খান আসাদ

সমাজকর্মী

মসজিদে ও ওয়াজে ধর্মসহিংসতার বয়ান বন্ধ করার আওয়াজ তুলুন

কয়েকদিন ধরে একটি "ইসলামী" বয়ান ফেসবুকে ঘুরতে দেখছি। এই বয়ান থেকে আমরা পাবলিকেরা কি জ্ঞান পেতে চাই? "ইসলামিক দেশগুলি কতোখানি ইসলামিক এই নিয়ে গবেষণা করেন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হুসেন আসকারী। ইসলাম ধর্মে রাষ্ট্র ও সমাজ চলার যে বিধান দেয়া হয়েছে তা যে দেশগুলি প্রতিদিনের জীবনে মেনে চলে তা খুঁজতে যেয়ে দেখা গেলো, যারা সত্যিকার ভাবে ইসলামিক বিধানে চলে তারা কেউ বিশ্বাসী মুসলিম দেশ নয়।" এর পর ব্লা ব্লা অনেক কিছু।

এখন শ্রীলংকান মুমিন ইলহাম ইব্রাহীম ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগমের কাহিনী থেকে আমরা কি জ্ঞান পাই, একটু মিলিয়ে দেখি।

ইলহাম ইব্রাহীম সম্প্রতি শ্রীলংকায় সিরিজ হামলার সংগঠক, একজন ইসলাম বিশ্বাসী মৌলবাদী জ্বিহাদী মুসলমান। ইব্রাহীমের আত্মঘাতী হামলার পর, পুলিশ তার বাসায় যায়। ইব্রাহীমের স্ত্রী ফাতেমা বেগম, সেও বাসায় আত্মঘাতী ভেস্ট পরে অপেক্ষায় ছিলো, পরকালে তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামীর সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়, যেখানে তাঁর স্বামী ৭২ জন হুরের সাথে ছহবত করবেন, এবং ফাতিমা নিজে বেহেস্তের শীতল বাতাসে পায়চারি করবেন।

এই মুমিনা অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। সে তার গর্ভের সন্তান, চার বছরের ছেলে, ছয় বছরের আরেক ছেলে এবং আট বছরের মেয়েসহ এক পুলিশ অফিসার ও দুই কনস্টেবলকে নিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।

এই ইব্রাহীম ও ফাতেমার কোন দেশ নেই? কোন ধর্ম নেই? কোন রাজনীতি নেই? জ্ঞানবুদ্ধি নেই "ইসলামের জীবনবিধান" কি তা বোঝার?

ইব্রাহীম ও ফাতেমার দেশ আছে, সেটি শ্রীলংকা। ধর্ম আছে, সেটি ইসলাম, এবং "ইসলামের জীবনবিধান" সম্পর্কে অনেক অনেক অনেক গভীর জ্ঞান আছে। এই গভীর জ্ঞান এতোটাই যে এরা নিজেদের সন্তানদেরও এই দুইদিনের দুনিয়ায় থাকতে দিতে চায় না। যেখানে আল্লাহর সান্নিধ্যে, অনন্ত জীবন পাবে, সেই বেহেস্তে যেতে চেয়েছে। এদের "পরকালে বিশ্বাস" কি অনেক দৃঢ় নয়, সেইসব আগ্রাসীদের থেকে যারা "পরকালে বিশ্বাস নাই" বলায় বাংলাদেশে প্রকাশ্যে একটি মেয়েকে ফেসবুকে হেনস্থা করে? এবং বাংলাদেশের এন্টিটেরর ইউনিট তা চেয়ে চেয়ে দেখে, কারণ এই রাজাকারের বাচ্চারা তো হাতে একে ফোর্টিসেভেন নেয়নি, শুধু ফেসবুকে "ধর্ষণের" হুমকি দিয়েছে মাত্র।

শুরু করেছিলাম, "সত্যিকার ভাবে ইসলামিক বিধানে চলে তারা কেউ বিশ্বাসী মুসলিম দেশ নয়" - এই বয়ান প্রচারের বিষয় নিয়ে। এই বয়ান মর্মার্থে প্রমাণ করতে চায়, "ছহি ইসলাম সভ্য, ভদ্র, কল্যাণ রাষ্ট্র এবং মানুষেরা শিক্ষিত ও শান্তিকামী"।

আপনার কি মনে হয়, ইব্রাহীমদের বা ফাতেমাদের, "ইসলামিক জীবনবিধান" সম্পর্কে "সত্যিকার" জ্ঞান নেই? আচ্ছা, আপনার ইসলাম সম্পর্কে যে বয়ান, সেটি যে "সত্যিকার" ইসলাম, এটা কি ইন্ডিকেটর দিয়ে বোঝা যাবে? কোরআন হাদিসের সেই সব অংশের বর্ননা দিয়ে, যা শান্তির কথা বলে? হ্যাঁ, কোরআন ও হাদিসে এরকম অনেক সূরা আছে যা শান্তির কথা বলে।

কিন্তু কোরআন হাদিস তো সহিংসতার কথাও বলে। কোরআনে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার আয়াতের মধ্যে কমপক্ষে ৪০টি আয়াত সহিংসতার। ইব্রাহীম ও ফাতেমারা যে কাজটি করে, কেবল চেরিপিকিং স্টাইলে এই ৪০ আয়াত থেকে জীবনবিধান খুঁজে, আপনিও তেমনই চেরিপিকিং স্টাইলে শান্তির আয়াত খুঁজে সেটার কথা বলছেন।

এখন কথা হোল, জামাতি-হেফাজতি-চরমোনাই কেনো নাস্তিক-মুরতাদ হত্যায় ও জ্বিহাদ নিয়ে ব্যস্ত এবং আপনি কেনো সহিহ "সত্যিকার" শান্তির ইসলাম নিয়ে ব্যস্ত? কারণ রাজনীতি, ক্ষমতা, মতাদর্শ, স্বার্থ, প্রয়োজন ইত্যাদি। মানুষের চেতনা তাঁর সামাজিক সত্বা দ্বারা নির্ধারিত। আপনি শান্তিবাদী আর ওরা সন্ত্রাসী। এই ব্যাপারটা কেনো তা ব্যাখ্যা করতে এবং বুঝতে হলে, কিছুটা সমাজ বিজ্ঞানের জ্ঞান, কিছুটা অর্থনীতির জ্ঞান, কিছুটা ধর্মতত্ত্ব, কিছুটা নারীবাদ, কিছুটা মনোবিজ্ঞান এবং কিছুটা রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। (সেই বিস্তারিত ব্যাখ্যায় এখন না যাই।) তবে, সহজ করে বললে, ধর্মকে আপনি কিভাবে পারসিভ বা ধারণা লাভ করছেন সেই পূর্বধারনার উপর আপনার ধর্ম নির্ভরশীল।

ধর্ম যখন ব্যক্তিগত ও আধ্যাত্মিক ব্যাপার, কেবলমাত্র ব্যক্তির আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান ও চর্চার ব্যপার, শুধু অসীম কোনো সত্তা কিংবা পরমাত্মা জাতীয় কোনো বিশ্বাসবোধ থেকে তা উপলব্দির চেষ্টার ব্যাপার -তখন কোনো সমস্যা নেই। আপনি শান্তির পথে চিন্তা করতে পারবেন।

কিন্তু সহিংসতার সমস্যা তখনই, যখন ধর্ম আপনার সাম্প্রদায়িক আত্মপরিচয়। ধর্ম আপনার পেশা। ধর্ম আপনার রাজনীতি (আইন কানুন)। ধর্ম আপনার আধিপত্য ও ক্ষমতা চর্চার হাতিয়ার। যেমন ধর্ম দিয়ে আয় ও ভোটের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ভালোবাসার জন্য যে সমর্পণ (লাভ মেকিং) সেই সমর্পণ যদি টাকা দিয়ে করা হয়, তাহলে সেটা পতিতা বৃত্তি বা বেশ্যাবৃত্তি। ধর্ম যদি এই রকম ভোগের, ক্ষমতার ও বৈষয়িক লেনদেনের অবস্থায় যায়, সমস্যা তখনই।

পরিশেষে, কমনসেন্স কাজে লাগান। অন্ধবিশ্বাস নয় আবার অর্ধসত্য চালাকি নয়, ধর্মগ্রন্থের অর্ধেক বলবেন আর অর্ধেক চেপে যাবেন, শান্তির কথা বলবেন আবার সহিংসতা ও নারী-পুরুষ বৈষম্যের কথা চেপে যাবেন -এটা আত্মপ্রবঞ্চনা। যে দেশগুলো তথাকথিত "সত্যিকার ইসলাম" মেনে চলে যেমন নিউজিল্যান্ড এর নাম বলা হয়েছে, এরা সেক্যুলার, এরা ঐশী বাণী দিয়ে রাষ্ট্র চালায় না। এরা ইহহাজতিক মানুষের তৈরি থিউরি দিয়ে রাষ্ট্র চালায়। বিজ্ঞান ও যুক্তি ব্যবহার করে, ধর্মান্ধতা আর অন্ধবিশ্বাস না।

বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা ও ধর্মসহিংসতার একটি সামাজিক ঐতিহাসিক কারণ আছে। এরা পাকিস্তানের ভাবধারার, রাজাকারের রাজনীতি নিয়ে, একটি ধর্মজীবী শ্রেণীর লোক, যারা প্যারাসাইটিক মানে পরজীবী, জোঁকের মত অন্য প্রাণীর রক্ত খেয়ে বাঁচে। এই মৌলবাদী ধর্মসন্ত্রাসীরা আবার সাম্রাজ্যবাদের এদেশীয় এজেন্ট, যারা প্রচলিত শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বজায় রাখতে চায়। এরা সহিংস পিতৃতন্ত্রের রক্ষক সমতার নারীনীতির বিরোধী। বাংলাদেশে এদের পেট্রনাইজ বা রক্ষা করে, উৎসাহ দেয় ও পৃষ্টপোষকতা করে চলেছে রাষ্ট্র এবং অনেক অনেক রাজনীতিবিদেরা।

ধর্ম রাখুন ধর্মের কাছে। ব্যাক্তিগত ও আধ্যাত্মিক প্রশ্ন ও উপলব্দির বিষয় হিসেবে ধর্ম গোপন থাকুক আপনার কলিজায়। অনেক গুরুত্বপুর্ন অঙ্গ আছে খুব দরকারি, কিন্তু সেটা পাবলিকেরে দেখিয়ে বেড়ানোটা লজ্জার। সেরকম ধর্ম থাকুক আপনার অন্তরে। সেটা যত্নে রাখতে হলে ধর্মের অসৎ ও রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করার আওয়াজ তুলুন। বাংলাদেশে মসজিদে ও ওয়াজে ধর্মসহিংসতার বয়ান বন্ধ করার আওয়াজ তুলুন। জ্বিহাদী মুসলমান বানানো বন্ধ করার আওয়াজ তুলুন।

মৌলবাদী ইসলামী বয়ান ও রাজনীতি চলতে দিলে আপনিও ভবিষ্যৎ ইব্রাহীম ও ফাতেমাদের তৈরির জন্য দায়ী হবেন।

1750 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।