পুঁজির মালিকানা, পরিবার প্রভাব ও প্রশাসনের আঁতাত, এই তিনে মিলে বাংলাদেশে শোষণ, বৈষম্য ও সহিংসতার ব্যবস্থা ক্রমাগত অসহনীয় করে তুলছে। অবকাঠামো "উনয়ন" এর যুক্তিতে সবকিছুর বৈধতা দেয়া হচ্ছে।
লুটেরা পুঁজির মালিক যারা, এদের আত্মীয়তা রয়েছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। স্থানীয় রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতিয়পার্টি, জামাত যাদের অনেকে এখন আওয়ামীলীগ) নেতাদের ক্ষমতা পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত এবং স্থানীয় বখাটেদের নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। স্থানীয় বিত্তশালী রাজনৈতিক পরিবার যুক্ত স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতার সাথে। এরা আনুকূল্য পাচ্ছে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, লুটেরা মাফিয়া সিণ্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজ আমলাদের থেকে।
লুটেরা পুঁজির আর্থিক ক্ষমতা, একই সাথে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ক্ষমতা, এর সাথে সরকারি দলের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং পারিবারিক অবস্থানের সামাজিক ক্ষমতা- সব ধরনের ক্ষমতার কারণে আজ এরা অপ্রতিরোধ্য। এই ক্ষমতার মালিকেরা সব মিলিয়ে ৬৪ জেলা ও ঢাকায় থাকা ৩০০ পরিবার হয়তো হবে। এরাই বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রক, মুল শক্তি। এরাই বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদের স্থানীয় এজেন্ট।
লুটেরা পুঁজির পরিবার তন্ত্র ও দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্রের ব্যবস্থা চালু থাকার পেছনে, এই ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়ার পেছনে আছে "শিক্ষিত" মধ্যবিত্ত যারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও ইসলামী আইনের ককটেলে বিশ্বাস করে। আছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা লোকজন যারা ব্যবস্থাকে বদলাতে চায় না, নিজের পক্ষে নিতে চায় মাত্র, দুর্নীতির ভাগ নিয়ে "বড়লোক" হওয়ার আশায়। এরা মনে করে সমাজতন্ত্র হলে, দুর্নীতি করে "বড়লোক" হওয়া আটকে যেতে পারে। পাশের বাড়ির ভূমিহীন রহিমুদ্দির ছেলেও তখন সমান মর্যাদার হবে। ফলে, পুঁজিবাদের পক্ষেই এখনকার মধ্যবিত্ত। এরা মন পরিবর্তন করবে, যদি বোঝে যে সমাজতন্ত্র এদের ভালো জীবনের নিশ্চয়তা দেবে।
রাজনীতিতে সরকার বিরোধিতা বা আওয়ামীলীগ বিরোধিতা এমন একটি উপাদান যা বামপন্থী কর্মীদেরও বিএনপি-জামাতের দলে ভিড়িয়ে দেয়। সেখান থেকে কিছু আবার বামাতি হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় কিছু আবার আওয়ামীলীগ সমর্থক হয়ে যায়। বৈষম্য ও সহিংসতার বিরোধিতা কারো কাছে ছাত্রলীগের হাতুড়ি বাহিনীর বিরোধিতায় শেষ হয়। আওয়ামীলীগ সমালোচনা করে করে দম ফুরিয়ে যায়, ফলে সমাজ বদলের রাজনীতির বিষয়ে আর কোনো কণ্ঠ শোনা যায় না।
তিনটে বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরী মনে হয়।
(১) মানবিক উন্নয়ন চাই। প্রচলিত অবকাঠামো তৈরির নয়া উদারবাদী মেগাপ্রকল্পের "উন্নয়ন" নীতি বাদ দিয়ে, মানবিক উন্নয়নের নীতি চাই। চাই প্রতিটি মানুষের আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার সুযোগ। চাই এমন উন্নয়ননীতি যা প্রতিটি মানুষকে মর্যাদা, সম্মান, স্বাস্থ্য, সুখ ও শান্তি দেবে। উন্নয়নের লক্ষ্য হবে মানুষ। মানুষের সুখে থাকা, আনন্দে থাকা।
(২) স্থানীয় স্বশাসন চাই। স্থানীয় প্রত্যক্ষ্য জনগনতন্ত্র চাই। উন্নয়নের পরিকল্পনা হবে স্থানীয় ভিত্তিতে, জনগণের অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভূমিকা পালন করবে, বাজেট তৈরি ও উনয়ন সমন্বয়ের জন্য, খণ্ডকালীন সময়ের জন্য নিয়োজিত দক্ষ বিশেষজ্ঞরা। আমাদের কোনো আমলাতন্ত্রের দরকার নেই। সামরিক বাহিনী থাকবে নিরাপত্তা সার্ভিস দেয়ার কনসাল্টিং ফার্ম হিসেবে।
(৩) সংস্কৃতির সুরক্ষা ও বিকাশ চাই। সংস্কৃতির মানবিক ঐতিহ্যকে ও ধরন সমূহকে সুরক্ষা দিতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে যে ধরণ বা সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল সেগুলোর চর্চা ও সুরক্ষা দিতে হবে। পুঁজিবাদী, পশ্চিমা বা মরুসংস্কৃতির আগ্রাসন রুখতে হবে, কিন্তু অন্য সংস্কৃতর সাথে লেনদেন করার চর্চাকে সমর্থন দিতে হবে।
আমাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কী? কেমন বাংলাদেশ আমরা চাই? সেই বাংলাদেশ এর পক্ষে বিপক্ষে কারা? অপশন তিন ধরণের। এক, লুটেরা পুঁজির পরিবার তন্ত্র ও দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রেই বসবাস শুধু প্রতিবাদ ও সমালোচনা এই আশায় যে "সুশাসন" হবে, লুটেরারা সুইসব্যাংকে অনেক টাকা জমালে, আর দুর্নীতি হবে না। দুই, ইসলাম দেবে সমাধান। শরিয়া আইন হবে। সব দুর্নীতি ও অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে। তিন, বিকল্প অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন, সামাজিক অংশগ্রহণমূলক গনতত্রায়ন ও মানবিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির রূপরেখা নিয়ে প্রচলিত সমাজের খোলনলচে পাল্টে দেয়া।
সমাজবদলের কাজের জন্য, সমালোচনা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন বিকল্প উপস্থাপন। প্রয়োজন ঐক্য, আগামির বাংলাদেশের স্বপ্নের ঐক্য।