পতাকা সেলাই করতে বসেছি। আমার আগের পতাকাটি, নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশের নানান ইস্যুতে এই মিছিল মিটিং করতে গিয়ে হাত বদল হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ওই নেতার কাছ থেকে অনেক চেষ্টা করেও আর ফেরত আনতে পারি নি। তো আর কি করা! আজ আবার বহু বছর পরে নিজে হাতে পতাকা সেলাই করছি।
খুব মনে পড়ছে ছোট বেলায় প্রথম পতাকা সেলাই করার স্মৃতি। তখন মুক্তি যুদ্ধ শুরু হবে হবে, সব বাড়ীতে পাকিস্তানের পতাকা বর্জন আর বাংলাদেশের পতাকা উড়াচ্ছে সবাই। তাই দেখে আমরাও শুরু করলাম পতাকা প্রজেক্ট। আমরা তখন কিছুদিনের জন্য স্কুলের ছুটিতে খুলনা থেকে ফকিরহাট, মামার বাড়ীতে গিয়েছি। আমার বাবা তখন চাকুরী সূত্রে ওদিকটায় ছিলেন। বাবার সাথে ছুটির দিনগুলোতে সময় কাটাবার জন্যে মা আমাদেরকে নিয়ে গ্রামে এসেছেন।
আমার বড় মামীর একটা পা মেশিন ছিলো সিঙ্গারের। সামান্য কিছু টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে আর কিস্তিতে কিস্তিতে শোধ করবেন এমন একটি ব্যাবস্থা করে, খুলনা থেকে মামী এই সেলাই মেশিনটি কিনেছিলেন। অনেক লক্ষী মানুষ দেখেছি জীবনে কিন্তু আমার মামীর মতো এমন বুদ্ধিমতী আর লক্ষ্মী মানুষ আর হয় না। সারা জীবন টুক টুক করে কত কি যে তিনি করেছেন সংসারের জন্য।
তো সেই সেলাই মেশিনে সবুজের ভেতরে গোল লাল সূর্য আর তার উপরে হলুদ রঙে বাংলাদেশের ম্যাপ সেলাই করেছিলাম মনে পড়ে। তখন সবে সেলাই মেশিনে সেলাই করা শিখছি, ভালো করে মেশিনের গতি কন্ট্রোল করতে পারি না। ম্যাপের নানা বাঁকে এসে মেশিন স্লো করতে হয় (যদিও আগেই বড় মামী হাতে সুঁই সুতো দিয়ে টাক দিয়ে দিয়েছিলেন) বার বার বাংলাদেশের ম্যাপের বাঁকে বাঁকে এসে গতি কমাবার চেষ্টা করছি কিন্তু পায়ের গতি তখনো ব্যালান্স করার মতো অবস্থা হয় নি। একবার আর কন্ট্রোল রাখতে পারলাম না, ঘ্যাচাং ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে সুঁইটা আমার বা হাতের মধ্যমায় চার টুকরো হয়ে ভেঙ্গে ঢুকে গেল।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে পতাকা। ডান হাত দিয়ে পতাকাসহ বাম হাত চেপে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছি। কাঁদছি ব্যথায় নয়, ভয়ে। আমার মামা দুই হাতে চেপে ধরে অনেক ধৈর্য নিয়ে তার টুইজার দিয়ে টেনে টেনে তুলে দিলেন আঙুলের সুঁই। হাতের আঙুল জুড়ে মস্ত ব্যান্ডেজ নিয়ে দেখলাম সেই পতাকা মামা বাড়ীর টিনের চালের উপর পত পত করে উড়তে লাগল পরদিন। মামাত ভাই লাঠির আগায় পতাকা বেঁধে আমাদের নিয়ে মিছিল করতে করতে একসময় মই বেয়ে উঠে উড়িয়ে দিলো।
এরপরে ছুটি শেষে আমরা ফিরে এসেছি খুলনায়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে একদিন স্কুল থেকে বলে দিলো, অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ হলো স্কুল। কবে খুলবে জানে না কেউ। অনেক বড় বড় ঝলমল স্মৃতি ভুলে গেছি কিন্তু সেই দিনটি স্মৃতিপট থেকে কিছুতেই হারায় না। ২৫ মার্চের পরে খুলনায় মিলিটারি এসে ভরে গেছে। কারো বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখলে পুড়িয়ে জ্বালিয়ে গুলি করে মেরে ফেলছে মানুষ। ভয়ে সবার মতো আমাদের খুলনার বাড়ী থেকে আমরাও নামিয়ে রেখেছি পতাকা। এর পরে খুলনা ছেড়ে ফকির হাটে আমার মামা বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি আমরা। আত্মীয় স্বজনেরা ছাড়াও চেনাজানা পরিবার গুলো একত্রে। একসাথে অনেক মানুষ। নিরবে থাকছি। সন্ধ্যাবেলায় লেপের নীচে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছি। যুদ্ধ চলছে, মানুষ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে দেশ দেশান্তর। মানুষের রক্তে ভেসে চলেছে সারা বাংলাদেশ, তবু একদিন স্বাধীন হবে আমাদের দেশ সেই স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে মানুষ।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। সবাই জয়বাংলা স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছে চারিদিক। আমরা পাগলের মতো পতাকা খুঁজছি। আমার মামী আমার সেলাই করা সেই পতাকাটি তার গোপন কাঠের সিন্দুকের তলা থেকে বের করে আনলো। এই আমাদের পতাকা। মামা বাড়ীর উঠোন জুড়ে সব ভাইবোনেরা, আত্মীয় স্বজনেরা মিলে জয়বাংলা স্লোগানে স্লোগানে ভরিয়ে তুললাম সারা আকাশ, বাতাস ঐ পতাকার দিকে চেয়ে। সেই দিন ছিলো আমাদের বিজয়ের দিন। সকল আক্রমণ, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, নির্মমতার অবসান ঘটিয়ে আমাদের জয়ী হবার দিন।
আজ এই পতাকা সেলাই করতে বসে কেনো চোখ ভিজে যাচ্ছে বার বার! ওদের কথা মনে পড়ছে যাদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের এই রক্তমাখা পতাকা। আমরা আজ যাদের ভুলতে বসেছি। যাদের আদর্শ ও বিশ্বাসকে বুড় আঙুল দেখিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দিচ্ছি। সংবিধান পরিবর্তন করেছি! তবু আমি জানি, নিশ্চিত জানি এই পতাকাই আমাদেরকে সকল সত্য ও সুন্দরের দিকে হাত ধরে নিয়ে যাবে। এই পতাকাই আমার সকল শক্তির শেষ উৎস!