নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য, ঘাতক ধর্ষক পুরুষ উৎপাদনের প্রক্রিয়াটা বন্ধ করার কাজটি হয়তো আগামীকাল নয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ফল দেবে। এই কাজটি ঘাতক ধর্ষক উৎপাদনের উৎসমুখ বন্ধ করে দেয়ার। এই ঘাতক ধর্ষক পুরুষ উৎপাদনের বীজ বপন করা হয় পরিবারে, পারিবারিক শিক্ষায়, শিশু বয়স থেকেই। ফলে ঘাতক ধর্ষকের সহিংসতার দায় যেমন তার নিজের, তেমনি পরিবারের, রাষ্ট্রের তথা সমাজেরও।
রাষ্ট্রের যথাযথ ভূমিকা পালনের জন্য আন্দোলন করবেন তো বটেই, কিন্তু পারিবারিক শিক্ষার ভূমিকাকে সেজন্য অবহেলা করা অন্যায়। আপনি নিজ পরিবার ও পরিচিত মানুষজনদের শিশুপুত্রদের পারিবারিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন, যাতে করে ছেলেশিশুটি মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, সংবেদনশীল ও নারীবাদী হিসেবে বেড়ে ওঠে। (নারীবাদী মানে নারী - পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী)।
শিশুদের মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, সৃজনশীল, নারীবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, শিশুদের মনস্তত্ত্ব বোঝা দরকার। শিশুদের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য আপনার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন নেই, কোনো ডিগ্রীর দরকার নেই। দরকার একটু মনোযোগ ও কাণ্ডজ্ঞান, যা আমাদের সবারই আছে।
প্রতিটি শিশুই অনন্য। আপনাকে শুধু একটু মনোযোগ দিয়ে শিশুটির আচরণ দেখতে হবে। শিশুরা খুব জটিল কোনো আচরণ করে না। সে কিছু জিনিষ পছন্দ করে, কিছু জিনিষ করে না। সে কখনো কাঁদে এবং কখনো হাসে, মানে কিছু অভিজ্ঞতা তাঁকে কাঁদায় এবং কিছু অভিজ্ঞতা হাঁসায়। কিছু বিষয় তাঁকে অনুপ্রাণিত করে, কিছু বিষয় তাঁকে নিরুৎসাহিত করে। ব্যাস, এটুকুই। এই কয়েকটি আচরণ পর্যবেক্ষণ করলেই আপনি শিশুটির অনন্য আচরণ বুঝতে পারবেন।
ফ্রয়েড খুব সহজভাবে শিশুমনস্তত্ত্ব নিয়ে বলেছেন। প্রাথমিকভাবে শিশুরা প্রকৃতিজাত, সহজাত বা প্রবৃত্তিগত প্রতিক্রিয়া করে, জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার জৈবিক প্রয়োজনে। এটি আপাতভাবে "স্বার্থপর" আচরণ মনে হতে পারে। কিন্তু যেহেতু তার শেখার ক্ষমতা আছে, সে ধীরে ধীরে বাবা মায়ের বা পরিবারের মূল্যবোধ ও নিয়মকানুন (ভাল মন্দ, উচিৎ অনুচিত, ট্যাবু বা নিষিদ্ধ এবং প্রশংসাযোগ্য আচরণ) রপ্ত করে নেয়।
এভাবেই, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ তথা নারীর প্রতি সহিংসতার বৈধতার শিক্ষা সে প্রথমে পরিবার থেকেই পেয়ে থাকে। অন্যভাবে বললে, একটি ছেলেশিশুর ঘাতক ধর্ষক হয়ে ওঠার দুর্ভাগ্য তখনই, যখন সে মানবিক মূল্যবোধ ও নারীবাদী নিয়মকানুনের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, পারিবারিক শিক্ষায়। তারপর, পারিবারিক পিতৃতান্ত্রিক শিক্ষা আরও সম্প্রসারিত হয় অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষায়।
আপনার পরিচিত শিশুটির আচরণে কি সমতার, সহযোগিতার, সহভাগিতার, সহনশীলতার, পরার্থপরতার, যত্নশীলতার, সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ ঘটে? সে কি গান বাজনায়, ছবি আঁকায়, গল্প শোনায়/পড়ায় আনন্দ পায়? সে কি মাকে, বোনকে, অন্যান্য মেয়েদের প্রতি সংবেদনশীল? সে কি দরিদ্র্যদের সাহায্য করে, কিংবা ভালো খাবার ভাগ করে খায়? না, এগুলো অটোমেটিক ঘটে না, ঘটে পারিবারিক শিক্ষায়। ছেলেশিশুটিকে অনুপ্রাণিত করতে হয়। মায়ের পেট থেকে কোনো ছেলে শিশু পিতৃতান্ত্রিকশূকর হয়ে জন্মায় না।
তাহলে কি করবেন? খুব সাধারণ ব্যাপার। ছেলে শিশুদের আচরণের প্রতি মনযোগী হোন। তাঁকে ভয়, লোভ, নারীর প্রতি ঘৃণা বা হেয় ধারনা, আত্মসর্বস্ব, কৃপণ, ইত্যাদি পুঁজিবাদী, শ্রেণিবাদী, বর্ণবাদী, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক ও পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ অর্জনের শিক্ষার বদলে, মানবতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, নান্দনিক ও নারীবাদী শিক্ষা দিন। মেয়েদের সম্মান করার শিক্ষা দেয়ার অনেক উপায় ও উপকরণ আপনার হাতের কাছেই আছে। ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়।