কাজল দাস

নারীবাদী রাজনীতি, সোশাল মিডিয়ার যুগে সামাজিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ, আইডেন্টিটি পলিটিক্স ও যৌনতার ইতিহাস বিষয়ক লেখক।

ভাষার পুরুষাধিপত্য: নারীর উপরে ভাষার রাজনীতি

ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের বাহন। মানুষ মাত্রই আমরা কোন না কোন ভাষাতেই কথা বলি। আমাদের ভাষা বাংলা অথবা ইংলিশ, হিন্দি অথবা গুজরাঠি বা মারাঠি। এই ভাষাই মানুষের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার যা দিয়ে সে বংশ পরম্পরায় জ্ঞানকে প্রবাহিত করেছে। কিন্তু এই ভাষার ভেতর দিয়েই টিকে আছে পুরুষাধিপত্য। এই ভাষা দিয়ে যখন নারীকে বর্ণনা করা হয় তখন তার উপরে চাপিয়ে দেয়া হয় এক ধরণের হীন মানসিকতা। বাংলা ভাষাতেই এই ভাষার আধিপত্য রয়েছে বিস্তর। আমরা যে প্রচলিত বাংলা ভাষাতে কথা বলি তা সেটা আঞ্চলিক হোক আর সাধু ভাষাই হোক সেখানেও রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে নারীকে হেয় করা বা তাকে অধ:স্থন হিসেবে চিহ্নিত করার প্রভূত নিদর্শণ লক্ষ্য করা যায়। ভাষার এই ব্যবহার সমাজে নারীকে যতটা তীর্যক করে কথা বলে কিংবা যতটা কোমল হিসেবে নারীকে উপস্থাপণ করে এটি দেখা যায় না পুরুষের ক্ষেত্রেও। ভাষা নারীকে কিভাবে অধ:স্থন করে রেখেছে এটি বাংলা ভাষার স্ত্রী বাচক শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যায়। আমাদের প্রচলিত বাংলায় আমরা নারীকে যেসব শব্দ দিয়ে গালি দেই সেগুলো সব কয়টাই পুরুষতান্ত্রিক শব্দ। শুধু গালি বাচক শব্দ দিয়েই নয়, নারীর উপরে আধিপত্য তৈরি করার জন্য প্রতিনিয়ত নানান রকমের শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে সমাজে অহরহ! এই শব্দগুলো নির্দেশ করছে নারী আর পুরুষের শক্তিমত্তার পার্থক্যকে, তাদের ব্যক্তিত্বকে, একটি শব্দ দিয়েই আমরা নারীর দূর্বলতাকে চিহ্নিত করেতে পারি অনায়াসে। ভাষা যে শব্দের জাল বিস্তার করেছে সেখানে কিভাবে নারীকে নির্মাণ করছে এই বিষয়টি ভাষার রাজনীতিকে খুব প্রতিফলিত করে।

 

পুরুষসুলভ ! নারীসুলভ!

বন্ধুদের আড্ডায় ছেলেরা কাউকে 'হাফ লেডিস' বলা মানেই ঐ ছেলেটিকে অপমান করা। কোন ছেলে যদি একটু মেয়েদের মত আবেগ প্রকাশ করে অথবা মেয়েদের মত করে অনুভূতি প্রকাশ করে তাকে অন্য ছেলেরা একটু অসম্মান করে দেখে। এই যে অনুভূতির প্রকাশের কারণে কোন ছেলেকে হেয় করে দেখার বিষয় এটি এসেছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে। আমাদের চিন্তা কাঠামো এমন ভাবে গঠিত হয়ে আছে যে মেয়েদের মত ছেলেকে আবেগ প্রকাশ করা যাবে না বা মেয়েরা যেভাবে সংবেদী আচরণ করে পুরুষ সেটি করতে পারবে না। আবার কোন নারী যদি পুরুষের শক্তি প্রদর্শণ করে, আচার আচরণে কাঠিন্য দেখায় তাকেও আমরা নিতে পারি না। ডানপিটে ছেলে হলে ভাল আর সাহসী শোনায় কিন্তু মেয়ে হলে শোনায় খারাপ। এভাবে নারী ও পুরুষের জন্য আমরা এমন করে জেন্ডার বিভাজিত শব্দকে তৈরি করেছি যা প্রত্যক্ষভাবে নারীকে পিছিয়ে রাখছে। নারীরা কোমল হবে, তারা সবাইকে কেয়ার করবে, সে একটু আঘাতে ভেঙ্গে পরবে এসব ধারণা গুলো আমরা কতগুলো শব্দ দিয়েই প্রতিষ্টিত করেছি। যদিও শব্দ দিয়ে প্রকাশ করছি বা সিগনিফায়িং করছি কিন্তু তার পেছনের বস্তুগত ভিত্তি রয়েছে। আমরা শিশুদের ক্ষেত্রে খুব সচেতনভাবেই বলে থাকে 'এটা ছেলেরা করে না', ওটা মেয়েরা করে না'। এভাবে তাদের মধ্যে একটি বিভাজিত ধারণা গড়ে উঠে যা দিয়ে তারা পরস্পর থেকে আলাদা হয় এবং ক্ষমতা কর্তৃত্বের দিক থেকে ছোটবেলা হতে কেন্দ্রে আর প্রান্তে অবস্থান করে।

 

 সব গালিই নারীকে ইঙ্গিত করে!

পাড়ার মোড়ে মোড়ে এখন যত আড্ডা হচ্ছে একটি কমন গালি এখন ব্যবহৃত হয় 'মাদারচোৎ'। শাব্দিক অর্থে এই গালিটি দ্বারা বুঝানো হচ্ছে 'মায়ের সাথে যৌন ক্রিয়া। একে অপরকে পিঠ চাপড়ে দিয়ে এই গালি দেদারছে দিয়েই যাচ্ছে। একটি গালি হিসেবে এটি শুধু নারী নয় একজন মা আইডেন্টিটিকে প্রকাশ করলেও খুব সহজে এটির সামাজিকীকরণ ঘটে গেছে। কেউ কোন প্রকারের মনস্থাত্ত্বিক বাঁধা অনুভব করছেনা একে অপরকে এই গালি দিতে।  এই যে একটি গালির সহজীকরণ হল এটার কারণ কি? কারণ হল- আমাদের প্রচলিত গালির নারী কেন্দ্রিকতা। একটি গালি দিয়ে কাউকে চূড়ান্ত অপমান করার জন্য তার সবচেয়ে তীর্যক প্রয়োগ হল এখানে নারীকে সংযুক্ত করা, অথবা চূড়ান্ত রসিকতা করার দরকার হলে নারীকে দিয়ে স্থূল হাস্যরস সৃষ্টি করা। আমাদের প্রয়োগকৃত ভাষায় খুব সহজে এভাবে আমরা নারীকে গালি দিয়ে সম্বোধণ করার কারণ হল আমাদের চিন্তার পুরুষাধিক্য যা যুগ যুগ ধরে পুরুষের চেয়ে নারীর অবস্থান মর্যাদাগত দিক থেকে রেখে চিন্তা করার কারণে তৈরি হয়েছে। সেজন্য আমাদের পক্ষে মাদারচোৎ বলা সহজ ও কানেক্টিং হলেও ফাদারচোৎ ততটা কমিউনিকেটিভ নয়।

 

গালির স্ত্রীলিঙ্গ আছে পুংলিঙ্গ নেই!

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত কিছু নারীকেন্দ্রিক গালি যেমন- খানকি, ছেনাল, বেশ্যা, মাগী, রক্ষিতা, পতিতা, ভ্রষ্টা, কুলটা, ব্যাভিচারিণী, এগুলো এখনো সমান প্রচলিত। এছাড়াও কামিনী, ভামীনি, মহিলা, অঙ্গনা, ভার্যা, রমনী, ললনা এই যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে এসবের কোন পুরুষবাচকতা নেই। নারীকে গালি দেয়া শব্দের পুরুষবাচকতা না থাকার একটি বড় কারণ হল এসব গালি গুলি সমাজে খুবই প্রত্যক্ষভাবে পুরুষেরাই প্রচলিত করেছে। পুরুষেরা যেসব নারীকে যৌন সেবার জন্য বন্দি করে রাখে এসব সব নারীকে রক্ষিতা বলা হচ্ছে অথচ যে পুরুষ নারীকে বন্দি করে রক্ষিতা বানাচ্ছে তাকে কিছু বলা হচ্ছে না। অধিকন্তু যে পুরুষ নারীকে যৌনতার জন্য বন্দি করে রেখেছে তাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। যে সকল রাজা আর বাদশাহদের হারেমে হাজার হাজার রমনী থাকেন তারা সে সময় খুব সমাদৃত হতেন। একইভাবে এই যে 'বেশ্যা' শব্দ বলে গালি দেয়া হচ্ছে সেখানেও তার বিপরীত কোন পুরুষ বাচক শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। দেহ কেন্দ্রিক নারীর বহগামীতাকে বেশ্যা বা ছেনাল বলে গালি দেয়া হলেও পুরুষকে সেভাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে না। সমাজে অর্থনৈতিক কারণে কর্তৃত্ব পুরুষের হাতে থাকায় নারীকে কেনা-বেচার প্রচলন তাদের হাত দিয়েই প্রসারিত হয়। এবং এই ক্ষমতার জন্যই নারীকে নানাভাবে প্রান্তিকীকরণ করা সম্ভব হয়েছে। যেহেতু নারীকে সম্পত্তি হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে এবং এর মধ্যে নারীর যৌনতার একটি বিনিময় মূল্য সমাজে প্রতিষ্টিত হয়েছে সেজন্য তাকে লক্ষ্য করেই এই গালির উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি একটু বিপরীত বিষয় লক্ষ্য করি তাহলে গালি দেয়ার সাথে ক্ষমতা কাঠামোর সম্পর্কটা আরো ভাল করে দেখতে পাই। যদি কোন যৌন সক্ষম পুরুষকে 'নপুংশক' বলে গালি দেয়া হয় তাহলে এই ছেলের জন্য এটি একটি চূড়ান্ত অপমান। যদিও কারো যৌন অক্ষমতা একটি বিশেষ শারীরিক সমস্যা হওয়ায় এটি গালি অর্থে বিবেচ্য হওয়া অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু কোন ছেলেকে এটি বলা মানে তাকে শেষ অপমানটাই করা বুঝায়। এ কথা শোনার পর যে কোন পুরুষেরাই খুবই তীব্র ও শক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এই প্রতিক্রিয়া শুধু যৌন ক্রিয়ার শক্তিমত্তার কারণে আসে তা নয়, এটা হল সমাজের প্রিভিলেইজড পুরুষের ক্ষমতা। যে কারণে সে মনে করেই যে এই গালিটা এটা কোনভাবেই তাকে দেয়া যাবে না। কিন্তু বিপরীতে আমরা দেখি যে, হাজার হাজার শব্দ চয়ন করে নারীকে গালি দেয়া হচ্ছে রোজ। এবং দীর্ঘ কাল ধরে নারীদের আমরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে রেখে এসব গালিকে কাঠামোবদ্ধ করে সমাজে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্টিত করেছি।

 

পুরুষের জন্য কোন সতীত্বের ধারণা নেই!

পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার শুরু থেকেই পুরুষতন্ত্র নারীর উপরে যে মহার্ঘ্য চাপিয়ে দিয়েছে সেটির নাম সতীত্ব। নারীকে পুরাণে সৎ হিসেবে দেখতে গিয়ে বলা হয়েছে 'সতী' নারী। মহাভারতের দৌপ্রদী আর রামায়নের সীতা। এদেরকে সতী স্বাধ্বী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছে। রামায়নে সীতার সাথে বনবাসে যাওয়া রাম কিংবা তার সহোদর লক্ষণকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়নি। দিতে হয়েছে সীতাকে। মধ্য যুগের স্বামীরা যখন যুদ্ধে বা বাণিজ্যে যেত তখন তারা স্ত্রীকে কোমড়ে চেস্টিটি বেল্ট পরিয়ে যেতো যাতে তার সতীত্ব বহাল থাকে। এই পরীক্ষার কারণই ছিল স্বামীর বাইরে আর কোন পুরুষের সাথে সীতার বা ঐসব স্ত্রীদের যৌন সম্পর্কে করা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া। বিবাহিত নারীর জন্য সতীত্বের ধারণা ছাড়াও কুমারী নারীদের ক্ষেত্রেও এই সতীত্বের ধারণা প্রতিষ্টিত হয়েছে। তাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে অক্ষত যোনি হিসেবে। একইভাবে কোন নারী যদি বিধবাও হয়ে থাকেন তাহলে তার উপরেও যৌন আধিপত্য চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেভাবে ইতিহাসে নারীর উপর সতীত্ব চাপানো হয়েছে পুরুষের ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। এর কারণ হচ্ছে নারীকে দেখার যৌন দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষের একাধিক যৌন সম্পর্ককে সমাজে যেভাবে দেখা হয়েছে নারীর ক্ষেত্রে তা ছিল না ফলে বংশ বা পরিবারের ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে একমাত্র নারীর সতীত্ব প্রমাণ করাটাই মুখ্য হিসেবে বিবেচ্য হয়েছে; পুরুষের নয়।

চলমান...

3361 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।