শফিকুল ইসলাম খোকন

সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক

নাম দিয়ে কি সভ্য চেনা যায়?

কয়েকদিন আগে আমাকে নিয়ে আমার এক সহকর্মী ছবিসহ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। যেখানে আমার নামের অর্থের সঠিক উত্তরদাতাকে পুরস্কৃত করা হবে বলে ঘোষনা করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল ও সমালোচিত হওয়ায় শেষে ওই সহকর্মী নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। আমি ওই স্ট্যাটাসে সামাজিক ও মানসিকভাবে খুবই ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়েছি। হয়তো তিনি চেয়েছিলেন আমার নাম দিয়ে আমাকে চেনানো। সত্যিকার অর্থে কি নাম দিয়ে সভ্য মানুষ চেনা যায়? নাম দিয়ে মানুষকে ভালো-মন্দ বিচার করা যায়না। কখনো কখনো নামের অর্থেও ভালো-মন্দ থাকে। কিন্তু ওই নামে মানুষকে ভালো-মন্দ বিচার করার সুযোগ নেই।

রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ জন্ম থেকে শিখতে শুরু করে, মৃত্যু আগ পর্যন্ত শেখে। শেখার কোন শেষ নেই, শেখার কোন বয়স নেই। তেমনি একটি এলাকায় যদি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, সেখান থেকেও মানুষ শেখে। কোন কলহের সৃষ্টি হলে ওই কলহ থেকে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেঁছে নেয়। আবার কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সেখান থেকেও অনেকেই শিক্ষা নেয়। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি ধর্ষণ আর ধর্ষণ; প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ওই ধর্ষক বা ধর্ষিতা, তাদেরও একটা করে নাম আছে। নামে কি চেনা যায় এই পুরুষটি ধর্ষক আর এই নারী ধর্ষিতা? ঘটনার পরে বুঝা যায় কে ভালো কে খারাপ। স্বাধীন বাংলাদেশ সবুজ শ্যামলে ভরা সুন্দর একটি দেশ। ৯ মাসে স্বাধীন করে বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এ দেশটি। কিন্তু এ সুন্দর দেশেও কিছু অসুন্দর নামধারী পুরুষ ধর্ষণ নামক শব্দটি দিয়ে বিশ্বের কাছে নিচু করছে দেশটির।

ইয়াসমিনের কথা আমরা অবশ্যই ভুলে যাইনি। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট কিশোরী মেয়েটি কাজ শেষে ফিরতে চেয়েছিল গ্রামে, মায়ের কাছে। নরপশুরা ধর্ষণ ও হত্যা করে তাকে। ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটলো জাকিয়া সুলতানা রূপার; ইয়াসমিনের মতো এ নামটি এখন সকলের পরিচিত। সভ্য মানুষ হিসেবে মনে করেই রূপা সকলের মতো বাসে উঠেছিলেন তিনি। পরিশ্রমী, মেধাবী রূপার অপার সম্ভাবনা ছিল। অন্যদের মতো একজন নারী, যে শিক্ষক হতে চেয়েছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। স্বাধীন দেশে আর দশজন মধ্যবিত্ত মানুষের মতো পাবলিক বাসে করে গন্তব্যে পৌঁছতে চেয়েছিল, তার ছিল সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার একটি স্বপ্ন। ‘নিরাপদ’ নামের একটি বাসে ধর্ষণের শিকার হয় রূপা। রূপাকে বাসে বসেই গণধর্ষণ করে মাথা থেঁতলে হত্যা করে বাসের চালক, সুপারভাইজার, কন্ডাক্টররা। রূপাকে বহণকারী বাসের নাম ‘নিরাপদ’। বাসে লেখা ছিল ‘গড ব্লেস ইউ’। সবচেয়ে অনিরাপদ বাসটির নাম ‘নিরাপদ’। ‘নিরাপদ’ ও ‘গড ব্লেস ইউ’ শোভিত সে বাসেই ঘটে গেল সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা।

আগেই বলেছি নাম দিয়ে সভ্য চেনা যায় না। যেখানে বাসটির নাম ‘নিরাপদ’ ছিল। রূপা নিরাপদ বাসেই অনিরাপদ হয়েছিল। পাঁচজন পুরুষ। কারো মনেই এতটুকু দয়ামায়া জাগল না? এদের অনেকেই বিবাহিত ছিল। গণধর্ষণ করেই ওরা ক্ষান্ত হয়ে যায়নি। ধর্ষণ শেষে ঘাড় মুড়ে রূপাকে নৃশংসভাবে রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এরা সবাই রাতে বাড়িতে স্বজনদের কাছে যায়। বাড়িতে গিয়ে কেউ আদরের মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে। কেউ মা, বোন, স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেছে। ওই সময় এতটুকুও ভাবলো না, ‘আমার মেয়ের মতো এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছি, আমার বোনের মতো এক বোনকে ধর্ষণ শেষে নৃশংসভাবে হত্যা করেছি’। রূপাকে দেখে এদের কাউকে মনে পড়েনি? মনে হয়নি কাল রূপার জায়গায় এদের যে কেউ হতে পারে?

আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিনই ধর্ষণ ঘটছে; এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি আসলে মানসিক রোগী হয়ে গেছি? কতিপয় পুরুষদের কি মনুষ্যত্ব বিকৃত হয়ে গেছে? ওই সকল পুরুষরা কি পশুত্ব বরণ করেছে? ওই সকল মানসিক রোগী ও পশুত্ব বরণকারী পুরুষ আকৃষ্ট হয়েছে ধর্ষণে। তারা শিখে গিয়েছে কী করে ধর্ষণ এবং নৃশংসতা একই সঙ্গে চলন্ত বাসের ভেতর করতে হয়। গণধর্ষণ করে কী করে ধর্ষিতাকে মেরে ফেলতে হয়, কি করে ধর্ষণের আলামত বা প্রমান নষ্ট করতে হয়। ভারতের জ্যোতি সিংকে ফেলেছিল রাস্তার কিনারে, রূপাকে ফেলেছিল জঙ্গলে। রূপার ধর্ষকরা রূপার মাথা থেঁতলে মৃত্যূ নিশ্চিত করে ফেলে দেয় জঙ্গলে। একটি ঘটনা বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে, অন্যটি ভারতের দিল্লিতে। একটিতে ধর্ষকরা হিন্দু, ধর্ষকদের শিকারও হিন্দু। আরেকটিতে দু’পক্ষই মুসলিম। ধর্ষণ সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব ভাষার, সব দেশের, সব সংস্কৃতির মানুষই করে। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই করে। আজ কোথাও শিশু ধর্ষণ ঘটলে পর পর অনেকগুলো শিশু ধর্ষণ ঘটবে। তারই ধারাবাহিকতায় গত কয়েকদিন ধরে ধর্ষণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ওইসকল কতিপয় পুরুষদের যৌণ চরিতার্থ মেটানোর জন্য রেহাই পায়নি ঈদের দিনও। পটুয়াখালীর বাউফলের ২২বছরের একটি মেয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে যাওয়ার পথে চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়। ঈদের আগের দিন গাইবান্দার ফুলছড়ির মাত্র ৮ বছরের সিনথিয়াকে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বরগুনার বেতাগীতে নারী শিক্ষককে বিদ্যালয়ে ধর্ষণ, একই জেলার পাথরঘাটা উপজেলা মামা কর্তৃক ভাগ্নি ধর্ষণ। সব মিলিয়ে আমাদের দাবিদার এ সভ্য সমাজ কি জানান দিচ্ছে?

সারা বিশ্বে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে নিরবধি ঘটেই চলেছে। নারীবিদ্বেষ এত চরমে উঠেছে, যে, ঘরে বাইরে, রাস্তা ঘাটে, ট্রেনে বাসে নারীকে ধর্ষণ আর খুন করেই চলেছে পুরুষেরা। লোকে মন্দ বলুক, আদালত শাস্তি দিক, তাতে কি কারও কিছু যায় আসে না। সকলেই ভাবে অনেকে যেমন অপরাধ করেও ধরা পড়ে না, তারাও তেমন ধরা পড়বে না। কেউ কেউ হয়তো ভাবে, ধরা পড়লেও ছাড়া পেতে আর কতক্ষণ! টাকা পয়সা ঢাললেই সাত খুন মাফ। বিচারহীনতার কারণেই হয়তো ধর্ষণের মতো অপরাধ করে সহজেই অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন, ২০১৬ সালে ৬৮৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার (বিএমবিএস) মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনের তথ্যমতে, ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিএমবিএসের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুধু জুলাই মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮০ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে ৩২ জন কন্যাশিশু। ধর্ষণ চরম আকার ধারণ করেছে। এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নামার সময় এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দেরি করার অবকাশ নেই।

পরিশেষে বলতে চাই- স্বাধীন রাষ্ট্রটি নারী নেতৃত্বে চলছে বাস্তবিক অর্থে পরিবার-সমাজ এখনো পুরুষ শাসিত। এ জন্য নেতৃত্বদানকারী পুরুষ শুদ্ধ না হলে, সুস্থ না হলে, সভ্য না হলে, সত্যিকার শিক্ষিত না হলে, সচেতন না হলে– নারীরা যতই শিক্ষিত হোক, সচেতন হোক, যতই তারা স্বনির্ভর হোক, কোনও লাভ নেই। ওইসব পুরুষ চরিত্রগতভাবে ভালো নাহলে সমাজকে কলুষিত করবেই। তবে এ দায় থেকে এড়াতে পারেন না ঘরের নারীরাও। তাই আসুন অসভ্য সমাজসেক সভ্য সমাজে রুপ দেওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি। শুধু নামেই নিরাপদ নয়, বাস্তবে নারীকে নিরাপদ রাখি।

2270 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।