মরতে হলে এখানেই এই ফ্ল্যাটের মধ্যে থেকে মরবো, তবু কোথাও যাবো না। আব্বা সবাইকে ডেকে নিয়ে ঘোষণা দিলেন। তখন মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে। কিন্তু তিনি আমাদের সবাইকে নিয়ে পথে নামবেন না। পথের মধ্যে আরো বেশি বিপদ হবে।
আমিতো অবাক! আব্বা বলছেন এমন কথা! যিনি কিনা ৪৭ সালে ‘কান্মে বিড়ি মু’মে পান লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ করে মুসলিম ভাতৃত্বের বিশ্বাসে থিওলজিক্যাল রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি তাহলে স্বীকার করলেন যে বিপদ ঘটছে। আর পথে নামলে তাঁরই স্নেহের দুলালীদের পাকিস্তান ক্যাম্পে পাচার করা থেকে শুরু করে পুরো পরিবারের ইসলাম পরীক্ষা দিতে দিতে মৃত্যু ও হতে পারে- যা নিয়ে তিনি ডিনায়েলে ছিলেন। ভাবতেও পারছিলেন না এক মুসলমান কি করে আরেক মুসলমানকে হত্যা করছে? প্রথমে না বুঝলেও এখন প্রমাণাদি পেয়ে হতভম্ব! এখন মানে বলছি একাত্তরের কথা। মুক্তিযুদ্ধ চলা কালিন প্রথম দিককার কথা।
যখন আমরা থাকতাম সোবানবাগের সরকারী ফ্ল্যাটের ২ সি’র দোতলায়।। সোবান বাগ কলোনী অনেকটা মিরপুর সড়কে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির প্রায় উল্টোদিকে। যেখানে লেইকের পাড়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। জায়গাটা সে সময়ের ভয়াবহ, কসাই কাদের মোল্লার মিরপুর থেকে খুব দূরে না। যে কোনো সময়ে ওরা রাম্দা ও গরু জবাইর ছুরি নিয়ে এখানে আক্রমন করতে পারে। তাই যেদিন গুজব শোনা যায় পুরো বিল্ডিং কাচিয়ে কুচিয়ে যুদ্ধে যোগ না দেয়া অবশিষ্ট খুচড়া যে ছেলেরা ছিলো তারাই পালাক্রমে রাত জেগে। পাহারা দেয়। পাখি শিকারের টুটু বোরের বন্ধুক ও লাঠি সোটা নিয়ে। আমরা দোতলায় বিধায় নজর রাখতে সুবিধা হবে বলে আব্বা বললেন, আমাদের ব্যালকনীই ব্যবহার করে যায়। তিনি তাদের দেখাশোনা করছেন। চাঁদা তুলে নিচের প্রবেশ পথে লাগানো লোহার গেট লাগানো হবে। ওরা যেদিন পাহারা দেয় আমি ওদের চা করে দিই যাতে ঘুম না আসে। রাস্তায় একটু শব্দ হলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি ওই বুঝি রাজাকার আসে। সারক্ষণই থাকি ত্রাসে।
তখন বাড়িঘর লুট হয়ে যাওয়া আত্মীয়রা সারা দেশের এখান সেখান থেকে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। এরা দিনে রাতে মিষ্টি কুমড়ার আর আলুর লাবড়া খাচ্ছেন। সাইরেন শুনে দৌড়ে গিয়ে গাঁতায় পড়ছেন। আর ক’দিন পর এখানের চাইতে নিরাপদ ব্যবস্থা হলে আবার চলে যাচ্ছেন। আর্মির ভয়ে বাইরে কোনো শাড়ি শুকোতে দেয়া বন্ধ। আমি সকালে উঠেই লঙরখানার জন্য রুটি বেলি। দুপুরে খিচুরী রাঁধি। সন্ধ্যায় ভেঁজা শাড়ি মাটির চুলার ধারে দড়িতে মেলে দিই। যখন রান্না ঘরের ভ্যাপ্সা গন্ধ থেকে শ্বাস নিতে জানালা দিয়ে পেছনের মহা সড়কের তাকাই --ভরসা পাই না। ভয়ে কেঁপে উঠি। ধাঁ ধাঁ করে ছুটে যাচ্ছে জলপাই রঙা যান। খোলা ট্রাকে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে রাজাকার শয়তান।
আব্বার কাছে এখন সব পরিষ্কার। আহারে বাবা আমার, পাকিরা ধর্মের নাম করে তার তীব্র ধার সম্পন্ন ব্লেডে তোমার বিশ্বাসের গোড়া কেটে দিয়েছে।
সেদিনের সন্ধ্যা এমন ঘন ছিলো যে সব কিছুই যেন আবছা। সারাদিন সাইরেনে সাইরেনে এত দৌড়াদৌড়ি হয়েছে যে সবাই ক্লান্ত হয়ে আগেই বিছানা ও ফ্লোর শয্যা নিয়েছে। আমাদের ঘরে ভাইয়া ও শোয়েব স্বাধীন বাংলা শুনছে। আমি হাড়ি বাসন ধুয়ে বাড়তি ভাত ও এ্যাত্তটুকু তরকারি তারের মিটসেফে তুলে রাখছি। এমন সময় দরজায় হাল্কা টংকার। কলিং বেল বাজে না। ব্যাটারী বাতিল। কিন্তু কে বাইরে গিয়ে কিনবে এই সময়ে। কড়ার নিচের ফুটো দিয়ে দেখি এক মলিন চেক জামা। এদিকে কেউ এসেছে বুঝে একটি কোমল কন্ঠ বলে উঠলো, শামীম আপা... শামীম আপা।
বুলবুলে বয়স তখন চৌদ্দ বা পনর হবে। এত অল্প বয়সের ছেলেরাও যুদ্ধে যোগ দিয়েছে ওকে না দেখলে জানতে পারতাম না। সে পরিচয় দিয়েই বাঁ দিকের প্যাসেজের পর্দাটা সরিয়ে অন্ধকারে হাবিজাবি রাখার জায়গায় তার পিঠের ব্যাগটা রেখে নিজেই পর্দা টেনে দিলো। লাল জাফ্রি কাটা দেয়াল ঘেরা ডাইনিং স্পেস। বাইরে থেকে ভেতর দেখা যাবে বলে আলো জ্বলানো নিষেধ। ল্যাম্পপোস্টের আলো কেটে কেটে মাছের জালের মতো পড়েছে তার মুখে। ঐ আলোতেই কন্টাক্ট এর নাম ও নিজের নাম বললে আমি দ্রুত উঠে গেলাম রান্না ঘরে। এত কম তরকারী! একটু বিব্রত ভাবেই কোনক্রমে মেখে খাবার মতো মিষ্টি কুমড়ার লাবড়ার সঙ্গে হাড়ি কাচিয়ে ভাত দিলাম। কল থেকে ঠান্ডা পানি।
প্রথমেই পানি খেলো। আমি আবার পানি আনতে রান্না ঘর থেকে ফেরার সময় অল্প আলোতেই যতদূর ভালো দেখা যায় দেখলাম। দ্রুত কিন্তু চেটেপুটে খাচ্ছে। তারপর আরো দ্রুত কিছু খবর দিলো। চলে যাবার সময় প্যাসেজের বাতি জ্বলিয়ে তার দিকে তাকালে দেখি তার ফর্সা মুখ, গালে টোল। হেসে বল্ল, আপা অনেক মজা হইসে! তারপর নিশব্দে বেরিয়ে গেলো। আব্বা আম্মা হয়তো বুঝলেন কেউ এসেছিলো এবং কেউ চলে গেলো। কিন্তু দরজা খুলে বাইরে এলেন না। কিছু বললেন না।
যেমন অন্ধকারে এসেছিলো তেমন অন্ধকারেই চলে গেলো। আর আমি সেই সোনা রঙ কিশোরের এঁটো বাসন কোশন হাতে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পেছনের গেট নিরাপদে পেরিয়ে গেলো কিনা। রান্না ঘরের কলতলায় জল ছেড়ে ঐ কোমল মুখখানা ভেবে বুকটা কেমন করে! আহারে কে এই বালক? কোথা তার ঘর? কোথায় তার বাবা মা? তার কি আমার মত বোন আছে, কতদিন সে স্নান করে নি, পেট ভরে ভাত খায় নি!
কিন্তু এও বুঝি ভেবে কি হবে? আমরা এখন একটা যুদ্ধে আট্কে গেছি। যুদ্ধ না করে উপায় নাই। এখন এসব ভাবার সময় নেই। যা করবার করতেই হবে। সব ইম্প্রভাইসড চলতে থাকবে। কে জানে কত বছর! ‘ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধংসের মুখোমুখি মুখোমুখি আমরা।’ আমি বাতি নিভিয়ে স্বাধীন বাংলা শুনতে ভাইদের কাছে যাই।
এদিকে আব্বার একটা ইন্টারেস্টিং পরিবর্তন দেখলাম। একদিন শুকরাবাদ মসজিদ থেকে ফিরে রান্না ঘরের জানালার দুটো রড বাঁকিয়ে আমাকে আর বুজানকে ডেকে নিয়ে বললেন, শোন তোরা। দরজা ভেঙ্গে যদি আর্মি রাজাকার ঢোকে তোরা দু’বোন এদিক দিয়ে লাফিয়ে পড়বি। হাত পা ভাঙলে ভাঙবে।
আমাদের ফ্ল্যাটে ২টা প্রবেশ দরোজা। তাতে দুটো করে কড়া লাগানো।কলিং বেলতো ব্যাটারিবিহীন। একটা দরজা পেরেক মেরে জন্মের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। এখন একটাই ব্যবহার করা হয়। যেটা খুল্লেই প্যাসেজ। ডানদিকের দরজার কড়ার আংটার নিচেই ফুটো। সেই ফুটোতে চোখ রাখলে ওপাশের মানুষের মুখ দেখা যায় না জামা দেখা যায়। আম্মা বল্লেন, ফুটোতে যদি খাঁকি কাপড় দেখো দৌড়ে রান্না ঘরে চলে যাবে।
কাল রাতে অন্ধকারে আমি আর ভাইয়া যখন বালিশ চাঁপা দিয়ে ট্রান্সিস্টার থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়ের ভাষ্য শুনছি আব্বা তখন বিড়ালের মতো নিঃশব্দে দরোজার ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সরকারী অনুগত চাকুরে হয়েও আর আগের মতো গলা উঁচিয়ে বলেন নি, কি যাতা গুজব শুনছিস তোরা? অবাক হয়ে দেখলাম এখন কোনো ছেলে আমার কাছ থেকে ক্লাশের নোট দিতে এসেছে বল্লেও তাকে কোনো মহা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন না। পারাপারের জন্য আর বাবু তাকে সালাম দিয়ে দিব্বি ঢুকে যাচ্ছে আমাদের পড়ার ঘরে। আর ওদের দেয়া এই লিফ্লেটগুলোই তখন আমি আর বাবলী সন্তর্পণে এখানে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাস্তায় ফেলে আসছি। রেডিওতে অনুষ্ঠান করার নামে ভেতরে ঢুকে ঐ সময়ে কারা কাজ করছে, তাদের নাম নিয়ে আসছি। আব্বা আম্মা ততদিনে ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়েছেন। কিন্তু সরাসরি কিছু বলছেন না। এরকম সময় বেশি জানতে নেই । বলতে নেই!