দিনা ফেরদৌস

আমেরিকা প্রবাসী। লেখালেখির পাশাপাশি ছবি আঁকেন জল রঙে।

কাল আপনিও ভিকটিম হতে পারেন

বিজ্ঞাপন দেখলাম, একটি মেয়ে পূজাতে যাবে স্লিভলেস ব্লাইজ পরে, তবে সমাজের কথা মনে হতেই লম্বা হাতের ব্লাউজ পরে যাবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কথায় আছে, "দেখতে নারী তার চলন বাঁকা"। কেউ যদি দোষ বের করতে চায়, তো প্যাকেট হয়ে গেলেও পোশাকে সমস্যা পেয়ে যাবে।
 
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীদের জামাকাপড় নিয়ে নারীরাও মন্তব্য করেন। বিশেষ করে যাদের পরে দেখাবার মতো ফিগার নেই, বা পরতে চান কিন্তু পরিবারের চাপে পরতে পারেন না, নিজেকে অবদমনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় অথবা যারা মনে করেন স্লিভলেস পরার মতো বয়স শেষ হয়ে গেছে। অনেকে বলবেন, নিজের ইচ্ছেতেই পরি, যা পরতে ভালো লাগে, কেউ আমাকে এ নিয়ে কিছু বলে না; আমি তাদের কথা এক ফোঁটাও বিশ্বাস করি না। সারা পরিবারের সিস্টেম যদি হয়ে থাকে আলখাল্লা পরার, বন্ধুরা সকলে যদি হয়ে থাকে আলখাল্লা পরিহিতা, তবে সেখানে নিজের আলাদা পছন্দ থাকলেও কিছু করার নেই, কমিউনিটি এমন এক শক্তি, যা অদৃশ্যভাবে চালায়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। ইচ্ছা- অনিচ্ছার তো প্রশ্নই আসে না।  ভেতরের যন্ত্রণা থেকে এরা একটু বেশিই লেকচার দেয়।বেশিরভাগ মানুষই যে যা করতে পারে না, বা করার যোগ্যতা নেই, তার জন্যে যুক্তি দাঁড় করাতে ওস্তাদ। নারী-পুরুষের সম্মিলিত মন্তব্যের কারণে, রেইপের জন্য দেখা যায় ঘুরেফিরে ওই পোশাক'কেই দায়ী করা হয়। পুরুষদের মন্তব্য নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই, তারা চায় তাদের সুবিধা মতো নারী চলুক। এই সমাজে বোরকা পরা নারীও থাকুক, বেশ্যাও থাকুক। যখন যার দরকার হবে, তার দুয়ারে গিয়ে নক করবে। সম্মানিত বোনেরা, মনে রাখবেন আপনার জন্যে সেই গদাইয়ের বাপই থাকবে, মারুক কাটুক তার সংসার করার জন্যে বাহবা পাবেন, আর ছেড়ে গেলে হবেন দুশ্চরিত্রা ।
 
এই যে আপনারা সকলে নারীর পোশাকের শালীনতা নিয়ে এতো চিল্লান, কিন্তু কেনো? তনু, মিনু, নুসরাতরা তো শালীন পোশাকই পরতো। আর তিনমাস, ছয়মাস, দশ বছরের বাচ্চার পোশাকে বা বৃদ্ধা নারীর শরীরে এমন কি আছে, যা দেখলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়? তারচেয়ে বড় কথা আপনার যা ভালো লাগে আপনি তাই পরেন, অন্যে তার ভালোলাগা থেকেই তো পরে, তার সেই ভালোলাগায় আপনার সমস্যা কি? এটা বুঝলাম, ভদ্র, শালীন পোশাক পরলে দশে ভালো বলবে, বিয়ের জন্যে ভালো পাত্র পাবেন, নিজের সৌন্দর্য স্বামীকে বিলিয়ে দিবেন, সুখে সংসার করবেন স্রষ্টার অশেষ কৃপায়। বাইরে যাবেন বরকে নিয়ে ফুচকা খাবেন। আপনার মতো শালীন, সুন্দরী, গুণবতী নারী সকলের পছন্দ, তাই রাস্তা থেকে স্বামীর সামনে আপনাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে শকুনের দল। আপনাকে তারা ধর্ষণ করবে। এরপর আপনি হবেন, ধর্ষিতা। সকলে বলবে আপনার ইজ্জত চলে গেছে। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবেন না। ওই যে শালীনতা শালীনতা বলে সমাজের জন্যে ভালো সাজতেন, সেই সমাজে আপনার পরিচয় ধর্ষিতা। এরপর দেখেন আপনার বর, তার পরিবার আপনার এতো জীবনের শালীনতার কি মূল্য দেয়। এখন আবার বলবেন না, মরার পর মূল্য পাবো। যারা ধর্ষিতা হয় নি তারা মরার পর মূল্য পাবে না, তাতো নয়। কু-যুক্তি বাদ দেন। সমাজের শিখানো বুলি আওড়ে নিজেকে মনে মনে যতোই শালীন আর ভদ্র ভাবেন না কেনো, ধর্ষকের কাছে আপনি একটা মাংসপিণ্ড ছাড়া কিছুই না, তা আলখাল্লা পরেই থাকুন আর স্লিভলেসই পরেই থাকুন। এর কাছ থেকে এই বললে সম্মান পাওয়া যায়, তার কাছ থেকে ওই বললে সম্মান পাওয়া যায়, সবাই এই ওই, বললে বাহবা দেয়, লাইক কমেন্ট ঝুড়িতে পড়ে। কিন্তু আপনি নিজে নিজেকে সম্মান করতে শিখেননি, নিজের ইচ্ছেকে সম্মান করতে শিখেননি, নিজের ভালোলাগাকে সম্মান করতে শিখেননি। সম্মান রেখে দিয়েছিলেন সমাজের কাছে, পুরুষদের কাছে। তারা চাইলে দিবে আর ইচ্ছে হলে নিয়ে যাবে। তো কার জন্যে করলেন এতো উৎসর্গ? এখন ধর্মের দোহাই দেবেন না। ধর্মে শুধু নারীদের শালীনতার কথা বলা হয় নি, পুরুষদের শালীনতার কথাও বলা হয়েছে, তাদের চোখকে হেফাজতে রাখতে বলা হয়েছে। জীবনে যতোবার নারীর শালীন পোশাক নিয়ে মন্তব্য করেছেন, পুরুষদের পোশাক নিয়ে বলেছেন কিছু? পাছার নিচে প্যান্ট পরা, ছেড়া প্যান্ট পরা বা খালি গায়ে রাস্তায় যখন তখন বের হওয়া নিয়ে কতোবার ভেবেছেন? না ভাবেন নি। কারণ আপনি জানেন, পুরুষরা ওরকম পরেই। নারীর স্লিভলেস জামা দেখলেই আপনার শুধু অশালীন লাগে।
 
প্রশ্ন করুন, নিজেকে ধোকা দিচ্ছেন নাতো? নিজের ইজ্জত নিজের কাছে রাখুন, শুধু পোশাক দিয়ে নয়, মুক্ত চিন্তার মাধ্যমে, অন্যকে নিয়ে মন্তব্য করার আগে। নিজেকে প্রশ্ন করুন, অন্যে তার রুচিতে, তার ভালোলাগা থেকে পোশাক পরলে আপনার সমস্যাটা কোথায়? এটার আপনার অবদমনের ফল নয়তো? তা না হলে আপনি নিজের পোশাক আপনার পছন্দে পরতে পারলে, সে নয় কেনো? একটু ভাবুন। কাল আপনিও ভিকটিম হতে পারেন।

1481 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।