খান আসাদ

সমাজকর্মী

যুদ্ধ ও দাঙ্গার সাম্প্রদায়িক বয়ানের বিকল্প সমাজবৈজ্ঞানিক বয়ান আসুক

যুদ্ধের, দাঙ্গার, দলবদ্ধ সংঘাতের ও নারীর উপর পুরুষের সহিংসতার ইতিহাসকে বুঝার জন্য, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বয়ান বা ন্যারেটিভ খুব বিভ্রান্তিকর। আরও খারাপ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক "বয়ান" পাঠ নিজের অজান্তেই পাঠককে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্বের অন্ধকার নর্দমায় টেনে নামায়। বর্ণবাদী সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এড়াতে হলে সমাজবিবর্তনের মৌলিক ধারনা ও সমাজবিজ্ঞানের ভাষারীতি (সেক্যুলার ডিসকোর্স) অনুসরণে দৃঢ় অবস্থান দরকার।

জ্বিহাদ বা ক্রুসেড আসলে কী? বৈদিক যুগ বা উপনিষেদের কাল নামে কোন সময় বা কোন শ্রেণীর মানুষের কথা বলা হচ্ছে? "সভ্যতা" বা "আধুনিকতা" মানে কী? এই সব প্রশ্নের উত্তর ধর্মান্ধতা, বর্ণবাদী (সাদারা সভ্য, বাদামী/কালোরা এখনো সভ্য নয়, আধুনিক নয়) ধারণা, এবং সাম্প্রদায়িক বয়ান দিয়ে বুঝা যাবে না।

সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ বা বিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে মোটাদাগে পাঁচ ধরনের। (১) আদি সাম্যবাদী সমাজ, (২) দাস সমাজ (শ্রেণি ও পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব), (৩) সামন্ত সমাজ, (৪) পুঁজিবাদী সমাজ ও (৫) রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ।

আদি সাম্যবাদী সমাজে ছিলো প্রধানতঃ দুই ধরনের জনগোষ্ঠী, এক, শিকারি বা পশুপালক যাযাবর আদিবাসী, এবং দুই, কৃষিজীবী পশুপালক আদিবাসী। একদল শিকার করতে অভ্যস্ত ও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে বসতি করতো। আরেক দল বন পরিষ্কার করে কৃষিকাজ ও পশুপালন করতো।

"ধর্ম" অর্থাৎ মানুষের থেকে ক্ষমতাবান "অলৌকিক" শক্তিতে বিশ্বাস ও এই শক্তিকে তুষ্ট করার আচার ছিলো প্রধানত "প্রকৃতি পূজা"। যাযাবরেরা রাতে পথ চেনার জন্য আকাশের দিকে তাকাতো, ফলে তাঁদের বিশ্বাসে আকাশের শক্তির প্রধান্য। বিপরীতে কৃষিজীবী সমাজে গাছ, পাথর, নদী - সব কিছুই পূজনীয়, কারণ তাঁরা তাকায় মাটির দিকে। প্রকৃতি পূজা থেকে দেব দেবীতে বিশ্বাসের কারণ দাস সমাজের বিবর্তন। আর একেশ্বরবাদ এসেছে সামন্ত বাদের বিবর্তনের পর্যায়ে। ফলে কোনো ধর্ম দিয়ে নয়, যুদ্ধ ও দাঙ্গাও বুঝতে হবে সমাজ বিবর্তনের প্রেক্ষিতে।

দলগত আক্রমণ, সম্পদ দখল, দাস বানানো, নারীদের দখল - এই সবকিছুর সাথে কখনোই কোনো ধর্মের সম্পর্ক ছিলো না। ছিলো সম্পদের দখলের সাথে সম্পর্ক। তাহলে ধর্ম বিশ্বাসের ব্যবহার কেনো দেখি? কারণ ধর্মীয় আত্মপরিচয় দিয়ে লোক জড়ো করা যায়। অলৌকিক আশা দিয়ে আক্রমণকারীর মনোবল চাংগা করা যায়। আক্রমণের নৈতিক বৈধতা তৈরি করা যায় (আমাদের পণ্ডিত মেরেছে এখন আমরা ওদের মোল্লা মারবো)। ক্রুসেড বা জ্বিহাদ, মূলত সাম্প্রদায়িক প্রচ্ছদ অন্য সম্প্রদায়ের সম্পদ লুটপাট করার জন্য।

এই সম্পদ লুটপাট মানে যে বৈষয়িক সম্পদ তাই নয়, নারীও সম্পদ (যারা মানুষ উৎপাদন করে), এবং সংস্কৃতিও সম্পদ, যেমন ধর্মীয় কোনো রিচুয়াল। উদহারন, ক্রিসমাস ট্রি। এই "ক্রিসমাস ট্রি" আসলে ইউরোপীয় আদিবাসীদের গাছ পূজা, যে গাছ শীতের দিনেও সবুজ থাকে, প্রাণের প্রতীক হিসেবে। খৃস্ট ধর্মের শাসকেরা এটি আত্মীকরণ করে নেয়। যেমন "হজরে আসওয়াদ" ইসলাম পুর্ব আদিবাসীদের পাথরকে আরবী শাসকেরা (মুসলমানেরা) আত্মীকরণ করে নেয়া। হিন্দু ধর্মের শিবলিঙ্গ থেকে শুরু করে, অনেক পূজা যা আদিবাসীদের রিচুয়াল আত্মীকরণ করে নেয়া হয় শাসকদের দ্বারা।

দাস সমাজে, সামন্ত সমাজে ও পুঁজিবাদের যুদ্ধ, দাঙ্গা, দলগত সহিংসতার বৈধতা দেয়ার জন্য ধর্ম, বর্ন, রাষ্ট্রীয় জাতীয়তা, ব্যবহার করা হয় লুটপাট ও সম্পদের দখল বজায় রাখার জন্য। ভারতে "ইসলামী" শাসন বলে কিছু নেই, ভারতীয় উপমহাদেশে ওটা ছিলো সামন্ত সমাজে সামন্ত শ্রেণীর শাসন। ভারতীয় সমাজে দাস সমাজ তৈরি হয়েছে বর্নভেদ প্রথার মুখোশে। ওটা "হিন্দু" বা "বৈদিক" কিছু নয়, ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ দাস ব্যবস্থার ইতিহাস। তথাকথিত মোগল আমল "মুসলমান" শাসন নয়, ওটা সামন্ত শাসন। নানা ধর্মের মানুষ ছিল সামন্ত শাসনের কালে। ইতিহাস ঘাঁটলেই সেটা যে কেউ বুঝবেন। সাম্প্রদায়িক ইতিহাস রচয়িতারা এগুলিকে "ধর্মের" লেবাস পরিয়েছে মাত্র।

বৃটিশ উপনিবেশও বৃটেনের জনগণ করেনি। করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মানে, ভারতীয় সামন্ত সমাজে বৃটিশ পুঁজিবাদের আগ্রাসন হয়েছে, কারণ ইউরোপে আগে পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছে। এর সাথে খৃষ্টান ধর্মের কোনো বৈষয়িক স্বার্থ বা সম্পর্ক নেই। বরঞ্চ, ভারতীয় হিন্দু মুসলিম শিখ নানা ধর্মের অনুসারী জমিদার শ্রেণীর স্বার্থের যোগ ছিল বৃটিশ শাসনের সাথে।

কেনো একদল জিতে যায়, আর একদল হেরে যায়? খুব সিম্পল। প্রযুক্তি ও রণকৌশল এর পার্থক্যের কারণে। শিকারিরা শিকারের প্রযুক্তি ও যুদ্ধের কৌশলে দক্ষ। টোলে বা মাদ্রাসায় পড়ে কি বৃটিশের প্রযুক্তি ও রণকৌশলের মোকাবেলা করা যায়? সেই দল জিতবে, যাদের প্রযুক্তি ও রণকৌশল কার্যকর। এখানে ঈশ্বরপুত্র, ঈশ্বরবন্ধু বা শিববাবুর বন্দনা কাজে লাগে না। সামন্তবাদ দিয়ে পুঁজিবাদ ঠেকানো যায় না।

মুল কথায় ফিরে আসি। কেনো কারা কী উদ্দেশ্যে যুদ্ধ, দাঙ্গা, দলগত সহিংসতা করে, সেটা তাঁদের ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বয়ান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যথেষ্ট নয়। বর্নবাদী ও সাম্প্রদায়িক যুদ্ধবাজদের বৈষয়িক ও ক্ষমতার স্বার্থ কী কী, সেটা ব্যাখ্যা করাই যে কোনো সৎ বুদ্ধিজীবীর কাজ। যদি আমরা সহিংসতা বন্ধ করতে চাই; সমাজে ন্যায্য সাম্যের ও শান্তির মানবিক সম্পর্ক নির্মাণ করতে চাই।

1583 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।