খান আসাদ

সমাজকর্মী

রাজনীতির রং

একটি রাজনৈতিক ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। "সাম্প্রদায়িক হামলাকে" ব্যাখ্যা করা যায় “জমি দখলের বা শ্রেণি শোষণের” প্রকাশ হিসেবে। “মৌলবাদী ধর্মসহিংসতাকে” নিন্দার বদলে, এদেরকে গৌরবান্বিত করা যায় “ধার্মীক বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী" হিসেবে নামকরণ করে।
 
রাজনীতির বয়ান নির্ধারিত হয় কেবল ফ্যাক্টস বা বাস্তব ঘটনা দিয়ে নয়, ঘটনাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, কি নামে ডাকা হচ্ছে, সেটা দিয়ে। ১৯৭১ সালের “মুক্তিযুদ্ধ" কারো কাছে “গন্ডগোলের বছর”, দু’একজন ভেবেছেন “দুই কুকুরের কামড়া কামড়ি”, মানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব। পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সমাজের মৌলিক আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব এদের নজরে পড়ে নি। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য অনেকের নজরে আসে না।
 
 
এই যে নজরে আসা না আসা এবং ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করা, এদের মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে। এটি ঘটে ব্যক্তির মনোজগতে, চিন্তায়, আত্মগতভাবে। যে রং আপনার নজরে এসেছে এবং যেই রংয়ের নাম আপনার ভাবনায় খেলা করে, তা কেবল বুদ্ধি নয় আবেগ দিয়েও ঘটে। কিছু রং আপনি দেখতে চান না, ইমোশনাল ডিফেন্স রয়েছে, নানা মনস্তাত্ত্বিক কারণে। আপনার সামনে রংধনুর সাত রং থাকলেও, আপনি সাদা কালো রং নিয়েই কথা বলবেন।
 
আপনি সব রং দেখতে চান না, নজরে আসে না, ফলে নাম করেন কেবল জানা সব রংয়ের। এই রং আপনার মগজের ছাকুনিতে ফিল্টার হয়ে আসে। ভিন্ন ভাবে বলা, মানে ভিন্ন ভাবে দেখা, ভিন্ন ভাবে দেখা মানে ভিন্ন ছাকুনি থেকে ফিল্টার হয়ে বেরুনো। এই ছাকুনিটার নাম "মতাদর্শ"।
 
এই মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে একই পরিবারের লোকেরাও ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল সমর্থন করে। ছাকুনির বা মতাদর্শের বদল হলে, সময়ের সাথে সাথে ব্যক্তির নিজের রাজনৈতিক অবস্থান ও বিশ্বাসের বদল হয়ে যায়। ছাত্রশিবির করা লোক সাম্যবাদী হয়, বামদল ছেড়ে যোগ দেয় বিএনপি কিংবা আওয়ামীলীগে, কেউবা বাম থেকে পতিত হয় বামাতিতে, মূলত যা জামাতি।
 
আমাদের মগজের এই ছাকুনি "রাজনৈতিক মতাদর্শ" ব্যাপারটা কি?
এটা জটিল কিছু না। আমাদের মূল্যবোধ। যে বোধ বা বিশ্বাসগুলোকে আমরা ভাল বলে মনে করি, আরাধ্য ও কাঙ্খিত বলে মনে করি। যেই বিশ্বাস আমাদের আদর্শ। কারো কাছে “প্রতিযোগিতা" ভালো, কারো কাছে “সহযোগিতা", কারো কাছে “স্বাধীনতা" আদর্শ, কারো কাছে “ঐতিহ্য", কারো আছে “পীরভক্তি" (কর্তৃত্ববাদ), কেউবা সকলের “সমতায়" ও ব্যক্তিসন্মানে আস্থাশীল।
 
রাজনৈতিক মতাদর্শ মানে, সমাজের নিয়ম কানুন ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের মত বা বিশ্বাস, কোনটি ভাল এবং কোনটি মন্দ, সে সম্পর্কে অবস্থান ও সক্রিয়তা। সক্রিয়তা মানে, এই ভালো মন্দ বোধের (মূল্যবোধ) উপর নির্ভর করে আমাদের রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় নানা সিদ্ধান্তের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, সমর্থন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ।
 
অন্যকথায়, কোনো ঘটনাকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করছি, তা নির্ভর করে এই প্রাথমিক মতাদর্শের উপর। কোন ঘটনা বা প্রস্তাব কিভাবে মূল্যায়ন করছি, ভালো না মন্দ তা নির্ভর করে মতাদর্শের উপর। কোন দল বা নীতি আমরা সমর্থন করছি, তা নির্ভর করে মতাদর্শের উপর। এবং কোন ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কিভাবে অংশ নিচ্ছি, তা নির্ভর করে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার উপর।
 
এই “মতাদর্শ" প্রধানতঃ ছয় ধরনের, জেনেরিক বা মৌলিক চরিত্র বিচারে। ডান বাম দিয়ে শুরু করা যাক। ডানে আছে (১) রক্ষনশীলেরা, এবং বামে (২) উদারনৈতিকেরা। রক্ষনশীলদের ডানে যারা, অতি ডান হচ্ছে (৩) ফ্যাসীবাদ। উদারনৈতিকদের বামে প্রথমে আছে (৪) সমাজতন্ত্রীরা, তারপরে (৫) সাম্যবাদীরা, এবং সর্ববামে (৬) এনার্কিস্ট বা নৈরাষ্ট্রবাদীরা। (Andrew Heywood এর Political Ideologies নামের বইটি মতাদর্শ বোঝার জন্য খুব কাজের। যদিও আমি এই লেখকের নিজের উদারনৈতিক অবস্থানের সমর্থক নই।)
 
রক্ষনশীল কিনা তা চেনার উপায়, যারা এই ধারনা পোষণ করেঃ (এক) মানুষ নিজের বুদ্ধিতে চলার মতো যোগ্য না, ফলে এদের জন্য নিয়ম নীতি আর অভিভাবক দরকার আছে। (দুই) প্রচলিত ব্যাবস্থা বদল হলে ভালো হবে কিনা জানি না, তাই প্রচলিত বিশ্বাস, ধ্যান ধারনা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা বহাল রাখা দরকার। (তিন) যা কিছু ভালো তা এসেছে আমাদের ঐতিহ্য থেকে, সেটা অনুসরন করা উচিত (আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম)। (চার) হাতের পাচ আংগুল সমান না, বৈষম্য ছিলই, ধনী গরিব নারী পুরুষ বৈষম্য থাকবেই। (ছয়) শৃংখলার দরকার আছে যেহেতু মানুষ তার নিজের ভাল বোঝে না, স্বাধীনতার নামে যথেচ্ছাচার হতে দেয়া যায় না (নারী স্বাধীনতা, প্রেম ট্রেম ভালো না, উশৃংখলতা)।
 
উদারনৈতিক চেনার উপায়, যাদের ধারনাঃ (এক) ব্যক্তির যোগ্যতা আছে, বা যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। নিজের ভাল পাগলেও বোঝে। (দুই) মানুষের অপরের প্রতি সহনশীলতা থাকা দরকার। (তিন) ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমান সুযোগ থাকতে হবে। (চার) ব্যক্তির অধিকার রয়েছে সম্পত্তির, মতপ্রকাশের এবং স্বতন্ত্র পছন্দ নিয়ে বাঁচার। (পাচ) রাষ্ট্রকে হতে হবে গনতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক।
 
ফ্যাসিবাদের ভালো বাংলা "সর্বাত্মকস্বৈরাচার" হতে পারে কিনা জানি না, কিন্তু কাছাকাছি সন্দেহ নেই। ইংরেজী ফ্যাসিজমের বাংলা “ফ্যাসিবাদ”, রক্ষনশীলদের থেকেও ডানে, উগ্র এবং জঙ্গিপনায় সহিংস, জীবন মানেই যুদ্ধ-জিহাদ-সংগ্রাম ধারনায় বিশ্বাসী।
 
মুসোলিনির বানী ছিলো, "বিশ্বাস কর, বাধ্য থাকো এবং যুদ্ধ করো”। হিটলার বিশ্বাস করতে বলেছে “জাতি শ্রেষ্ঠত্বে”। বিভিন্ন ধর্মীয় মৌলবাদীরা এই আত্মপরিচয় শ্রেষ্ঠত্বে দাবী করে আসছে। রাজনৈতিক ইসলাম বা মুসলমান মৌলবাদীরা বলে তারা হচ্ছে, "সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত, জিহাদের জন্য জীবন, মরলে শহিদ বাঁচলে গাজী”। জামাতে ইসলামীর নেতা গোলাম আজমও কর্মীদের “বিশ্বাস করো, বাধ্য থাকো এবং জিহাদ (যুদ্ধ) করো” - এই মন্ত্রই দিয়েছেন।
 
ফ্যাসিবাদ একটি গালির মতো হয়ে গেছে, হিটলার মুসোলিনির অভিজ্ঞতার পর। রক্ষনশীল ও লিবারেলদেরকেও (উদারনৈতিক) অনেক বামকর্মী ফ্যাসিস্ট বলে গালি দেয়। এই মতাদর্শটি সম্পর্কে সেকারণে ভুল ধারনা তৈরি হতে পারে। ফ্যাসীবাদের উদহারন, হিটলার, মুসোলিনি, মওদুদী (জামাতে ইসলামী)। সেজন্য এই মতাদর্শটি একটু ভালো করে চেনা উচিত।
 
ফ্যাসিবাদের মুল্যবোধ, নীতি আদর্শঃ (এক) মুক্তচিন্তা, বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতা, র‍্যাশনালিটি বা রিজনের (যুক্তিবোধের) বিরোধীতা করা। এরা এন্টীর‍্যাশনাল এবং এন্টিইন্টেলেকচুয়াল। (দুই) বিজ্ঞান বিরোধীতা (প্রযুক্তি ব্যবহারে আপত্তি নেই)। (তিন) গনতন্ত্রের বিরোধীতা (নির্বাচন কৌশল মাত্র, যুদ্ধের বা জিহাদের জন্য। নারী নেতৃত্ব হারাম কিন্তু জিহাদের স্বার্থে হালাল)। (চার) নেতার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য। (পাঁচ) রাষ্ট্রবাদীতা, রাষ্ট্র হাতে সকল ক্ষমতা। (ছয়) আত্মপরিচয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারনা, ফলে জাতিভেদ, বর্ণভেদ, লিঙ্গভেদ (পুরুষ শ্রেষ্ঠ) ও সাম্প্রদায়িক। (সাত) সামরিকতন্ত্র; যেহেতু জীবন মানেই যুদ্ধ/জিহাদ।
 
সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ও নৈরাষ্ট্রবাদ আলাদা আলাদা মতাদর্শ হলেও একটি ঘরানা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এক কথায় বামপন্থা। নৈরাষ্ট্রবাদী হিসেবে পেটার ক্রপটকিন ও নোয়াম চমস্কির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
 
সমাজতন্ত্রী বা সাম্যবাদীরা লিবারেলদের বা উদারনৈতিকদের মতাদর্শ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারনাকেই আরো বিকশিত ও সম্প্রসারিত করেছে, এবং সামাজিক মুক্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। লিবারেলদের রাজনৈতিক গনতন্ত্রকে সম্প্রসারিত করতে চেয়েছে, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও। কেবল বিত্তবান শ্রেণির পুরুষদের নয়, সকল শ্রেণির ও সকল জাতির নারী-পুরুষের সাম্য ও স্বাধীনতা হচ্ছে এদের লক্ষ্য।
 
বামপন্থার মূলধারনা সমূহ (এক) সমতা (মানুষে মানুষে, নারী-পুরুষে, সকল ধরনের বৈষম্যের বিলুপ্তি)। (দুই) সহযোগিতা; সম্পদ উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা ও সহভাগিতা (উৎপাদন উপকরণের সামাজিক মালিকানা)। (তিন) স্বাধীনতা; ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার (প্রয়োজন অনুযায়ী নেবে, যোগ্যতা অনুযায়ী দেবে)। (চার) ন্যায্যতা; সম্পদের সুষম বন্টন। (পাচ) শান্তি; যেহেতু শ্রেণি ও পিতৃতান্ত্রিক স্বার্থ ও ক্ষমতাচর্চার দ্বন্দ্ব থেকে সহিংসতা, ফলে শ্রেণি ও পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তির মধ্যদিয়ে শান্তিপুর্ণ সমাজ।
 
রক্ষনশীল, ফ্যাসিবাদ, উদারনৈতিক এবং বামপন্থী (সমাজতন্ত্রী/সাম্যবাদী/নৈরাষ্ট্রবাদী), এই চার ধরন বিবেচনায় নিলে আমরা প্রধান চারটি রাজনৈতিক মতাদর্শ পাই। অন্যভাবে বললে, আমাদের সমাজের সকল মানুষের রাজনৈতিক ঘটনার ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক দল পছন্দ, রাজনৈতিক কর্মসুচী সমর্থন ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ঘটে থাকে, এই চার ঘরানার রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো না কোনোটিতে তাদের বিশ্বাস আছে বলে। এই সমতাদর্শের ব্যক্তিরা পরস্পরকে না চিনলেও এরা একটি রাজনৈতিক ব্লক বা সমাজশক্তি। ফলে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি, রক্ষণশীল সমাজশক্তি, উদারনৈতিক সমাজশক্তি, ফ্যাসিবাদী সমাজশক্তি ও বামপন্থী সমাজশক্তির যে কোনো একটির অংশ।
 
রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে, এই বিভিন্ন সমাজশক্তির সংগঠিত রূপ হিসেবে। নিজেদের মতাদর্শের সমাজশক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করা, নেতৃত্ব দেয়া ও এই সমাজশক্তির পছন্দের নীতিসমুহ ক্ষমতায় গিয়ে বাস্তবায়ন করা। ফলে নানা রাজনৈতিক দলকে, এই প্রধান চার রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো না কোনোটির অনুসারী বলা যাবে। এই মতাদর্শ কি রকম, তা প্রাথমিক ভাবে জানা যায় এদের ঘোষনাপত্র ও গঠনতন্ত্র পাঠ করলে।
 
এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, কোন রাজনৈতিক দল, ডান বাম নির্বিশেষে কি তাদের ঘোষিত মতাদর্শ (ঘোষনাপত্র) অনুসারে চলে? সঠিক প্রশ্ন। বাস্তবে, কোনো ব্যক্তি, সামাজিক ব্লক বা রাজনৈতিক দল আক্ষরিক ভাবে মতাদর্শ অনুসরন করতে পারে না। বাস্তবে কোনো দলই আক্ষরিক অর্থে সকল মূল্যবোধ চর্চা করতে পারে না। প্রায় সব রাজনৈতিক দলকেই তাদের “বিচ্যুতি",“স্ববিরোধিতা" কিংবা "রং বদলের" সমালোচনা করা যায়।
 
কেনো এই ঘোষিত বিশ্বাস, কর্মসুচী আর বাস্তব আচরণের পার্থক্য? এর কারণ সাধারনভাবে "বিশ্বাসযোগ্য" কোনো কিছু “অর্জনযোগ্য" করে তোলা নির্ভর করে, কেবল আত্মগত ইচ্ছার উপর নয়, রাজনীতির সমীকরন (বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষন) ও রণনীতি রণকৌশলের উপর। কোনো দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে এক ধরনের আচরণ করে, যা তার ঘোষিত মতাদর্শের থেকে ভিন্ন হতে পারে। এখানে দলকে রাষ্ট্রযন্ত্রের (সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র) সাথে, ক্ষমতাধর শ্রেণির (বিভিন্ন সিন্ডিকেট) সাথে এবং আন্তর্জাতিক শক্তির সাথে দেন দরবার করতে হয়। ক্ষমতার স্বার্থ ও মতাদর্শের অবস্থানের মধ্যে অগ্রাধিকার দিতে হয়, এবং অনেক ক্ষেত্রেই মতাদর্শের সাথে আপোস করতে হয়। যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে, কিংবা নির্বাচনী রাজনীতি করে না, তাদের জন্য নিষ্ক্রিয় মতাদর্শ চর্চা (কেবল লেখালেখি) অনেক সহজ।
 
কিন্তু এই আপোস, স্ববিরোধিতা, বিচ্যুতি থাকা মানে এই না যে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান মতাদর্শ নেই। এমন হতে পারে, একটি দল রক্ষনশীল ও উদারনৈতিক দুই মতাদর্শের লোকের প্লাটফর্ম, একটি সময়ে নেতৃত্বে আসছে রক্ষণশীলেরা, অন্য সময়ে উদারনৈতিকেরা।
 
সমাজতান্ত্রিক পুর্বজার্মান ক্ষমতাসীন পার্টির ঘোষিত অবস্থান ছিলো সাম্যবাদী। ক্ষমতা হারানোর পর, এক অংশ রক্ষণশীল দলে ঢুকে যায়, এক অংশ উদারনৈতিক দলে যোগ দেয় এবং এক অংশ সাম্যবাদীই থেকে যায়। বাংলাদেশে সিপিবি থেকে আওয়ামীলীগ ও বিএনপিতে কিছু লোক যোগ দিয়েছে, সোভিয়েতের বিলুপ্তির পর। বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের কিছু নেতা এখন বিএনপির উঁচু পদে। তার মানে ভিন্ন মতাদর্শের পার্টিতে কিছুদিন থাকা যায়, অভিন্ন মতাদর্শ না থাকলেও। তারপর এক সময় নিজ ঘরে (মতাদর্শ ব্লকে) ফিরে যায়।
 
কিভাবে বুঝব যে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল কোন মতাদর্শের অনুসারী? এটি প্রধানত কি মতাদর্শ ধারন করে?
 
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মতাদর্শ চেনার কিছু মডেল আছে। কিছু ইন্ডিকেটর বা নির্দেশক আছে। আগে মডেলের কথায় আসি। প্রথমটি ডান বাম সমান্তরাল রেখা মডেল। বাম থেকে ডানে একটি সমান্তরাল রেখা টানুন, এই রেখার ডানদিকে সর্বশেষে ফ্যাসীবাদ এবং সর্ববামে নৈরাষ্ট্রবাদ লিখুন। এবার ফ্যাসিবাদের বামে বসান রক্ষনশীল, তারপর উদারনৈতিক, তারপর সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী। এখন বাংলাদেশের প্রধান চারটি রাজনৈতিক ঘরানা, বামপন্থী, আওয়ামীলীগপন্থী, বিএনপিপন্থী ও জামাত পন্থীদের এই ডান বাম লাইনের কোথাও বসিয়ে দিন। যে বিবেচনায় বসালেন সেগুলিই ইন্ডিকেটর বা নির্দেশক।
 
দ্বিতীয় মডেলটি হচ্ছে “হর্স শ্যু” বা ঘোড়ার নালের আকার, বা উল্টানো ইংরেজি U অক্ষর। এই উল্টানো ইউ এর মাথায় রয়েছে উদারতাবাদ, সবার সামনে, এবং দুই লেজের দুই মাথায় বামে নৈরাষ্ট্রবাদ এবং ডানে ফ্যাসীবাদ। আমার এক সিনিয়র বন্ধু রাজনীতি আলোচনার ক্লাসে অতিবাম এবং অতিডান নিয়ে মজা করতেন। তার ভাষ্যমতে বেশি “অতি" হয়ে গেলে "এরা ডান ও বাম পরস্পরের ল্যাঞ্জায় জড়িয়ে যায়। অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো না।” এই মডেলে আমি উদারনৈতিক মতাদর্শের প্রতি পক্ষপাত দেখি। মতাদর্শ আলোচনাও কিন্তু “মতাদর্শের" বাইরে থেকে করা মুশকিল।
 
সাম্প্রতিক কালে, মতাদর্শ বোঝার জন্য "রাজনৈতিকমানচিত্র" তৈরির একটি মডেল আছে যা ব্যক্তির রাজনৈতিক মতাদর্শ ও রাজনৈতিক দলের অবস্থান ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহার করা হয়। (২০১০ সালের বৃটিশ নির্বাচনের সময় পলিটিকালকম্পাস নামের একটি সংগঠন এটিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শ অবস্থান ব্যাখ্যা করে।)
 
এই মডেল অনুসারে, সমান্তরাল সরলরেখায় ডান বা বাম, অথবা উল্টানো ইউ দিয়ে নয়, মতাদর্শগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি যোগ বা ক্রস (+) আকুন। উপরে নিচে ও ডানে বামের রেখাগুলো বাড়িয়ে নিন। উপড়ে লিখুন কতৃত্ববাদ (ফ্যাসীজম), নীচে উদারতাবাদ (নৈরাষ্ট্রবাদ), ডানদিকে রক্ষনশীল (নয়া-উদারতাবাদী) ও বামদিকে বামপন্থী (সাম্যবাদী)।
 
আমরা চারটে অবস্থান পাই। উপরের ডানে বামে এবং নীচের ডানে বামে। এখানে দেখা যায়, ব্যক্তির বা দলের চিন্তা বামউদারনৈতিক (বাম নীচের ঘরে) অথবা বামকর্তৃত্ববাদী (বাম উপরের ঘরে) হতে পারে। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন কিন্তু মেয়ে প্রেম করছে তা মেনে নিতে পারছেন না, আপনি বামকর্তৃত্ববাদী আবার সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন এবং মেয়ের প্রেমিককে বন্ধু ভাবছেন, আপনি বামউদারনৈতিক। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় কিউবানদের আমার বামউদারনৈতিক মনে হয়, একই ভাবে চীনাদের বামকর্তৃত্ববাদী মনে হয়।
 
বাংলাদেশের উদহারণ দিয়ে যদি বলি, এখানে প্রধান চারটি পন্থা আছে। আওয়ামীপন্থা, বিএনপি পন্থা, জামাত পন্থা ও বামপন্থা। রাজনৈতিক মানচিত্রের উপরের দিকে জামাতপন্থী ও নীচের দিকে বামপন্থী রাখুন। জামাতপন্থীদের নানা দল আছে, কেউ শান্তিপুর্ণ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়, কেউ জিহাদ করে। নামে "হিজবুত তাহিরির" বা "মোজাহেদিন", যা ই হোক না কেনো, মূল মতাদর্শ একটাই, এরা "ইসলামী রাষ্ট্র ও শরীয়া আইন" চায়, ধর্মশ্রেষ্ঠত্বের সর্বাত্বক কর্তৃত্ব, ফলে চেহারায় মোল্লাতন্ত্র চরিত্রে ফ্যাসীবাদ।
 
বামপন্থীও আছে নানা রং নিয়ে, কিন্তু দিনের শেষে, মতাদর্শ ঐ একটিই, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও শ্রেণিভেদহীন সমাজ চাই। কোন পথে এগুবে, শান্তিপুর্ণ নাকি সশস্ত্র এই নিয়ে বিস্তর মতভেদ থাকলেও, অর্থাৎ রাজনীতির সমীকরণে বিস্তর ফারাক, রণনীতি রণকৌশল নির্ধারনেও উল্টো পথ (নির্বাচন নিয়ে), কিন্তু “সমাজতান্ত্রিক" বা “সাম্যবাদী" ঘরানার ভেতরেই থাকছে।
 
সর্বশেষ মডেল, যা আমি পছন্দ করি ও কর্মশালায় ব্যবহার করছি, সেটি এই উপরে দেখানো ক্রস মডেলই (উপর নিচ ডান বাম), শুধু ডাইনামিক বা গতিশীলতা যুক্ত করে নিতে হবে। মানে ফটোগ্রাফী নয় ভিডিও দেখতে হবে, ঐতিহাসিক ভাবে কোন পার্টি কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসের কোন সময়ে কি কর্মসূচি আচরণ ও মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এক্ষেত্রে আভ্যন্তরিন ও বাইরের বাস্তব প্রভাব কি ছিলো, ইত্যাদি। কি রং এর ছিলো, এখন কোন রং এবং ভবিষ্যতে কি রং ধারন করার সম্ভাবনা রয়েছে, তা বোঝার জন্য, এই ডাইনামিক মডেল বেশ উপকারী।
 
একটি কথা বলে নিতে চাই। উদারনৈতিক ও রক্ষণশীলদের ডানে বায়ে হেলদোল নির্ভর করে বামপন্থী সমাজশক্তি ও ফ্যাসিবাদী সমাজশক্তির ক্ষমতা ভারসাম্যের উপর। একটি সমাজে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ প্রভাবশালী হলে উদারনৈতিকেরা ডানে সরতে থাকে, আবার বামপন্থীরা শক্তিশালী হলে বামের দিকে ঝুঁকতে থাকে।
 
ব্যক্তির ও দলের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে অনেক একাডেমিক গবেষনা আছে।এই গবেষনায় কয়েক ধরনের ইন্ডিকেটর বা নির্দেশক পাই। এই ইন্ডিকেটর অবজেকটিভলি প্রমাণযোগ্য না হলে তা বাকোয়াজ, সমাজবিজ্ঞান নয়।
 
প্রথমতঃ পার্টির লিখিত দলিলপত্র দেখতে হবে। এই দলিলপত্রে যা আছে তার সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও বাস্তব আন্দোলন, নির্বাচন, জোট ইত্যাদি ক্ষেত্রে পার্টির আচরণ।
 
দ্বিতীয়তঃ দেখতে হবে ভোটিং প্যাটার্ন। সমাজের কোন অংশ, কোন সমাজশক্তির ভোট এরা পেয়ে থাকে। তৃতীয়তঃ মতামত সার্ভে। নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের (ভোটারদের) মতামত জানা। এই মতামত সার্ভে নিয়ে অনেক জটিল আলোচনা আছে, বিশেষ করে গবেষকের নিজের ব্যক্তি মতাদর্শ এবং প্রশ্নপত্রের ধরন ও মান নিয়ে। সে আলোচনা আপাতত থাক।
 
পরিশেষে, কেউ কেউ ভাবতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন, রাজনৈতিক মতাদর্শকে কি খুব গুরুত্ব দেয়ার দরকার আছে?
জ্বী আছে। সমাজকে প্রগতির দিকে এগিয়ে নিতে হলে, একটি সমৃদ্ধ, মানবিক ও শান্তিপুর্ণ সমাজ নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অর্জন করতে হলে, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। এই সুসংবদ্ধ ভাবনাটাই রাজনৈতিক মতাদর্শ।

2322 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।