতেই বেরতে পারছিলাম না। যতই বেরনোর চেষ্টা করি, ততই আরও খারাপের সাথে জুড়ে যাই, ততই নেশায় বুঁদ হতে থাকি। মেয়েটি আমাকে শোধরানোর অনেক চেষ্টা করেছে। পারে নি শোধরাতে। ব্যর্থ হয়ে, প্রতারণার শিকার হয়ে মেয়েটি অবশেষে হার মানে। মেয়েটি সরে যায় আমার জীবন থেকে। আমাকে ছেড়ে মেয়েটি যখন চলে গেলো, এক ধাক্কায় যেন আমি সমস্ত অন্ধকার ছিন্ন করে বেরিয়ে আসলাম। আমি কখনোই চাই নি যে মেয়েটি আমাকে ছেড়ে চলে যাক। নিজের প্রতি করুণা, এবং অনুশোচনা আমার অহঙ্কারের পতন ঘটালো। পতন ঘটালো আমার ভিতরে থাকা পুরুষতান্ত্রিক সেই অহঙ্কারের, যে আমি পুরুষ। নিজেকে শোধরাতে শুরু করি। জড়িয়ে যাই মানববাদী লেখক তসলিমা নাসরিনের আদর্শের সাথে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অহঙ্কার যে একটা মিথ্যা অহঙ্কার, তা আমার সামনে পরিস্কার হতে থাকে। চেতনার এক নতুন জগত আমার সামনে উন্মোচিত হয়। লেখক তসলিমা নাসরিন আমার কাছে সেই সূর্য, যার আলোকে আমার জ্ঞানচক্ষু খোলে। 

এরপর আমি আবার সেই এক প্রেমের সন্ধান করতে থাকি, যা আমাকে সত্যিকারের এক প্রেমের স্বপ্ন দেখাবে। এরপর এক এক করে অনেক মেয়ে আসে আমার জীবনে। না, আর আমি কারোর সাথে প্রতারণা করি নি কখনো। পুরুষতান্ত্রিক দেওয়াল ভেঙেচুরে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম। আমি একটা সত্যিকারের প্রেমের খোঁজ করছিলাম। কিন্তু কখনো তৃপ্ত হতে পারছিলাম না। হয়তো প্রেমের খোঁজ করতে করতে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিলো, কিন্তু যখন সেই সম্পর্ক থেকে সেই মানুষটির বা আমার কিছুই পাওয়ার নেই বুঝেছি, খোলাখুলি আলোচনা করেছি মানুষটির সাথে, নিজেদের ইচ্ছাতেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছি। কেউ কাওকে জোর করে আটকে রাখি নি। প্রেমের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসলেও আমরা প্রত্যেকেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। পরিস্কার কথা খুলে বলার জন্য সততা ও দৃঢ়তার প্রয়োজন হয়। আমরা প্রত্যেকেই সেই সম্পর্কগুলোর প্রতি সততা বজায় রাখতে পেরেছি। তাই সম্পর্কগুলো থেকে কোনো আক্ষেপ জন্মায় নি। 

সবসময় স্বপ্ন দেখেছি এমন এক প্রেম করবো, যা জমানার সেরা প্রেম হবে। যে প্রেমে হাহুতাশ করা তৃষ্ণা থাকবে দুটো মানুষের মধ্যেই, যে প্রেমে একে অপরের প্রতি তীব্র টান থাকবে। অনেকটা ঠিক স্রোতে ভাসতে ভাসতেও একে অপরের জন্য বাঁচা, একে অপরের জন্য লড়াই করা, তীব্র উত্তেজনার অনুভূতি উপলব্ধি করা থাকবে। তনুশ্রীর সাথে যখন আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আমরা একেবারেই আমাদের মতন ছিলাম। কে কি বললো, কে কি ভাবলো সেসবকে গুরুত্ব না দিয়েই আমরা একে অপরের প্রতি মেতে উঠেছিলাম। সমাজের সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙে আমরা প্রেম করতে শুরু করেছিলাম। দায়বদ্ধ না থেকেও আমরা একে অপরের জন্য বাঁচতাম। নিজেদের সম্পর্কের প্রতি প্রতিটা মুহূর্তে সততা বজায় রেখেছি দু’জনেই। কেনো জানি না, আমি কখনো বুঝতে পারি নি, তনুশ্রীর কাছে যেন আমি সম্মান হারাতে থাকি একটু একটু করে। আমার প্রথম প্রেম আমাকে অনেক শোধরানর চেষ্টা করেও যখন পারে নি শোধরাতে, আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলো। ছেড়ে যাওয়ার অনেক বছর পর আমাকে সে এটা বলেছিলো যে আমি শোধরাতে পেরেছি নিজেকে, আমি মানুষ হতে শিখেছি। তার বলা এই কথাটুকু আমাকে ভীষণ শান্তি দিয়েছিলো। তনুশ্রী আমাকে স্পষ্ট করে কোনো কারণ বলে নি, যে কেনো আমি ওর কাছ থেকে সম্মান হারাচ্ছি। তবে আমি ওকে ভীষণ সম্মান করি একজন মানুষ হিসেবে, একজন শিল্পী হিসেবে। তনুশ্রীর হয়তো কোথাও মনে হয়েছে যে আমি ওকে সম্মান করি না আর, যেটা সম্পূর্ণই একটা ভুল বোঝাবুঝি। আমি বারবার তনুশ্রীকে ফিরে আসতে বলার পরও যখন সে আর ফিরলো না, আমি খুব ভেঙে পড়লাম। আমি আমার ভুল খুঁজে বার করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। পারলাম না কারণ এই সম্পর্ক থেকে আমাদের দুজনেরই তেমন কোনো প্রত্যাশা না থাকলেও, আমরা ভীষণ সম্মান করেছি এই সম্পর্কটাকে। 

আমি যখন ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত হয়ে উঠছিলাম, তখন কিরণের বলা অল্প অল্প কথাগুলো যেন আমাকে তীব্র ভরসা দিতে শুরু করে। কিরণ! সেই এক নারী যাকে দেখে আমি কখনো ক্লান্ত হই না। এবার, এই প্রথমবার আমার মন যেন সেই এক মানুষের দেখা পেলো যার খোঁজ সে এতদিন ধরে করে এসেছে। কিরণ সেই নারী যার চোখ বড্ড গভীর। সমস্ত চেতনা সেই গভীরতাতে ডুবে যেতে পারে নিমেষেই। হ্যাঁ, আমি হাহুতাশ করা যে প্রেম সবসময় খুঁজেছি, কিরণের মধ্যে আমি দেখেছি সেই প্রেমকে। কিন্তু প্রেম কখনো একতরফা স্বীকৃত হয় না। যে অনুভূতি আমার হয়েছে, তা কিরণও যে উপলব্ধি করবে, তার কোনো মানে নেই। আমি জানতাম সেটা। জানার পরও, নিজেকে ধরে রাখার তীব্র চেষ্টা করার পরও আমি নিজেকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হই। আমার আদর্শ, আমার চেতনার বাইরে গিয়ে বারবার কিরণকে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করে ফেলি। আমি চাই নি প্রকাশ করতে। এভাবে ভালোবাসার কথা একজন মানুষকে প্রকাশ করা, যেখানে হয়তো মানুষটি বিরক্ত হতে পারে বা হচ্ছেও, তা আমার নীতি বিরোধী, আদর্শ বিরোধী। এরপরও আমি এই ভুলটা বারবার করতে থাকি। অচিরেই আমার ভুল ভাঙে। মানুষটি যখন নিরুত্তর হয়ে যায়, আমি বুঝতে পারি যে আমি শুধু তাকেই নয়, আমি আমাকে, আমার আদর্শকেও অসম্মান করে ফেলেছি। 

হ্যাঁ, আমি নিঃসন্দেহে, মনে, প্রাণে বিশ্বাস করি যে প্রেম আমি এতবছর ধরে খুঁজেছি, সেই প্রেম হলো কিরণ। যে প্রেমের জন্য আমি এতবছর ধরে হাহুতাশ করেছি সেই প্রেম কিরণ। যে পাগল করা প্রেমে আমি ডুবতে চেয়েছি, জমানার সেরা প্রেম হিসেবে আমি যা পেতে চেয়েছি সেই প্রেম কিরণ। এরপরও আমি কখনো একজন মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনোভাবেই জোর করতে পারি না। এরপরও আমি সেই মানুষটিকে বারবার বলতে পারি না যে ভালবাসি। এরপরও আমার অধিকার থাকতে নেই যে মানুষটিকে বিরক্ত করি বারেবারে। অনুভূতির উপলব্ধি হতেই পারে, কিন্তু সেটা ততক্ষণই সুস্থদায়ক যতক্ষণ সেই উপলব্ধি অপরপক্ষের বিরক্তির কারণ না হয়ে ওঠে। 

আমি যা করেছি, তা আমার লজ্জা। আমি কিরণের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। 

104573 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।