শেখ তাসলিমা মুন

শেখ তাসলিমা মুন বর্তমানে সুইডেন প্রবাসী। সুইডিশ রাজনীতিতে সোসাল ডেমক্রেট হিসেবে সক্রিয়ভাবেই যুক্ত আছেন। সুইডেনের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে জুরিমেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাসলিমা সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এক্টিভিজম ছাড়াও নারী অধিকার এবং ধর্মীয় গোড়ামীর বিরুদ্ধে এই লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করেন।

ক্ষমতার হাতে হাতে ফিরি আমি নারী

ফ্ল্যাশব্যাক।
১৯৮৪ সাল। আমার আইন ক্লাস হতো আমার আবাসিক হলের সবচাইতে কাছের বিল্ডিঙে। নাম মমতাজ উদ্দিন কলাভাবন। আমার আবাসিক হলের থেকে ৩০০ মিটার হবে বড়জোর। তখনও আইনে মেয়েরা খুব কম ভর্তি পায়। পায় বললাম এ কারনে তাদের নেওয়া হতোনা। একটি ধারনা ছিলো, মেয়েরা পড়বে বাংলা, সমাজ বিজ্ঞানে বা সমাজ কল্যাণে। এ সাবজেক্টগুলোতে মেয়েদের সংখ্যা দেখে সেটি বুঝাও যেতো। সে আলোচনাও কম বড় না। তবু আজ বলতে চাইছিলাম একটা অন্য কথা। বিশবিদ্যালয়ে আমার প্রথম শক এই তিনশো মিটারের পথটুকুন। 

ক্লাসের ফাঁকে ক্লাস বিরতির ঘণ্টাটুকুন ছিলো যন্ত্রনার। মেয়েদের একটি কমনরুম ছিলো সেখানে মেয়েরা কিচিরমিচির করতো। সেখানে বেশিক্ষণ বসা যেতোনা। বেশির ভাগ মেয়েরা এসে বলতো, তোমার কানের দুলটা কোথা থেকে কিনেছো। জামাটার কাপড় কোথায় পাবো? আমরা কয়েকটি মেয়ে মাত্র স্যারের পেছনে ক্লাসে ঢুকতাম। আমরা ছেলেদের থেকে আলাদা একটি বেঞ্চে বসতাম। ক্লাস শেষে স্যারদের পেছনে ক্লাস থেকে বেরিয়ে শিক্ষকরুমের সামনে দাঁড়াতাম। ক্লাসের সামনের সামান্য করিডোরটুকুন পার হতে আমাদের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে যেতো। করিডোরের দু’পাশে ছেলেরা দাঁড়িয়ে। সিনিয়র ছেলেরাও সেখানে দাঁড়িয়ে। তাদের টিজিং ওয়ার্ডসগুলো এত বেদনার ছিলো! যেমন কানের কাছে এসে জোরে এমন একটি শব্দ উচ্চারণ করতো যে কানতো ফেটে যেতোই, হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেতো বেশি। আমাদের একজন সহপাঠী সবচাইতে বেশি শিকার ছিলো এর। কোনো মেয়ে দেখতে খারাপ হলেও তাকে আগলি মন্তব্য সইতে হতো। দেখতে সুন্দর হলেও। আর মেধাবী হলেও। এদের সবার দোষ, ভিন্ন ভিন্ন দোষ।

অনুষদ থেকে হলে যাবার পথটুকুন যেতে আমাকে আমার ক্লাসের কোনো না কোনো ছেলের সাহায্য চাইতে হতো। 'তুমি কি আমাকে একটু হলে পৌঁছে দেবে?' তিনশো মিটার পথ একটি মেয়ে একা হাটলে সেখানে তাকে শুধু ইভটিজিং করেই ধরাশায়ী করে ফেলা হবে। এবং কত নিকৃষ্ট সেসব মন্তব্য কল্পনা করা যাবে না। একটি আমার এখনও মনে আছে, ''তোমার দুটি বক্ষ যেন দুটি আপেল পক্ক''। 

একবার আমি বাধ্য হয়ে একা আসছিলাম। আমার জুতার নীচটার অংশের কাঠ বের হয়ে যাওয়ায় একটু ঠক ঠক শব্দ হতো। প্রিয় জুতো জন্য ফেলে দেওয়া হতো না। আমি হাটছি। ঠক ঠক ঠক ঠক। দুটি ছেলে দু’দিক থেকে এসে আমার কানের কাছে এসে আমার জুতোর শব্দ নকল করে কানের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসেছে। বলছে 'ঘোড়া মেয়ে মানুষ' হঠাৎ আমার কি হলো জানি না, আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। ওরা দু’হাত পিছিয়ে গেলো। আমি পা থেকে জুতা খুলে ছুঁড়ে দিলাম ওদের মুখের উপর। রাস্তার দু’পাছে শত শত দর্শক। আমার মাথা কাজ করছে না। আমি অপমানে বেদনায় কাঁপছি। পায়ের অন্য জুতোটিও ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খালি পায়ে এক প্রকার দৌড়ে হলে ঢুকে গেলাম। এ ঘটনার পর আমি দু’দিন হল থেকে বেরুতে পারি নি। আমাকে নাকি 'নিহার বানু'র পরিণতি করে ছাড়বে। নিহার বানু ঘটনাটি অনেকের জানা। ১৯৭৬ সালে এই মেয়েটিকে ক্যাম্পাস থেকে নিয়ে গিয়ে গলায় টিপে হত্যা করা হয়েছিলো। 

ক্যাম্পাস জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর সরলতাগুলোর মুল্য একটু কম দিতে হতো। যে ছেলেকে বলতাম হলে পৌঁছে দিতে সেও চান্স নিতো ভাবতো প্রেম করছি তার সাথে সেগুলো প্রথম দিকে হ্যান্ডল করতে না পারলেও পরে বুঝে গিয়েছিলাম কি করনীয়। 

মাঝে মাঝে ছুটির দিনে হলের সামনে ঘাসে বসে আড্ডা দিতাম। কবিতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম সেদিন। হঠাৎ দেখি একটি মেয়ের হাত ধরে টেনে একটি পুরুষ রিক্সায় উঠানোর চেষ্টা করছে। মেয়েটি 'আমি যাবনা' 'আমি যাবনা' বলে চিৎকার করছে। দুপুরের দিক। ছুটির দুপুর। খুব ফাঁকা ক্যাম্পাস। এখানে সেখানে দু একটি জটলা মাত্র। আমরা পাঁচ ছ’জনের মতো ঘাসের উপর বসে। আমাদের সাথে দুটি ছেলে দৌড়ে গেলো। আমরাও পিছন পিছন। আমাদের ছেলেরা বললো, 'এই যে ভাইসাব সমস্যা কি? হাত ধরে টানাটানি কেনো?' 

মেয়েটিকে আমরা চিনি। কবিতা লেখে। ক্যাম্পাসে আবৃত্তিও করে। তার স্বামীকে সে ডিভোর্স পাঠিয়েছে। তার বাড়ি ক্যাম্পাসে বাইরে। তার স্বামী তাকে ক্যাম্পাস থেকে তাকে জোর করে নিয়ে যেতে এসেছে। অশ্রাব্য গালাগাল। 'আমার স্ত্রী আমি নিয়ে যাবো। আপনারা এখানে নাক গলাবেন না।' স্ত্রী শুনে আমাদের দলের সবাই একটু দমে গেলো। কয়েক মুহূর্ত। আমাদের ভেতর থেকে একজন বললো, নো! আপনার স্ত্রী হলেও আপনি তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে নিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। 
স্বামীটি তার স্ত্রীকে 'চরিত্রহীন' এবং সেই ম্যাজিক ওয়ার্ড 'বেশ্যা' বলে ভূষিত করতে লাগলো। আমাদের ছেলে দু’টি একটু চুপ ছিলো। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পাবার মতো কাছে গিয়ে খুব ঠান্ডা মাথায় বললো, 'এটি আমাদের ক্যাম্পাস। এখান থেকে কোনো মেয়েকে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। ক্লিয়ার? কথাটি মনে থাকবে? এই যে রিক্সা, উঠে সোজা ক্যাম্পাস ত্যাগ করুন।' 

সে হম্বি তম্বি করতে শুরু করলো। ইতিমধ্যে মুটামুটি একটি জটলা হয়ে গেছে সেখানে। স্বামী হুজুর বুঝলো তাকে যেতে হবে এবং একা। সে রিক্সায় উঠে চিৎকার করে বললো এ অপমানের প্রতিশোধ নেবে। তার অমুক আছে তমুক আছে। ছিঁড়ে ফেলবে সে। 

ছেলে দুটি বীর অনুভব নিয়ে সিনেমার হিরোর মতো মেয়েটিকে রক্ষা করার সুবাদে উপদেশ শুনিয়ে হলে ঢুকে যেতে নির্দেশ দিলো। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে হলে চলে গেলো। 

সেদিন একটা মিশ্র অনুভবে আক্রান্ত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো, এই যে ক্যাম্পাস সেখানে আমি নিয়ত ইভটিজিংএর শিকার। সেখানে একটি মেয়ে শুধু ক্যাম্পসের কারনে বেঁচে গেলো। ক্ষমতার সুক্ষ্ম এবং স্থুল চালে আমি মেয়ে নিয়ত গুটি। আমি হাতে হাতে ফিরি। কিন্তু নিজের শরীর এবং মনের আপন অভিভাকত্ব পাই কি?

অনেকদিন পর, যখন শুনলাম সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ জামানার একজন ভাইস চ্যান্সলর আইন ফরমাইয়েছেন যে স্বামী তার স্ত্রীকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার অধিকার রাখেন, চকিতে মনে হলো এমন কি আমাদের সেই নিদারুণ সময়ও কি তবে ছিলো 'আদর্শ' সময়?
ওহ আমার জন্মভুমি! ও আমার সন্ততি! 

4573 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।