বিড়াল খুব আদুরে প্রাণী।‘মিউ মিউ করে মানুষের কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে।’ এক সময় এরা মানুষের কোল জুড়ে থাকতো। আমার নানীকে দেখেছি বিড়ালকে নির্দিষ্ট বাটিতে প্রতিদিন দুধ খেতে দিতেন। নানাকে দেখেছি খেতে খেতে পাতের একটা মাছ তুলে বিড়ালের উদ্দেশ্যে উঠানে ছুড়ে দিতেন। আদুরে ভাব বাদ দিয়ে বিড়াল খুব রাজকীয় প্রাণী। সে যে বাঘের মাসী! তার নিঃশব্দ পদচারণা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাকে বরাবর মুগ্ধ করে। ছোট্ট তুলতুলে চোখ না ফোটা বাচ্চাগুলো যে কি মায়াবী! যারা দেখেছেন, তারা স্বীকার করতে বাধ্য।কিন্তু প্রশ্ন হলো দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সবার এক নয়। কেউ ফুল দেখেন, কেউ দেখেন ফুলে কাঁটা! কেউ মৌমাছি দেখেন, কেউ দেখেন মধু! কেউ দেখেন পাত্রটা আধেক ভরা, কেউ দেখেন আধেক খালি!
দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সবার এক নয়। কারণ সবাইকে একইভাবে লালন পালন করা হয় না, সবার মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রও এক না। যদি জেনেটিক্স বা বংশগতির কথা বলি, তবে তা শতভাগ মিলবে এমন এক জোড়া মানুষও পাওয়া অসম্ভব। তাই আমরা কিছুতেই আশা করতে পারি না যে প্রতিটি মানুষই আমার মতো ভাবতে বসবে বা আমার মতো জীবনধারণ বা খাদ্যাভাস তারও থাকবে। এটা অমোঘ সত্য। কিন্তু আমরা সবাই তাই প্রত্যাশা করতে ভালোবাসি। সত্যকে মেনে নিতে আমরা পারঙ্গম নই।
বিড়াল/ কুকুরের সে দিন নেই। কাকদেরও দুধ কলা মাখিয়ে খাবার খাওয়ানোর লোকও আজ বিলুপ্তির পথে। তবে নিঃস্পাপ বিড়ালের বাচ্চাকে গলায় রশি দিয়ে ঝুলিয়ে তার সাথে হাসি মুখে সেলফি তোলার লোকের বর্তমানে অভাব নেই। কুকুরকে টার্গেট করে হাতের নিশানা ঠিক করা। ব্যথায় কুকুরের ভয়াবহ আর্তচিৎকার শুনে অট্টহাসি দেওয়া মানুষগুলো তা ভিডিও করে ফেবু বা ইউটিইবে ছেড়ে দিয়ে তাতে লাইক কমেন্ট করে নিজেদের বাহাদুরি শো করা। তা দেখে আরও কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষের জন্ম হওয়াটা এখন সময়ের দাবী!
সাহিত্যে, চিত্রকলায়, নাট্যশালায় কাজ করা মানুষগুলোকে ধরা হয় নরম মনের মানুষ। যারা হবে অতিমাত্রায় মানবিক এবং মানবিকতার চর্চা করাই তাদের কাজ। কিন্তু দিন বদল হয়েছে। এরা আর সমাজ থেকে দূরে সরে থাকতে চায় না। অনেকে তো রুচি পছন্দে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে! প্রানীদেরকেও এরা রেহাই দেয় না। কাকদের নিয়েও বিকৃত রুচির কবিতা লিখতে তাদের বাঁধে না! আসলে এরা সাহিত্য চর্চা করে বিশেষ পল্লীর কাস্টমারদের জন্য! জনপ্রিয়তার বড় কাঙ্গাল যে তারা! জনপ্রিয়তা ছাড়া তাদের চলে না!
শারীরিক সম্পর্কের রগরগে বর্ণনা বা তার এপাশ ওপাশ, লিখলেই হিট! সাথে দু’চারটা গালাগাল, সুপারহিট! আর গালিটা যদি হয়ে নারী নামক জীবকে ঘিরে, তবে তো তা সুপার ডুপার হিট! এইটা সরাসরি না লিখে নাকি আমাদের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদেরকে ঠকিয়েছেন! তা শুনে কতগুলো মানুষ কাক আবার হাততালি দেয়। সমাজ কি শিখলো? সাধারণ মানুষকে কি শেখাচ্ছি? এটা বড় কথা না! বড় কথা হলো জনপ্রিয়তা! এসব লোকদের আমি বলবো জ্ঞানপাপী! তার জ্ঞান সে জেনেশুনেই বাজে কাজে খরচ করছেন। সমাজের বিষ্ঠা উৎপাদন করছেন। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হাত ধরে তার বাজারজাত ও বানিজ্যিকরণ করছেন। নিজ লাভের জন্য বিকৃত মানসিকতার সামাজিককরণ করছেন তারা।
ফেবুকে আমি পাবলিক প্লেসই বলি। যেখানে হরহামেশা যত্রতত্র মলমুত্র ত্যাগ করতে অনেকেরই বাধে না! রাস্তায় যেখানে একজন ট্রাক ড্রাইভার একজন ভদ্রমহিলার সামনে তার সাগরেদকেও একটা নেংরা গালি দিতে সংকোচ বোধ করে! সেখানে ফেবুতে সুট টাই পড়ে বাংলা ভাষার সবচেয়ে নোংরা শব্দের গালি যত্রতত্র দিতে অনেকেই সংকোচ বোধ করেন না!
এখন ভাবার বিষয়, এসব মানুষের মানসিক বৈকল্য কি? বা মানসিক বিকলঙ্গতার কারণ কি? কেনো এরা এত অসহিষ্ণু? কেনো মানুষকে সম্মান প্রর্দশন করতে তাদের এত অনিহা? তারা নিজেরা কি সমাজে, সংসারে বা তাদের কর্মস্থলে কোনোভাবে সম্মান থেকে বঞ্চিত? তাইতো তারা পারস্পারিক ভাতৃত্ববোধটাকে ভুলে শুধু আমার আমিকে নিয়ে মেতে উঠেছে।
নারী বিদ্বেষের সামাজিকীকরণ থেকে, তা আজ বানিজ্যিককরণে গিয়ে প্রসার লাভ করেছে! চায়ের দোকানের আড্ড থেকে ওয়াজমাহফিল পর্যন্ত তার জয়জয়কার। নারীকে কষে দুটো গাল না দিলে অনেকেরই ভাত হজম হয় না! যদি প্রশ্ন করি, “যার পেটে জন্ম নিলেন, যাকে জন্ম দিলেন, যে আপনার সহদর তারা কি নারী না?” তখন একবাক্যে রব উঠবে, “তারা তেমন নারী না।” তবে তারা কেমন নারী? তারা তাদের ভালোবাসার নারী, মমতার নারী, স্নেহের নারী, আদরের নারী। তাই তারা আলাদা! বাকী নারীগুলোর তো বাপ নাই! ভাই নাই! প্রিয় নাই! পুত্র নাই! তাই তো তারা কাঠগড়ায়!
যে পুরুষ বলে, “ওর স্বামী সন্তান মরছে, ওর বাঁচতে হবে কেনো?” তাকে প্রশ্ন করেন তো,“ নারী যদি তোমার মেয়ে হয়? যদি হয় তোমার আদরের বোন? যদি তোমার বান্ধবী হয়?” এভাবে মৃত্যু কামনা করতে কি তোমার একবারও বাঁধবে না? অনেকে বলেছেন এটা নাকি ‘সতি দাহ’ এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মুসলিম দাবী করা এ মানুষগুলোর বংশগতিতে যে সতি দাহ করা পূর্বপুরুষের বংশগতি বিলক্ষণ মজুদ আছে। প্রশ্ন হলো, ‘তা থেকে মুক্তির উপায় কি?” নাকি সব এভাবে চলতে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলার বুদ্ধিটা তো শেয়াল পন্ডিতের কাছ থেকে গল্পে গল্পে আগেই ধার করেছি আমরা!
তবে সামাজিক যোগাযোগের কি হবে? দুটো গালি না দিলে, নারীকে নিয়ে স্লাঙ না বললে, শারীরিক চাহিদার ইঙ্গিত না দিলে ফেবুর ওয়ালের পেষ্টগুলো যে বাপ মা হারা এতিম ভেড়া হবে! তবে ভেড়ার পালে বাছুর হতে পারবে কি ‘কাকের কবি’রা? তাদের জন্য সমবেদনা রইলো। সুচিন্তার প্রসার ঘটুক। প্রগতিকে দাও গতি।(press for progress এর বাংলা করেছেন আমাদের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক ‘প্রগতিকে দাও গতি’।)