ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে কিরণ ও মালতি দু’জনেই চুপ থাকে।
দু’জনের মনের ওপর দিয়েই তখন ঝড় বয়ে চলেছে। মালতি বন্যার দুশ্চিন্তায় বিভোর।
অপরদিকে কিরণের মনের মধ্যে চলছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন এই মুহূর্তে। লক্ষ লক্ষ মানুষ জানেও না যে তারা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে। স্কুলের বাচ্চারা, রহিম, রাস্তাঘাটে – হাটে – বাজারে – বাসের মধ্যেকার সেই মানুষগুলিও বুঝতে পারছে না যে তারা ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে বন্যা, মালতি, কিরণও। কারোর নিস্তার নেই এই ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে!
- তবে কি সবাই শেষ হয়ে যাবে এভাবেই!
- কলকাতা শহরটি কি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে কাল বা পরশু!
- রাস্তার কুকুরগুলো, বেড়ালগুলো, আকাশে উড়ে বেরানো পাখিগুলো, সবুজ গাছগুলো সব এভাবে শেষ হয়ে যাবে!
- কোনো প্রতিরোধ, কোনো প্রতিকার নেই!
- সৌম্য! তবে কি আর সৌম্যর সাথে দেখা হবে না!
- মা, বাবা ওদের সাথেও কি আর দেখা হবে না!
এসব ভাবতে ভাবতেই ক্লান্ত শরীর, ক্লান্ত মন আর নিতে পারে না। কিরণ ওয়েটিং রুমে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। মালতি পাশের চেয়ারে চুপ করে বসে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে চলেছে অবিরাম।
মালতি জানে না, চারিদিকে কি হচ্ছে। মালতি জানে না এই হয়ে চলা অজানা বিষয়টির পরিণাম কি ঘটতে চলেছে! সে শুধু জানে ছোট্ট বন্যা ভীষণ অসুস্থ। ওকে যতক্ষণ না সুস্থ হতে দেখছে, বন্যা যতক্ষণ না হেসে, আদর করে “মা” ডাকছে, ততক্ষণ ওর শান্তি নেই।
সামনে একের পর এক লোক আসছে হাসপাতালে। একের পর এক স্ট্রেচার গাড়ি থেকে অসুস্থ রোগীদের নামিয়ে এমারজেন্সিতে ঢুকছে। সকলের মুখগুলিই কেমন উষ্কখুষ্ক, বিবর্ণ দেখাচ্ছে! হাসপাতালে হয়তো এমনটাই স্বাভাবিক, এই ভেবে মালতির খুব একটা নজর কাড়ছে না। মালতি একবার কিরণের মুখের দিকে তাকায়।
- কিরণ দিদিটা না থাকলে আজ যে আমার মেয়েটার কি হতো!
- কিরণ দিদি সারাদিন এতো খাটাখাটনি করেছে, দৌড়েছে, একটু বিশ্রাম নিক।
মালতি সারাজীবন কিরণের এই সাহায্য, এই ঋণ শোধ করতে পারবে না। ঘুমন্ত কিরণের মুখটার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতায়, শ্রদ্ধায় মালতি মাথাটা নিচু করে ফেলে।
প্রায় একঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেছে। একবার বন্যাকে দেখে আসতে হবে। পাশ থেকে কিরণও কেমন যেন চমকে উঠেছে ঘুমের মধ্যে! ও কি কোনো স্বপ্ন দেখছিলো!
কিরণ জেগে উঠেছে। ওর চোখে এক বিস্ময়! মালতি জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছে কিরণকে কি হয়েছে। হঠাৎ এমারজেন্সিতে চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ আসছে! হইচই হচ্ছে। কিছু একটা গোলমাল বেঁধেছে মনে হচ্ছে।
মালতি ও কিরণ একে অপরের চোখে তাকায়, এবং কিছু বলার আগেই, দুজনই চলে যায় এমারজেন্সিতে। দু’জন অসুস্থ রোগী ভর্তি হতে এসে মারা গেছে। ওদের পরিবারের লোকজনই চিৎকার করে কাঁদছে। কিরণ ও মালতি ওদের সাথে কথা না বলেই সোজা বন্যার কেবিনের সামনে চলে যায়।
বন্যার কেবিনে ডাক্তার, নার্সদের ব্যস্ত দেখাচ্ছে। কিরণ ও মালতি বাইরে দরজার কাঁচ দিয়ে দেখছে। ডাক্তার ও নার্সরা একে অপরের সাথে ব্যস্ত হয়ে কিছু কথা বলছে, নার্সরা এলোপাথাড়ি ছোটাছুটি করছে কেবিনের ভিতরে। একজন বন্যার হাতে ইনজেকশন চ্যানেলে ইনজেকশন পুশ করছে। একজন নার্স বাইরে আসছে ব্যস্ত হয়ে। বাইরে আসার সাথে সাথেই কিরণ নার্সকে প্রশ্নচিহ্ন জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে! মালতি এক দৃষ্টে নার্সের মুখে তাকিয়ে। নার্স শুধু একটিই জবাব দিলো, “এখন কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। সরুন এখান থেকে। বড় ডাক্তারবাবুকে ডাকতে যাচ্ছি।”
শুধুমাত্র এটুকুতেই কিরণ ও মালতি বুঝতে পারে যে বন্যার পরিস্থিতি জটিল। তাই ডাক্তার ও নার্সদের এই ব্যস্ততা। মালতি চেয়ারে বসে পড়ে। নিচ থেকে এমারজেন্সি রুমের ভেতর দিয়ে আসার সময় দু’জন মারা গেছে দেখে এসেছে সে। মায়ের মন এই সময় কেমন হয়!
কিরণ মালতির পাশে বসে মালতিকে সস্নেহে শান্তনা দিতে বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে মালতি। ওরা তো বন্যার দেখাশোনা করছে। বন্যা নিশ্চয় ঠিক হয়ে উঠবে। এতো ভেবো না।”
কিরণ তো মালতিকে শান্তনা দেয়, কিন্তু সে নিজেই ভীষণ অস্থির এবং দুশ্চিন্তায় আছে। সে জানে, পরিস্থিতি সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। বন্যার অবস্থাও ভীষণ খারাপ। তখন সে ঘুমের মধ্যে চমকে উঠেছিলো দুঃস্বপ্ন দেখে।
সে দেখেছে যে সবার অবস্থা এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে খুব খারাপ। সবাই মারা যাচ্ছে চারিদিকে। সে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মা, বাবার সাথে, সৌম্যর সাথে সে আর কখনো দেখা করতে পারবে না।
কিন্তু এখন আগে মালতিকে সামলাতে হবে। তাই মনের মধ্যে যাই চলুক, কিরণ ভেঙে পড়বে না। সে শক্ত থাকবে। সে লড়াই করবে।
বড় ডাক্তারবাবু কেবিনে ঢুকে গেলেন। পিছন পিছন সেই নার্সও ঢুকে গেলো। নার্সের সাথে এই মুহূর্তে আর কথা বলা গেলো না। দুজনই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে কেবনে ঢুকে গেলো। কিরণ ও মালতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাঁচ দিয়ে ভিতরে দেখছে, “বন্যা ছটপট করছে বিছানায় শুয়ে। ডাক্তারবাবু বন্যার চোখ পরীক্ষা করছে। নার্সরা ডাক্তারবাবুর নির্দেশমতো ওষুধ দিচ্ছে।”
- হঠাৎ মেডিক্যাল ভেন্টিলেটরটিতে একটি লম্বা দাগ সরলরেখায় চলে যাচ্ছে!
- ডাক্তার, নার্সরা যেন আরও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
- ডেফিব্রিলেটর দিয়ে বন্যার বুকে ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে।
- মালতি এসব আর চোখে দেখতে পারছে না। মুহূর্তেই তার প্রাণ শুকিয়ে যাচ্ছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে বন্যার অবস্থা দেখে। হতভম্ব হয়ে সে বসে পড়েছে ফ্লোরের মেঝেতে।
- কিরণ দেখে ভেন্টিলেটর মেশিনটিতে একটি সাদা দাগ সরলরেখা ধরে চলে যাচ্ছে। বিফ করছে। ডাক্তার বাবু বন্যার নার্ভ চেক করে এবং বন্যাকে ছেড়ে দেয়।
- ওদের ব্যস্ততা থেমেছে এবার। একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে হতাশ চোখে।
কিরণের চোখ ছলছল করে ওঠে। চোখে জল এসে যায়। সে বুঝতে পারে “বন্যা নেই।” বন্যা আর কোথাও নেই। বন্যা আর ফিরবে না, হাসবে না, কথা বলবে না। বন্যাও হেরে গেছে এই সংক্রমণের সামনে লড়াই করতে করতে যেভাবে সবাই হেরে যাচ্ছে, মারা যাচ্ছে। এভাবেই সবাই মরে যাবে কিছু সময়ের মধ্যে। কিরণের মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। সে মালতির মাথায় হালকা করে হাত রাখে।