যে সময়ে এসে আমাদের বৈষম্যমূলক ভাষার রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার কথা সেই সময়ে আমরা খুব নিত্য নতুন লিঙ্গ নির্দেশক শব্দ তৈরি করেই চলছি। তার উৎকৃষ্ট একটি উদাহরণ হলো খেলোয়াড়দেরকে নারী বা পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা। নারী পুরুষ নির্বিশেষে খেলাধূলা পুরোপুরিই একটি শারীরিক ক্রিয়া হলেও নারীদের আলাদা করে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যেহেতু এটি একটি শক্তিমত্তার সাথে সম্পর্কিত বিষয় ফলে নারীকে পুরুষের চেয়ে দূর্বল হিসেবে ভাবার যে মানসিকতা কাজ করে সেখান থেকেই এভাবে তাদের চিহ্নিত করা হয়। আমাদের পূর্ব থেকে কাঠামোবদ্ধ মানসিক চিন্তায় যেহেতু কাজ করে যে নারীরা অধঃস্তিত বা নারীরা পুরুষের মতো ভারী কাজ করতে পারবে না সেজন্য ক্রিকেট বা ফুটবল একটি পরিশ্রমের খেলা হবার কারণে তাদের আগে 'প্রমিলা' শব্দ জুড়ে দেই। এতে করে দর্শকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এমন একটি ধারণা দিয়ে দেয়া হয় যে, খেলাটিতে পুরুষ প্রাধান্যের একটি ব্যাপার রয়েছে। নতুন করে এসব খেলাধূলায় নারীকে এভাবে সিগনিয়াফিং করার আগেও এই সমাজে নারীদের জন্য যেসব খেলাধূলার প্রচলন ছিলো সেগুলোও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমাদের স্কুল কলেজে ছেলেরা যেখানে হাইজাম্ফ, লংদৌড় প্রতিযোগিতা হতো সেখানে মেয়েদের জন্য চালু ছিলো-বালিশ খেলা, চেয়ার দখল কিংবা কানামাছি। এই জাতীয় খেলাগুলো আক্ষরিক অর্থেই নারীর দূর্বলতাকে প্রতিফলিত করে। এসব খেলা থেকেই রক্ষণশীল পরিবেশে নারীদের বেড়ে উঠার পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব উঠে আসে। খেলাধুলার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি যে একটি পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা তার ফারাকটা ধরা পড়বে যদি আমরা উদাহরণটা এভাবেই দেই যে- দূর্বলতার কারণে মেয়েদের ফুটবল দলকে প্রমিলা বলা হচ্ছে এই দূর্বলতা পুরুষদলেরও হতে পারে। উন্নত দেশের এগিয়ে থাকা কোনো নারী ফুটবল দলের সাথে যদি আমাদের পুরুষদের খেলতে দেয়া হয় তাহলে এরাও তাদের কাছে দূর্বল হিসেবে হারতে পারে অনায়াসেই। ফলে যে শক্তিমত্তা দিয়ে নারীকে মাপা হচ্ছে এটি পুরুষের ক্ষেত্রেও হতে পারে। সেজন্য শক্তিমত্তার বিষয়টি খুবই আপেক্ষিক হলেও একক ভাবে সেটি নারীর উপরে দূর্বলতা হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
পূর্বপুরুষ হলেও পূর্বনারী নেই!
ঐতিহাসিকভাবে পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে প্রজাতি রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন নারীরা। অথচ সমাজে প্রতিষ্টিত ধারণা হলো আমরা পূর্ব পুরুষের বংশধর। এই যে 'পূর্ব পুরুষ' বলা হচ্ছে এটিও নারীর উপরে ভাষার রাজনীতি যা প্রতিষ্টিত হয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নারীকে অপসারণের মাধ্যমে। সমাজে যখন থেকে উৎপাদনের মালিকানা পুরুষের হাতে নিহিত হয়েছে এবং তাকে বংশের পরিচয় নির্ধারণের জন্য গৃহবন্দি করা হয়েছে তখন থেকে এই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। তখন থেকেই সমাজে 'ভার্যা'; শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে 'পুত্রার্ত্রে ক্রিয়তে ভার্যা'। অর্থ্যাৎ পুত্রের জন্য স্ত্রীকে গ্রহণ করার কথা বলে হচ্ছে সেদিক থেকে স্ত্রী হলেন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র।
ভাষার বিভেদ রেখা ও জেন্ডার স্টেরিওটাইপিং!
সমাজে ভাষার বিভেদের ফলে জেন্ডার স্টেরিওটাইপিং-এর জন্ম হয়েছে। আমরা যখন 'স্যার' এবং 'ম্যাডাম' এই শব্দ দুটি উচ্চারণ করি তখন স্বাভাবিকভাবেই নারী ও পুরুষকে আলাদা করি। ভাষা আমাদেরকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে ব্যাক্তিটা কে; নারী নাকি পুরুষ। এই স্টেরিওটাইপিং এর বিষয়টি আমাদের প্রতিটি নারী ও পুরুষবাচকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি শিশুর জন্মের পর থেকে আমরা প্রতিটি শব্দ ব্যবহারে বুঝিয়ে দেই কে ছেলে হয়ে বড় হচ্ছে আর কে মেয়ে হয়ে বড় হচ্ছে। এমনকি নামের সাথে মি. এবং মিসেস. শব্দ ব্যবহারের যে প্রচলন লক্ষ্য করা যায় সেখানেও শব্দ দিয়ে নারী ও পুরুষের পৃথকীকরণের বিষয়টি স্পষ্ট। মিসেস বললে একজন বিবাহিত নারীর যে আইডেন্টিটি ফুটে উঠে সেটি মি. বলা শব্দের সাথে তেমন পরিলক্ষিত হয় না। শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে এই পৃথকীকরণটাই ভাষার আধিপত্য বিস্তার। শুধু শব্দ দিয়েই নয় বিবাহিত নারীর পরিচয় প্রকাশিত রাখার জন্য আরো অনেক ধরণের প্রতীক ব্যবহার করা হয় যা পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
ধর্ষিতা ও মিডিয়ার ধারাভাষ্য!
পত্রিকায় ধর্ষণের শিরোনাম হয় এই রকম-পালাক্রমে ধর্ষণ, গনধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্ষণ, রাতভর ধর্ষণ, নির্জন স্থানে ধর্ষণ, একা পেয়ে ধর্ষণ, কিশোরী ধর্ষণ, তরুণী ধর্ষণ, যুবতী ধর্ষণ, কুমারী ধর্ষণ, সুন্দরী ধর্ষণ। যখন এক ধর্ষণ বুঝাতে শব্দের বিশেষণগত মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বুঝানো হয়, তখন কোনো নারীকে কেবল ঐ পুরুষই আর একা ধর্ষণ করে না বরং তাকে সেই সাথে পুরো পুরুষতন্ত্র দ্বারা ধর্ষণ করার সুযোগ করে দেয় আরেক পুরুষতান্ত্রিক ভাষা, শব্দ ও মিডিয়া। যখন জোরপূর্বক ধর্ষণ বলা হয় তখন কিন্তু এটাই প্রতিফলিত হয় যে, নারীকে জোর করে ধর্ষণ করা যায়। যখন নির্জন স্থানে ধর্ষণ বলা হয়- তখন মনে করা হয় নির্জন স্থানে গেলেই নারী শ্বাপদ-সংকুল, তার সেখানে যাওয়া নিষেধ। যখন একা পেয়ে ধর্ষণ বলা হয় -তখন বুঝায় নারীকে একা হলেই ধর্ষিত হতে হবে। সুন্দরী-যুবতী, কুমারী-এই শব্দগুলোতো এক কথায় ভাষাগত রাজনীতিতে ধর্ষণের জন্য টান টান উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়া হয়। এখানে সংবাদ বা সাংবাদিক কি মনে করে লিখেছে সেটা বিষয় নয়-বিষয় হলো ব্যবহৃত শব্দ কি দ্যোতনা ছড়িয়েছে। এই যে সিগনিফায়ার, সে কি সিগনিফায়িং করছে, সে কি বুঝাচ্ছে এটাই আসল। প্রতিটা শব্দের ক্ষেত্রেই কিন্তু ধর্ষণ মাত্রাগত তারতম্য ছড়িয়েছে। এবং এর কোনোটাই ধর্ষিতার পক্ষে যায় না। বিষয়টা এমন যে, এক পুরুষ ধর্ষণ করে আনন্দ পায় আর আরেক পুরুষ ধর্ষণের খবর লিখে, খবর পড়ে বিবমিষায় ভোগে সুখ পায়। এই সুখ প্যাথলজিকাল রোগের মতো। প্যাথলজিকাল রোগ যেমন সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে এটা ও তেমনি। কোনো এক রাউজানের পুরুষ ধর্ষণ করে সুখ পেলে তেতুলিয়ার আরেক পুরুষের মনে সেই সুখ ছড়িয়ে পড়ে। ভাষার রাজনীতি এমনই যে সে একজন ধর্ষিত নারীকেও অপদস্থ করে।
শব্দ সন্ত্রাস ও বদলে যাওয়া নারীর ভাষা!
শব্দের উপরে যে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য সেটি সেটি নিয়ে নারীবাদী চিন্তকেরা ব্যাপক সোচ্চার। বিশেষ করে উত্তরাধুনিক নারীবাদীরা নারীকে যে ভাষায় বয়ান করা হয় তারা সেটার পক্ষে কথা বলেন। হেলেন সিঁসু, লুইস ইরিগারে আর জুলিয়া ক্রিস্টিভা নামের তিনজন নারীবাদী এই চিন্তার উদগাতা। যদিও আরেক চিন্তাবিদ জুডিথ বাটলার এই নারীর উপর আরোপিত ভাষা ও তার ব্যবহার নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। এই চিন্তাবিদেরাই সর্বপ্রথম ভাষার রাজনীতিকে আমাদের সামনে নিয়ে আসেন। তারা দেখান যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতা কাঠামো যেভাবে পুরুষের হাত ধরে এগিয়েছে ঠিক সেভাবেই তারা নারীকে ভাষা দিয়ে বর্ণিত করেছে। তারা মনে করেন পূর্বে লিখিত সব কয়টি গ্রন্থের পূণ:পাঠ করা দরকার এবং শব্দের ভেতর দিয়ে যেভাবে নারীকে খোলস বন্দি করা হয়েছে সেটা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এই বের হয়ে আসার কাজটা করার জন্য তারা নারীদের নিজস্ব একটি ভাষা অধিগ্রহণ করতে বলেন যা দিয়ে প্রতিটা শব্দ দ্বারা পুরুষের সমক্ষতা তৈরি হতে পারে। তারা বলতে চান শব্দের দ্বারা শুধু যেভাবে নারীর নিষ্ক্রিয়তাকে তুলে ধরা হয়, একই ভাবে সেটি দিয়ে পুরুষের দূর্বলতাকে প্রকাশ করতে হবে। প্রকাশ করতে হবে তাদের সক্রিয়তাকেও। তারা এই আলোচনা থেকে যে বিষয়টি চিহ্নিত করতে চান সেটি হলো শব্দের একটি নিরপেক্ষ বিভাজন অথবা উভমুখী বিভাজন। যা দিয়ে নারী পুরুষ উভয়েই একটি সমতা সূচক ক্ষমতা কাঠামোতে বিরাজমান থাকবে।
শব্দ সন্ত্রাসের বিপরীতে জেন্ডার নিরপেক্ষ ভাষা!
ভাষার এই রাজনীতি নিয়ে বিস্তর আলোচনার প্রেক্ষিতে আমাদের কাছে এখন সবচেয়ে বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছে নারীর উপরে শব্দ সন্ত্রাসের বিষয়টি। শব্দ ব্যবহারের নিরপেক্ষতা। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা এই শুদ্ধি অভিযান চালু করেছে। ইনক্লুসিভ বা জেন্ডার বা নিরপেক্ষ শব্দ দিয়ে ইতিমধ্যে নারীর উপরে ভাষার রাজনীতির বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রচারণা কার্যকর হচ্ছে। সেখানে He এবং She শব্দের মাঝামাঝি বুঝাতে Xe শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। মূলত বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ দ্বারা ব্যবহৃত শব্দের ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে আছে। এসব বিষয় এখন আমাদের দেশেও প্রচলিত হচ্ছে। পুলিশ ম্যান না বলে পুলিশ অফিসার বলা, চেয়ারম্যান না বলে চেয়ারপার্সন বা সভা প্রধান ব্যবহার করার যথেষ্ট প্রচলন আমাদের সর্বক্ষেত্রে যেমন চালু হচ্ছে তেমনি বিপরীত দিকে ঢালাওভাবে ব্যবহার করা 'নগর পিতা'র মত শব্দেরও। গণমাধ্যমে জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দের ব্যবহার ক্রমে বাড়লেও নারী কেন্দ্রিক শব্দ ব্যবহারের তীর্যকতা কমেনি। খুব সমন্বিত পদ্ধতি দিয়ে যদি স্কুল থেকে এই লিঙ্গ নিরপেক্ষ শব্দের ব্যবহার বন্ধ করার মত উদ্যোগ নেয়া যায় তাহলে অন্তত আমরা শব্দের ব্যবহারের দ্বারা যথেষ্ট নিরপেক্ষতা তৈরি করতে পারবো। যদিও মূলগতভাবে নারীর সাথে পুরুষের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বগত জায়গায় সমতা তৈরি না হলে এই ভাষার রাজনীতির কাঠামো ভাঙা যাবে না তবুও এই নিরপেক্ষ ভাষার ব্যবহার আমাদেরকে আশা দেখাতে পারে।