খান আসাদ

সমাজকর্মী

“সত্যই মুক্তি দেবে” বৈষম্য ও সহিংসতা থেকে

প্যালেস্টাইন-ইসরাইলের মতো সহিংস, দীর্ঘমেয়াদী এবং ক্ষমতা ভারসাম্যের দিক থেকে সবল ও দুর্বল পক্ষের দ্বন্দ্ব দুনিয়ার অনেক অঞ্চলে রয়েছে। যেমন, উত্তরপুর্ব ভারত (মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম), কাশ্মীর, পার্বত্য চট্টগ্রাম, পূর্ব তিমুর, ইত্যাদি।

এই ধরনের দ্বন্দ্ব ও সহিংসতাকে, এক পক্ষ থেকে বলা হয় “জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম”, “স্বায়ত্ত শাসনের সংগ্রাম”, “এথনিক ক্লিনজিং বা গণহত্যার অপরাধ” ইত্যাদি। আর রাষ্ট্রপক্ষ এটাকে দেখাতে চান “জাতীয় নিরাপত্তা”, “সন্ত্রাসবাদ" ইত্যাদি সমস্যা হিসেবে।

এই ধরনের দ্বন্দ্ব নিরসন ও সহিংসতা বন্ধ করার জন্য অনেক জ্ঞান ইতোমধ্যেই অর্জন করা হয়েছে। “দ্বন্দ্ব ও শান্তি” নিয়ে পাঠ চলছে দুনিয়ার প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে। রয়েছে অসংখ্য গবেষণা, সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতিতে। প্রকাশিত হয়েছে অনেক মৌলিক গ্রন্থ।

এত গবেষণা ও সহিংসতা বন্ধের কৌশল নিয়ে অনেক জ্ঞান থাকার পরেও, এথনিক ক্লিনজিং বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহত আছে। দুঃখের ব্যাপার “মুক্তি সংগ্রামের” নামে নিপীড়িত জাতী সমূহের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য ও আত্মসংঘাতও অনেক বেড়েছে। উত্তরপুর্ব ভারতে এক সময় তিনটি সশস্ত্র দল ছিলো, এখন চল্লিশটিরও বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামে কেবলমাত্র একটি দল ছিলো, এখন চারটি।

তারমানে, “পুরনো চিন্তা সহজে মরে না”। দ্বন্দ্ব ও শান্তি নিয়ে, সমাজবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক জ্ঞান ব্যবহারের উদহারণ খুব কম দেখা যায়। কেনো এই জ্ঞানচর্চা প্যালেস্টাইনে বা পার্বত্য চট্টগ্রামে ফলদায়ী মাত্রায় হয় নি, সেটা বুঝতে হলে, এই অঞ্চলে যে রাজনৈতিক শক্তি ও নেতৃত্ব রয়েছে, তাদের মতাদর্শ, শ্রেণিচরিত্র, বাঁধা ও সুযোগ নিয়ে বিশ্লেষণ দরকার।

দ্বন্দ্ব মীমাংসা ও সহিংসতা বন্ধ করার জন্য, সাম্প্রতিক বিকশিত জ্ঞান, তিনটি উল্লেখযোগ্য ধারনা সামনে আনে।

এক.

দুর্বল পক্ষকে “ভিকটিম" ভাবার যে প্রচলিত ধারনা সেটি প্রথম ভুল। যে সহিংসতার শিকার সে একটি পক্ষ, হতে পারে আপাতত সে দুর্বল, কিন্তু তাঁর বা তাদের একটি এজেন্সি রয়েছে, এবং তাঁদের কাছে আত্মরক্ষা, প্রতিরোধ ও বিজয় অর্জনের অনেক পন্থা বা অপশন রয়েছে। দুর্বল পক্ষকে কেবলমাত্র “ভিকটিম" হিসেবে চিত্রিত করে, করুণা বা আহা উহু করা, চূড়ান্ত ভাবে ক্ষমতাশালীকে আরও সহিংসতায় প্ররোচিত করে।

দুই.

সহিংসতা দেখার পরে উত্তেজিত হয়ে “ভিকটিমের" পক্ষে অবস্থান নেয়া পরবর্তী সহিংসতা বন্ধের কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। মৌলিক যে বিষয়/ইস্যু নিয়ে দ্বন্দ্ব, সেটাকে সামনে আনা জরুরি। বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনাটা জরুরি। এখানেই একটি বড় সমস্যা হয়, “সবজান্তা”দের নিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বন্দ্ব কি? এই “সবজান্তারা” জানে যে, এটা “পাহাড়ি-বাঙ্গালি” দ্বন্দ্ব। এই জানাটা সাম্প্রদায়িক জানা। অধ্যাপক স্বপন আদনানের গবেষণায়, আমরা বুঝতে পারি যে, পার্বত্য অঞ্চলে দন্ধটি “রাষ্ট্রের সাথে আদিবাসী জাতি সমূহের”। সমস্যার শুরু সেই বৃটিশ উপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে, তারপর পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঐ একই নীতি চালিয়ে যাচ্ছে।

একই ভাবে, প্যালেস্টাইন-ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব কি? প্যালেস্টাইনের হামাস, মার্কিন যুদ্ধবাজ বুদ্ধিজীবী ও ইহুদী মৌলবাদ সবাই মিলে আমাদের জানায়, সমস্যা “মুসলমান আর ইহুদীদের ধর্মীয় বিশ্বাস”। আসলে কি তাই? না, এটা “ইজরাইল রাষ্ট্র ও প্যালেস্টাইনী জনগণের দ্বন্দ্ব”, যেখানে অনেক ইহুদী ও খৃস্টান প্যালেস্টাইন জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে।

এখানে মুল কথা, দ্বন্দ্বের আসল চরিত্রটি বোঝা দরকার এবং দ্বন্দ্ব রূপান্তর দরকার। “দ্বন্দ্ব রূপান্তর” ব্যাপারটা কি? Diana Francis এবং Johon Paul Lederach, এই দুইজনের লেখা পড়লে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। মোদ্দাকথা সহিংসতা বদ্ধ করতে হলে, “ভাসুরের নাম মুখে আনা হয় না” যে সমস্যা সেটার সমাধান করতে হবে। অর্থাৎ, যে মুল সমস্যা ধামাচাপা দেয়া থাকে (উত্তেজিত নৈতিক ক্ষ্যাপামির হিজাবে ঢাকা) সেটিকে প্রকাশ্যে আনতে হবে। এটি “ভিকটিমের" ক্ষেত্রেও প্রয়োজন।

তিন.

দুর্বল কিন্তু ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়ছেন, এমন পক্ষ কিভাবে জিতবেন? অন্য কথায়, শান্তি (সহিংসতার অনুপস্থিতি নয়, ন্যায্যতার প্রতিষ্ঠা) আনার ক্ষেত্রে দুর্বল পক্ষের কৌশল কি? হ্যাঁ, জিতবেন, পূর্ব তিমুর জিতেছে, বাংলাদেশ জিতেছে। যদি একটা কাজ হয়। সেটি হছে, এলায়েন্স বা যুক্তফ্রন্ট। স্থানীয়, দেশীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমমনা ও ন্যায়ের পক্ষের ভোটারদের সাথে যোগাযোগ ও ঐক্য। এটা হলে তথাকথিত “বিশ্বজনমত” পক্ষে আসে।

প্যালেস্টাইনিদের একটি বড় সমর্থক গোষ্ঠী ছিলো, জার্মানিতে। তাঁরা ইয়াসির আরাফাতের সাদা কালো গামছা গলায় পরতো, কারণ সেটা সেক্যুলার ছিলো। হামাসের কারণে সেটা নাই হয়ে গেছে। হিটলারও ৩৩% গততন্ত্র (ভোট) পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো। সুতরাং হামাস বা জামাতে ইসলামি ভোট পেলেই তারা গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। বিশ্বজনমত মৌলবাদী সহিংসতার বিপক্ষে, এরা "গণতন্ত্রের" হিজাব পড়লেও।

ফলে, আপনি যদি দুর্বল অবস্থানে থাকেন, আপনার দায় অন্যদের সাথে সহযোগিতার রাজনীতি তৈরি করা। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক, ও বৈশ্বিক সমর্থন আদায়ের “বার্তা" তৈরি করা, এমন বার্তা যা আপনার প্রতিপক্ষ আপনার বিপক্ষে ব্যবহার করতে না পারে।

শেষ কথা, “সত্যই মুক্তি দেবে” বৈষম্য ও সহিংসতা থেকে। আর এই সত্য আসে সমাজবিজ্ঞানের চর্চা থেকে। সকল ধরনের অন্ধত্ব দূর হোক, দুর্বল পক্ষ ও সবল পক্ষ, সবার।

1581 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।